You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযােদ্ধার সহায় - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযােদ্ধার সহায়

কথিত আছে, মরুভূমির রণাঙ্গনে মরুভূমি ও যুদ্ধ করিয়া থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে উত্তর আফ্রিকার মরু-রণাঙ্গনে রােমেল ও মন্টোগােমারি উভয়েরই বাহিনীকে এই অভিজ্ঞতা লাভ করিতে হইয়াছিল। মরুভূমির প্রশস্ত প্রান্তরে বাহিনীর অগ্রাভিযানের জন্য পথ পাইবার যেমন বিশেষ কিছু সুবিধা ছিল, তেমনিই আবার অসুবিধাও ছিল। মাঝে মাঝে প্রবল মরুঝাড়ের বাধা বাহিনীর অগ্রগতি ব্যাহত করিয়াছে। আরবের লরেন্স নামে বিখ্যাত হইয়াছেন যে কূটবুদ্ধির দূত, ইংরাজের স্বার্থের জন্য আরবের বেদুইনদিগকে যিনি প্ররােচিত করিয়া বিদ্রোহ ঘটাইয়াছিলেন, তিনি তাঁহার স্মৃতিকথায় লিখিয়াছেন যে, মরুভূমিতে দূরবর্তী বিপক্ষের শিবিরকে মাঝে মাঝে মরীচিকার ছবি বলিয়া মনে হয় । তাহার অবস্থান কতদূরে এবং কোন দিকে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাহা ছাড়া মরুবাতাসের জ্বালা এবং মরু ঝড়ের প্রচণ্ড ধূলিঘটাও আছে। | নেপােলিয়ন রুশিয়ার মস্কো আক্রমণ করিবার চেষ্টায় মস্কোর কাছে উপনীত হইয়াও তাহার বিরাট বাহিনী লইয়া ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তাহার উদ্দেশ্য আশা ও সেনাবল যাহার আঘাতে জর্জরিত হইয়াছিল, তাহা হইল রুশিয়ার শীত। ফিরিয়া যাইবার পথের তুষার-আস্তরণের উপর নেপােলিয়নের বাহিনীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশকে শপিগু হইয়া পড়িয়া থাকিবার দুর্ভাগ্য স্বীকার করিতে হইয়াছিল। সুতরাং বলিলে ভুল হইবে না যে, শীতের প্রকৃতি এবং তাহার বরফও বাধা দিবার যুদ্ধ করিতে জানে, করিয়াও থাকে। প্রাচীন গ্রীসের জেনােফনের বাহিনী পর দেশ আক্রমণ করিতে গিয়া পার্বত্য বাঁধার মধ্যে পড়িয়া উদ্ভ্রান্ত হইয়াছিল। এইরূপ উদ্ভ্রান্তির পথে চলিতে চলিতেও মরিতে মরিতে একদিন সমুদ্রোপকূল দেখিতে পাইয়া উল্লাসের চিক্কার ছাড়িয়াছিল সমুদ্র সমুদ্র। অর্থাৎ এইবার দেশে ফিরিয়া যাইবার উপায় হইবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে বর্মার জঙ্গল যুদ্ধের বৃত্তান্ত ও প্রমাণিত করে যে, বিপক্ষের বহিনীর বাধা ছাড়া আরও একটি বাঁধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল। তাহা হইল, অরণ্যেরই বাঁধা। বিপক্ষের গােলাগুলির তুলনায় অরণ্যের বাঁধার আঘাত কম প্রবল হয় নাই।

সুতরাং বলিতে পারা যায়, অরণ্যও যুদ্ধ করিতে জানে। এবং প্রকৃত বাস্তব সত্যটি এই যে, দেশের মানুষ যখন তাহার আক্রমণকারী আগন্তুক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। করে তখন সেই দেশের ভৌম প্রকৃতি এবং নৈসর্গিক অবস্থাও সহায়ক হইয়া শত্রুবাহিনীকে বাধা দিতে থাকে। বাংলাদেশের জনৈক মুখপাত্র বলিয়াছেন, আসন্ন বর্ষার ঋতুতে ইয়াহিয়া ফৌজকে দুরবস্থায় পড়িতে হইবে। জলপ্লাবিত বাংলাদেশের মাঠঘাট এবং অজস্র নদীনালা পাকিস্তানী ফৌজের উগ্র ব্যস্ততার পথও প্লাবিত করিয়া দিবে। কিন্তু মুক্তি ফৌজের কাছে তেমন কোন সমস্যা দেখা দিবে না। জলের সহিত মিতালী করিয়া যাহাদের জীবন কাজ করিতে অভ্যস্ত হইয়াছে, তাহাদের মুক্তিফৌজের পক্ষে বর্ষাঋতু অবশ্যই একটি বড় সহায় হইবে, তাহা মুক্তিফৌজের পক্ষে কঠোর ও দুরূহ হইবে না।। | সামরিক বিশেষজ্ঞ অবশ্য অনুমান করিতে পারেন যে, পাকিস্তানী ফৌজ বাংলাদেশের বর্ষার বিরুদ্ধে লড়িবার উপযােগী ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে ব্যস্ত হইয়াছে। শুরু হয়তাে কয়েক শত গানবােট যােগাড় করিয়া ফেলিবে। কিন্তু তাহাকেও বাংলাদেশের বর্ষার বাধাকে দমিত করা সম্ভব হইবে না। অবস্থা বরং এমনও হইতে পারে যে, শত্রুর ফৌজ বাংলাদেশের বর্ষা রাতের একটি হিজল গাছের ছায়ান্ধকার দেখিয়া আতঙ্কে অভিভূত হইবে। জলে ঝাপ দিবে ও মরিবে। 

নয়া পাকিস্তানী খেল

কূটনীতির কুটিল লড়াইয়ে পাকিস্তান দেখিতেছি আর এক ধাপ অগ্রসর হইয়াছে; চিঠি-চাপাটি ছাড়িয়া সে এখন স্বেচ্ছাচারিতার ডাণ্ডা লইয়া আসরে নামিয়াছে। সে ডাণ্ডার ঘায়ে ভারতবর্ষকে ঠাণ্ডা করিয়া ছাড়িবে মনে মনে এই মতলবই সে ভাজিতেছে। প্রথম আঘাত হানিয়াছে ঢাকার ভারতীয় কুটনৈতিক মিশনের উপর। শনিবার এক পত্র লিখিয়া সােমবার ১২টার মধ্যে ওই মিশন গুটাইয়া লইতে ভারত-বর্ষকে বলিয়াছে। পাকিস্তান। সঙ্গে সঙ্গে একথাও জানাইয়াছে কলিকাতায় তাহার ডেপুটি কমিশনের দপ্তরও সে ওই দিন হইতে বন্ধ করিয়া দিতেছে। দুই প্রস্তাবের কোনওটিতেই অবশ্য ভারতবর্ষের আপত্তি নাই। সে কথা তৎক্ষণাৎ নয়াদিল্লি ইসলামাবাদকে জানাইয়াছেন। কেবল দাবী করা হইয়াছিল, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি পাকিস্তান যেন অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলে। তেমন করিবার প্রতিশ্রুতিও ইসলামাবাদ হইতে মিলিয়াছে। ব্যাপারটা ভালােয় ভালােয় মিটিয়া যাক, এটা পাকিস্তান চায় না। তাহার বাসনা একটা জট পাকাইয়া তােলা। ২১ এপ্রিল ঢাকায় এবং দুই দিন পরে করাচিতে ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি-হাই-কমিশনারের পত্নীর সহিত যে অভদ্র আচরণ করা হইয়াছে তাহাতেই বােঝা যায় পাকিস্তান খোঁচাইয়া ঘা করিতে চায়। তাহার মতলব ঢাকায় ভারতীয় মিশনের লােকজনদের সপরিবারে আটকাইয়া রাখা যাহাতে তাহাদের বদলা হিসাবে কলিকাতায় পাকিস্তান মিশনের প্রাক্তন শ্রী হােসেন আলিকে সদলবলে পাকিস্তানে টানিয়া আনিতে পারেন। কাজটা আন্তর্জাতিক নীতি বিরুদ্ধ। কিন্তু চোরা কি আর ধর্মের কাহিনী শােনে? নয়াদিল্লিকেও তাই পালটা ব্যবস্থা লইতে হইয়াছে।

ঢাকায় কূটনীতিক মিশন তুলিয়া দেওয়াতে কিংবা কলিকাতা হইতে পাকিস্তানী মিশন উঠিয়া যাওয়াতে ভারতবর্ষের কোনও ক্ষতি হয় নাই। পাকিস্তান হয়তাে ভাবিয়াছে ঢাকায় কোনও ভারতীয় কূটনীতিক না থাকিলে বাংলাদেশে তাহার অপকর্মের কথা কেহ জানিতে পারিবে না, সে কাহিনী গুপ্তই থাকিয়া যাইবে। কিন্তু তাহার গােপন কথা তাে আর ভারতবর্ষ বোস করিয়া দিতেছে না। শত চেষ্টাতেও সে কেলেঙ্কারি ঢাকা দেওয়া যাইবে না- ঢাকা শহর হইতে তাবৎ কূটনীতিক মিশনকে বিদায় দিলেও নয়। তবে গায়ের জ্বালায় পাকিস্তান যাহা করিয়াছে তাহাতে ভারতবর্ষের অসুবিধা কিছু হইবে না। ঢাকায় পাকিস্তানের অধিকার নামমাত্র। এখনও যাহাকে ইসলামাবাদ পূর্ব-পাকিস্তান বলিয়া চালাইতে চায় সেখানে তাহার প্রভুত্ব বিলুপ্ত হইয়াছে, সেখানকার দিগন্ত নূতন সূর্যোদয়ে প্রদীপ্ত। তাহার নাম এখন বাংলাদেশ। পাকিস্তানের ছাড়পত্র লইয়া সে দেশে কূটনীতিক মিশন রাখা অর্থহীন । মৃতের শহরে ভারতীয় ডেপুটি হাই-কমিশন কোন কার্য করিতে পারিত? লজ্জাশরমের বালাইতাে জঙ্গীশাহীর নাই। কূটনীতিক নিয়মকানুন লঙ্ঘন করিতে তাহার তাে আর বাধে না। কাজেই কখন কী ঘটে ভাবিয়া হাই কমিশনের ভারতীয় কর্মীদের সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকিতে হইত। দেশে ফিরিতে পারিলে তাহারা অন্তত ঘুমাইয়া বাঁচেন।।  কলিকাতায় পাকিস্তান কূটনীতিক মিশন রাখিবে কি রাখিবে না, সেটা স্থির করিবে পাকিস্তান। সে তত্ত্ব। লইয়া আমাদের মাথা ঘামানাে নিষ্প্রয়ােজন। তবে ঢাকায় ভারতীয় মিশন বন্ধ করিয়া দিবার পর পাকিস্তান যদি এখানে তাহার মিশন চালাইতে চাহিত তাহা হইলে সে আবদার তাে আর রক্ষা করা যাইত না। সম্ভবত সে কথা ভাবিয়াই পাকিস্তান সে দাবি তােলে নাই। আর তুলিবেই বা কোন মুখে? সীমান্তের ওপারের। অঞ্চলতাে তাহার বেদখল হইয়াছে। তাহার তরফ হইতে কোন্ কূটনৈতিক কাজটা তাহার মিশন কলিকাতায় বসিয়া করিবে। গুপ্তচরবৃত্তি অবশ্য করিতে পারিত। কিন্তু সে কাজ কলিকাতার এই উত্তপ্ত আবহাওয়ায় করা আদৌ সম্ভব নয়। গােয়েন্দাগিরি কেহ খােলাখুলি করে না, করে গােপনে, প্রকাশ্যে। ভালােমানুষ সাজিয়া। কিন্তু পাকিস্তানের স্বরূপ তাে এ রাজ্যে জাহির হইয়া গিয়াছে। এখন গুপ্তচর হওয়াও তাে চলিবে না। অতএব মানে মানে সরিয়া পড়াই পাকিস্তানের কাছে বুদ্ধিমানের কাজ বলিয়া মনে হইয়াছে। তবে যাইবার আগে মরণ-কামড় সে দিতে চাহিতেছে।

২৭ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা