You dont have javascript enabled! Please enable it! দল ও দেশের স্বার্থে - সংগ্রামের নোটবুক

দল ও দেশের স্বার্থে

ন্যাশনাল আওয়ামী লীগের নেতা মৌলানা ভাসানী প্রজাতন্ত্রী চীনের দুই প্রধান মাও সে তুং এবং চু-এন লাইয়ের কাছে ইয়াহিয়া খাকে মদত না দেওয়ার জন্য যে আর্জি পেশ করিয়াছেন সেটা মঞ্জুর হইবার কোনও সম্ভাবনা আছে বলিয়া বােধ হয় না। যুক্তি নিঃসন্দেহে মৌলানা ভাসানির দিকে। যে জঘন্য নরমেধ যজ্ঞ আজ বাংলাদেশে চলিতেছে তাহার কোনও নজির বিশ্বের ইতিহাসে নাই। তাহার উপর সে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের উপলক্ষ্য নিপীড়ন ও নির্যাতন, লুণ্টন ও শােষণের বিরুদ্ধে গণ-অভুত্থান। প্রজাতন্ত্রী চীন এতকাল তাহার পররাষ্ট্রনীতির যে ভাষ্য নিজে করিয়াছে তাহাতে তাহার সহানুভূতি বাংলাদেশের দিকেই থাকিবার কথা। সম্ভবত সে কথা মনে করিয়াই চীনের ভক্ত মৌলানা ভাসানি পিকিংয়ের কাছে আকুল আবেদন জানাইয়াছেন। সহৃদয়তার জন্য, ইয়াহিয়া খার বর্বর আক্রমণের হাত হইতে সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত। বাঙালীকে বাচাইবার জন্য । হয়তাে তাহার মনে ক্ষীণ আশা আছে, তিনি যখন চীন বিরােধীদের দলে ননচৈনিক আদর্শে তিনি যখন বিশ্বাসী, তখন হয়তাে তাহার বক্তব্য পিকিং তাচ্ছিল্য করিয়া উড়াইয়া দিবে না। | এই যদি মৌলানা ভাসানির ধারণা হয় তাহা হইলে বলিব, তিনি বিসমিল্লায় গলদ করিয়া বসিয়া আছেন। অত সহজে পিকিংকে টলাইতে পারা যাইবে বলিয়া বােধ হয় না। লাল চীন একান্ত বস্তুনিষ্ঠ রিয়াল পলিটিক অর্থাৎ বাস্তব রাজনীতির নৈষ্ঠিক উপাসক। আবেগের ধার সে ধারে না। ইয়াহিয়া খাকে বিচার-বিবেচনা না করিয়া পিকিং হঠাৎ সমর্থন জানায় নাই। সে কাজ সে করিয়াছে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া। তাহার প্রেরণা। বন্ধুপ্রীতি নয়, পরহিতৈষণাও নয়, নিছক স্বার্থ, ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় স্বার্থ ।

পিকিংয়ের বিবেচনায় দলের স্বার্থের খাতিরে ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খাঁ গােষ্ঠীকেই সমর্থন জানানাে দরকার। সে জন্য পূর্ব বঙ্গের সাড়ে সাত কোটি লােককে যদি ধ্বংসের পথে ঠেলিয়া দিতে হয় তাহাতেও প্রজাতন্ত্রী চীনের আপত্তি নাই। দল ও দেশের দাবির কাছে আর সব দাবিই তাহার বিচারে তুচ্ছ, এমনকী মানবিকতা মনুষ্যত্বের দাবিও। দল ও দেশের স্বার্থ বজায় রাখিতে গেলে অত ভাবপ্রবণ হইলে চলে না, অত তত্ত্বের অনুশাসন মানা যায় না। | পিকিং কী চায়, তাহার বিস্তারিত ব্যাখ্যা মিলিয়াছে রাশিয়ার একটি পত্রিকার এক নিবন্ধে। তাহাতে বলা হইয়াছে চীন চায় বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে প্রাধান্য লাভ করিতে। একালের দুই সুপার পাওয়ার অর্থাৎ বৃহৎ শক্তি হইতেছে আমেরিকা ও রাশিয়া। লালচীনের লক্ষ্য তাহাদের নাগাল পাওয়া নয়, তাহাদের ছাড়াইয়া যাওয়া। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি মানিয়া চলিলে চীনের সে আশা পূর্ণ হইবে না। কেননা দুই বৃহৎ শক্তিই তাহা হইলে স্বচ্ছন্দে নির্বিঘ্নে আরও শক্তি সঞ্চয় করিতে পারিবে, তাহারা আরও সমৃদ্ধশালী ও পরাক্রান্ত হইয়া উঠিবে। মস্কোর ধারণা পিকিং তাই বিশ্ব-রাজনীতিতে নারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছে রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার লড়াই বাধিয়া গেলেই সে খুশী হইবে। সে সুন্দর-উপসুন্দরের দ্বন্দ্বে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়তাে কেহ হইবে না, কিন্তু দুই দৈত্যই দুর্বল হইয়া পড়িবে। চীনের তাহাই কাম্য- তেমন ঘটিলেই সে কাজ গুছাইয়া লইতে পারিবে। | সে তাে অনেক পরের কথা। আপাতত চীন চায় এশিয়াতে নিজের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তার করিতে। সে উদ্দেশ্য সিদ্ধির প্রধান কেন, একমাত্র অন্তরায় ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষ হতমান না হইলে চীনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। ১৯৬২ সনের লড়াইয়ে ভারতবর্ষ পরাস্ত হওয়াতে তাহার পথ অনেক পরিস্কার হইয়াছে। আবার যদি কোন উপায়ে ভারতবর্ষের মর্যাদা ক্ষুন্ন করিতে পারে তাহা হইলে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী বলিতে এশিয়াতে কোনও দেশ আর থাকিবে না। রুশ ভাষ্যকারের মতে ভারতবর্ষকে বিপাকে ফেলিবার জন্য চীন  তাহাকে ধীরে ধীরে কূটনৈতিক বেড়াজালে ঘিরিয়া ফেলিবার আয়ােজন করিতেছে। এ দেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে যদি ভারতবিদ্বেষী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তাহা হইলে তাে সােনায় সােহাগা। তাই ইয়াহিয়া খাকে চীন সাহায্য করিতেছে, পাকিস্তানের সংহতিবিনাশের চেষ্টায় নিন্দায় পঞ্চমুখ হইয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে ভারত বর্যকেও হুমকি দিয়া চলিতেছে। চীনের দরদ নিজের উপর, নিজের দলের উপর। নিজের স্বার্থ রক্ষা করিতে গেলে চক্ষু-লজ্জা থাকিলে চলে না, এ বােধ পিকিংয়ের বিলক্ষণ আছে। ভাসানির চোখের জলে সে টলিবে কেন, হউক না তিনি তাহার ভক্ত।

২৫ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা