You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তানের ভরাডুবি - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানের ভরাডুবি

দুর্বুদ্ধির বশে বাংলাদেশের উপর হিংস্র আক্রমণ চালাইয়া ইয়াহিয়া খা বাঙালীদের গাের দেওয়ার জন্য যে কবর খুঁড়িয়াছিলেন তাহাতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকেই না মাটি দিতে হয়। তাহার অঙ্গচ্ছেদ তাে ইতিমধ্যেই হইয়া গিয়াছে। জঙ্গীশাহী হাজার চেষ্টা করিলেও সে কাটা শরীর আর জোড়া লাগাইতে পারিবে না। কিন্তু যে অংশটুকু তাহার একান্ত নিজস্ব সেটুকুও সে ফৌজী দাওয়াই প্রয়ােগ করিয়া বাঁচাইয়া রাখিতে পারিবে, এমন ভরসাও কম রক্ত শুধু পূর্বেই ঝরে নাই, ঝরিয়াছে পশ্চিমেও। আসলে অবশ্য সে রক্ত পূর্বেরই, নিজের দেহে তাহা সঞ্চারিত করিয়াই পশ্চিম শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে। নিয়তির এমনই পরিহাস, পূর্ববঙ্গের বুক চিরিয়া সে রক্ত পান করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের এত তেজ সেই আর্থিক রক্তই তাহাকে ঢালিতে হইতেছে বাংলাদেশকে শায়েস্তা করিবার জন্য। পূর্ববঙ্গের পাট ও চা বেচিয়া যে বৈদেশিক মুদ্রা সে উপার্জন করিয়াছে, সেটা ভােগে লাগিয়াছে পশ্চিমের। পূর্বাঞ্চলকে দেখাইয়া বৈষয়িক সাহায্য আদায় করিয়া কাজে লাগাইয়াছে পশ্চিম এলাকার। বাংলাদেশে নরমেধযজ্ঞের উপাচার সংগ্রহ করিতে বাঙালীদেরই রক্তজল-করা পাট-চা-বেচার টাকা লাগানাে হইতেছে। লক্ষ লক্ষ প্রাণ সে যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হইয়াছে বটে, কিন্তু খােদ পাকিস্তানই তাে মরিতে বসিয়াছে।

ইয়াহিয়া খাঁর তহবিলে এত অর্থ নাই যে, তিনি প্রত্যহ এক কোটি টাকা খরচ করিয়া তাহার নিষ্ঠুর খেয়াল চরিতার্থ করেন। তাহার উপর ক্ষয়ক্ষতি পূরণের উপায়ও তাে তাঁহার নাই। যে রাজহাঁস সােনার ডিম পাড়িত তাহাকেই তাে প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছেন। আর পশ্চিমপাকিস্তানের পক্ষে সে হাঁস তাে মরারই শামিল-বাঁচিয়া থাকিতে সােনার ডিম তাে আর সে পশ্চিম-পাকিস্তানের হাতে তুলিয়া দিবে না। ইয়াহিয়া খাঁ যখন চোরের মতাে রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়া ঢাকা ছাড়িয়া পালাইয়া যান তখন পাকিস্তানের তহবিলে মজুত বিদেশি মুদ্রা ছিল মাত্র ৮ কোটি ২০ লক্ষ ডলার। এই কয় দিনেই তাহার মধ্যে দুই কোটি ডলারের উপর পদ্মার জলে ঢালিয়াছে জঙ্গীশাহী। তবুও সে হালে পানি পাইতেছে না। সেন্টার বন্ধুরা কিঞ্চিৎ, অস্ত্রশস্ত্র অবশ্য যােগাইয়াছে, কিন্তু তাহাতে কতদিন চলিবে? বসিয়া খাইলে কুবেরের ভাণ্ডারও শূন্য হইয়া যায় পাকিস্তানের পুঁজি তাে সামান্য। নগদ টাকার অভাবে ধার সে করিবে পাকিস্তানের সে গুড়েও বালি। দেউলিয়াকে আর কে ধার দিতে যাইবে, কেনই বা দিবে? যাহারা এতকাল পাকিস্তানকে আদরযত্ন করিয়া এমন বাড়াইয়াছে ইচ্ছা থাকিলে তাহাদেরও তাে পাকিস্তানের আবদার মেটানাে কঠিন। বৃহৎ শক্তিদের মধ্যে যেই পাকিস্তানের বায়না মানিয়া লইতে চাহিবে তাহারই দেশে প্রবল আপত্তি উঠিবে। সাধ করিয়া ঝামেলা কে ডাকিয়া আনিবে?

যাহার শূন্য তহবিল তাহার পক্ষে নগদ কড়ি দিয়া সামরিক সরঞ্জাম কেনা যেমন অসম্ভব, তেমনই অসম্ভব বিদেশ হইতে প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল কিংবা অন্যান্য উৎপাদনের আনুষঙ্গিক বস্তু কেনা। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সহমরণে যাইতে চলিয়াছে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পও। বিদেশ হইতে কোনও কিছুই আমদানি করা যাইতেছে না। একে একে মিত্রের দলও হাত গুটাইতেছে। আরও দিন কতক এমনভাবে চলিলে পাকিস্তানের দুর্দশার চরম হইবে। বেকারি এমনিতেই ভয়াবহ। কলকারখানা, কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের অভাবে যদি বন্ধ হইয়া যায় তাহা হইলে পশ্চিম পাকিস্তানে তাে হাহাকার পড়িয়া যাইবে। বিদেশ হইতে পাকিস্তানে যে বৈষয়িক সাহায্য আসে- এক চীন হইতে যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকু হয়তাে মিলিবে, কিন্তু অন্যেরা আপাতত সাহায্য দান স্থগিত রাখিয়াছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান সকলেই বাংলাদেশের রণাঙ্গনের দিকে তাকাইয়া আছে সেখানে একটা ফয়সালা না হইলে দান খয়রাত আবার শুরু করিবে না, এমন একটা ভাবও তাহারা দেখাইতেছে। এমন কী আত্রাণের জন্য যে টাকা জাপান বরাদ্দ করিয়াছিল তাহাও দিতে সে দেশ নারাজ। বিশ্বব্যাঙ্কও বিশেষ প্রসন্ন নয়। পাকিস্তানকে বৈষয়িক সাহায্য যে সব দেশ দেয় তাহাদের বৈঠক প্যারিসে হইবে বটে, কিন্তু পাকিস্তানের সেখানে প্রবেশের অধিকার থাকিবে না। দেখা যাইতেছে ইয়াহিয়া নিজেও মজিয়াছেন, দেশকেও মজাইয়াছেন।

২১ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা