এ সংসার ধোকার টাটি
পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর আর কিছু থাকুক আর নাই থাকুক কল্পনাশক্তি তাহার অত্যন্ত প্রখর, উদ্ভাবনী শক্তিরও ও তারিফ করিতে হয়। অবশ্য কথাটা কিছু নূতন নয়। তাহার উর্বর মস্তিষ্কে কত উদ্ভট জিনিসের উদাম হয়। তাহার লেখাজোখা নাই । বিশেষ করিয়া ভারতবর্ষকে কেন্দ্র করিয়া যদি তাহার কল্পনা কিস্তার লাভ করে তাহা হইলে বল্গাহীন ঘােড়ার মত তাহার গতি হইয়া উঠে উদ্দাম । তখন সম্ভব অসম্ভবের ভেদাভেদজ্ঞান তাহার থাকে না, বাস্তব অবাস্তবেরও নয়, সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যও তখন লয় পায়। অবশ্য পাকিস্তান চেতনা হারাইলেও দুনিয়াসুদ্ধ লােক তাে আর বুদ্ধিভ্রষ্ট হয় না। তাহার চাতুরী ভারতবর্ষ তাে অনায়াসেই ধরিয়া ফেলে, অন্য দেশের কাছেও সে মিথ্যাচার গােপন থাকে না, পাকিস্তানী ধাপ্পাবাজী কাহারও চোখেই ধুলা দিতে পারে – স্বদেশের লােকেদেরও নয়। আজ লাহােরে যাত্রিবাহী বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটা লইয়া যে কাণ্ড পাকিস্তান করিয়াছে তাহার বুঝি। তুলনা নাই। জানুয়ারি মাসে ব্যাপারটা ঘটিয়াছিল, এখন এপ্রিলের শেষাশেষি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তুলকালাম চলিতেছে। লােকে এই ছিনতাইয়ের কাহিনী ভুলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু লােকে ভুলিলে কী হয়, পাকিস্তান তাে । ভােলে নাই। ওই ঘটনার নােড়া দিয়াই সে ভারতবর্ষের দাঁতের গােড়া ভাঙিবার ব্যবস্থা করিয়াছে। এত আবেদন-নিবেদনে, এত চিঠি-চাপাটিতে যে কাজ হয় নাই, হঠাৎ দেখি সে কাজই জঙ্গীশাহী করিয়া বসিল। প্রায় ভুলিয়া আসা সেই ফার ফ্রেন্ডশিপ ছিনতাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে একটা তদন্তের নির্দেশ দিয়া বসিল। তাহাও আবার বিচার-বিভাগীয় তদন্ত । পাকিস্তানকে যাহারা চেনেনা তাহারা ভাবিল, ইসলামাবাদের বুঝি বা সুমতি হইয়াছে; যাহারা চেনে তাহারা বুঝিল, এটা বিভ্রান্তিসৃষ্টির অপপ্রয়াস।
কিন্তু সে অপপ্রয়াস যে সিন্ধুর । জল টানিয়া আনিয়া যমুনায় ফেলিবে এতটা কে ভাবিতে পারিয়াছিল? | এই তদন্ত-কমিশনের রিপাের্টে বলা হইয়াছে, বিমান ছিনতাইয়ের ব্যাপারটা নাকি সাজানাে। বিমান ছিনতাই কেহ করে নাই- দুই ভারতীয় চর তাহার ভান করিয়াছিল মাত্র। তাহাদের হাতে বন্দুকও ছিল না, ‘গ্রেনেড়ও ছিল না। ছিল একটা খেলনার বন্দুক । আর একটা জাল ‘গ্রেনেড’। ওই মিথ্যা ভয় দেখাইয়া। বিমানটাকে লাহােরে আনিয়া ধ্বংস করিয়া ফেলা হইয়াছিল যাহাতে এ উপমহাদেশে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং পাকিস্তানের দুই দেশের মধ্যে আকাশ পথে যােগসূত্র ছিন্ন করিয়া দেওয়ার একটা অছিলা পাওয়া যায়। কল্পনার এমন দৌড়ের কোনও নজির আরব্য-উপন্যাসের বাহিরে কোথাও আছে কিনা জানি না। কিন্তু চোস্ত । মিথ্যা বলিবার জন্য কোনও নােবেল-পুরস্কার থাকিলে সেটা এখনই ওই পাকিস্তানী প্রতিবেদনের রচয়িতাকে। দেওয়া উচিত। অম্লানমুখে এমন নির্জলা মিথ্যা কেহ যে বলিতে পারে শুধু নয়, সরকারি রিপাের্টে লিখিতে। পারে সে কথা ইতিপূর্বে কখনও কেহ ভাবিতে পারে নাই। ইসলামাবাদ আরও এক কাঠি উপরে গিয়াছে যে। দুই বিমান দস্যু ফক্কার ফ্রেন্ডশিপ লাহােরে ছিনতাই করিয়া লইয়া গিয়া উড়াইয়া দিয়াছে তাহাদের গ্রেপ্তার করিয়া জেলে পুরিয়াছে।
এ সংসার যে ধোকার টাটি- পাকিস্তান সে কথাই দুনিয়ার লােককে মনে করাইয়া দিতেছে। তবে। সেখানকার জঙ্গীশাহী যে মনে করিয়াছে লােকের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল কায়দা করিয়া যে যাহা বলিবে। লােকে তাহা বিনাবিচারে বিশ্বাস করিয়া লইবে তেমন তাে আর হইতে পারে না। বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি যদি ভারতবর্ষই সাজাইয়া থাকে তাহা হইলে সঙ্গে সঙ্গে নয়াদিল্লির মুখােশ ইসলামাবাদ খুলিয়া দেয় নাই। কেন? তেমন করিলে তাে সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষের কীর্তি জাহির হইয়া যাইত। আর বিমানচালক না হয় ভান । করিতেছিল কিন্তু লাহাের বিমানবন্দরে পাকিস্তানী বীরপুঙ্গবেরাই কেন ঠকিয়া গেল? কেন তাহারা ভারতবর্ষের ফাদে পা দিল? আর বিমান দস্যুদের হাতে যদি গ্রেনেডই না থাকে তাহা হইলে বিমানটা তাহারা উড়াইয়া দিল কী জাদুবলে? আর দুই ধাপ্পাবাজ ভারতীয়কে মাথায় লইয়া পাকিস্তান এত নাচিলই বা কেন আর তাহাদের জামাই আদরে এতদিন পুষিলই বা কেন? পাকিস্তান ভুলিয়া গিয়াছে মিথ্যা মামলা সাজানাের দায় অনেক। উদ্ভট কল্পনার ফানুস উড়াইয়া কিছু অবােধ লােককে হকচকাইয়া দেওয়া হয়তাে যায়, কিন্তু জলজ্যান্ত মিথ্যাকে তাে আর সত্য বলিয়া চালানাে যায় না।
২৩ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা