মানবতা বনাম দানবতা
ডেটলাইন মুজিবনগর। শনিবার বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী একটি স্থান সারা বিশ্বকে একটি সংবাদ জানাইয়া দিয়াছে ঃ সার্বভৌম একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম। জন্মলগ্নে সূতিকাতে রক্তাপুত নবজাতকের কণ্ঠে এই ঘােষণাও উচ্চারিত হইয়া উঠিয়াছে- “আমরা যুদ্ধরত ।” সেই ঘােষণায় আম্রকুঞ্জ প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। বৈশাখের বাতাসে পতপত করিয়া উড়িয়াছে স্বাধীন একটি জাতির ত্রিবর্ণ নিশান। গােটা দুনিয়ার সমাগত সাংবাদিকেরা দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। | ঘটনাটা দিন কয়েক আগে ঘটিলে আবেগে আরও আপুত হওয়া যাইত। কিন্তু আজ ইহা একটি পবিত্র অনুষ্ঠান। নির্বান্ধব পৃথিবীতে একটি জাতির জন্ম আগেই হইয়াছে, রাষ্ট্রগঠন তাহার স্বাধীনতার অঙ্গীকারকে একটি আকার আর আধার দিতেছে ঘটনাটির গুরুত্ব এইখানে। ইহার মূল্য-প্রচারের প্রয়ােজনে- হয়তাে বা স্বীকৃতি আদায়ের উপায় হিসাবেও। কতদূর ফল মিলিবে? একটি জাতি উন্মাদনা-উদ্দীপনা ফিরিয়া পাইবে সত্য। কিন্তু উন্মত্ত দানবদের হাতে একটি মানবসমাজের সবৈৰ দলনেও সে বিশ্ব পাষাণের মতাে স্থির, স্থবির, নিশ্চল ও নিন্দুপ হইয়া আছে কেবল একটি অনুষ্ঠানেই কি তাহার মন টলিবে; অসাড় অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সাড়া জাগিবে? বলা শক্ত। কেননা সত্যের খাতিরে আজ এ কথা বলিতেই হয়, পরিস্থিতি আজ ঘােষণার পর্যায়, স্বীকৃতির স্তর পার হইয়া এক নিরুপায় হা-হা প্রান্তরে দাঁড়াইয়া কাঁপিতেছে। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ, ধরিয়া মুক্তিকামী যােদ্ধারা যতদূর সম্ভব যুঝিয়াছেন। অকাতরে প্রাণ ঢালিয়া দিয়া যতটুকু কাড়িয়া আনার, ততটুকু তাহারা আনিয়াছিলেন এবং পবিত্রশিখার মত সন্তর্পণে বাঁচাইয়াও রাখিতে চাহিয়াছেন। কিন্তু এ এক অসম অসম্ভব লড়াই, এ এক দুঃসাধ্য ব্রত। ইতিহাসের কঠিনতম তপশ্চর্য। শুধু সাহস, শুধু প্রতিজ্ঞা দিয়া এই জান্তব যুগে চূড়ান্ত জয় লাভ করা যায় না- সত্য-ক্রেতাতেও যাইত কিনা সন্দেহ।
বাঘের চোখে চোখে চাহিলেই সে আর ঘাড় মটকায় না, এসব গাল গল্প এবং বিশ্বাসের মহিমা অলীক উপকথাতেই মানায়। বাস্তব অভিজ্ঞতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলাদা কথা বলে যে, নিরস্ত্র সাহসী মানুষকে বাঘ বাগে পাইলে হিংস্র নখে আর ধারালাে দাঁতে ছিড়িয়া ফেলে। সুতরাং শুধু সাহসকে শুধু হাততালি দিয়া দূর হইতে বলিহারি বলিয়া আর কাজ নাই। ওটা আমাদের কাপুরুষতা, ওটা আমাদের ক্লীব প্রণয়নিবেদনেরই প্রমাণ। এক হিসাবী বিচার, একদিকে এখন চুল চিরিয়া চিরিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দোষ খুঁজিতেছে। অন্য দিকে এক “সম্মত” বিশ্বসমাজ সব জানিয়া শুনিয়াও চোরের মত চুপ রহিয়াছে। অথচ হিসাবটা সােজা। স্বভাবে, চরিত্রে, ভাষায়, ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ আলাদা দুইটি জাতিকে এক জোয়ালে শুধু ধর্মের ছুতায় একদিন বাধা হইয়াছিল। তাহার মধ্যে একটি আজ মাথা চাড়া দিতে চায় বলিয়া তাহার সেই মাথা ভাঙিয়া দেওয়া হইতেছে। ভাঙিয়া দিতেছে যে, অন্য জাতিটিরও জনপ্রতিনিধিত্ব করার নৈতিক দাবী তাহার নাই । স্বয়ং ভুট্টো নাকি এখন জঙ্গীশাহীর রকমসকম দেখিয়া প্রমাদ গণিতেছেন, ভুট্টো সাহেব নিজেও স্বখ্যত সলিলে ডুবিতেছেন। গণতন্ত্রবিরােধী এক জোরজুলুমের জমানা গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিদের বিচার করিবে বলিয়া শাসায়, হাতে মাথা কাটে। এই অধিকার কে দিয়াছে জানি না। এইটুকু জানি যে তাবৎ দুনিয়া নির্বাক নিস্পলক চাহিয়া আছে।
এই দুনিয়ার বাঘা বাঘা সব দেশই নাকি গণতন্ত্রী। ইয়াহিয়াকে সকলেই তােয়াজ করে কেন, কীসের ভয়ে পাকিস্তান নামক আজব দেশটি দুই টুকরা হইলে কাহাদের স্বার্থহানি? কই ভারত ভাগের সময় তো এই ব্যাকুলতা দেখা যায় নাই। | সেদিন সংস্কৃতিকে, ভৌগলিক সত্যকে জবাই করা হইয়াছিল কেবল রাজনীতি আর ধর্মের দোহাই দিয়া। আজ কোথায় গেল ধর্ম, দেখা গেল যে সংস্কৃতি অবিভাজ্য, ওই জিনিসটাই মানুষকে মানুষ রাখে। ধর্ম বড় হইলে পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলি বাংলার মুসলিম-উৎসাদনে নির্বাক থাকিত না। অথবা তাহাদের চোখে বাংলার মুসলমানেরা বুঝি মুসলমান নহেন, পশ্চিম পাকিস্তানীরাই বেশি সাচ্চা মুসলমান? আজ দলে দলে শরণার্থীর যে ঢেউ ভারতের সীমান্তে শতধা হইয়া আছড়াইয়া পড়িতেছে তাহার মধ্যে কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বিভেদ নাই, সর্বনাশের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। দিল্লির হয়তাে এতটা দুরদৃষ্টি নাই যে, ভবিষ্যণ্টা দেখিতে পাইবে। নাই যদি পায়, তবে এত আশ্বস, এত ব্ৰাগাড়ম্বরের কোনও দরকার ছিল না। একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের কামনা লইয়া ছিনিমিনি খেলার অধিকার তাহাকে কেহ দেয় নাই। সময় বহিয়া যাইতেছে, তাহার তটে তটে রক্তস্রোতের ছােপ। একটি জালিয়ানওয়ালাবাগ, একটি হিজলি ভাঙাইয়া আমরা খাই, বাংলাদেশ আজ শত শত জালিয়ানওয়ালাবাগে ছাইয়া গিয়াছে, শত শত জনপদ শুধু ভস্মশেষ। কোনও তাতার, কোনও তৈমুর এত রক্তে মাটি ভিজায় নাই, ইয়াহিয়ার ব্রাডহাউন্ড বাহিনী যাহা করিয়াছে। বাংলাদেশের অপরাধ কী? বিচ্ছিন্নতা কামনার দায়ে যাহারা তাহাকে সােপার্দ করিতে চায় তাহারা মিথ্যা কথা বলে।
পূর্ববঙ্গ আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্মগত অধিকার চাহিয়াছিল এই তাে? শঠ ইয়াহিয়া তাহাকে ঠকাইয়া এক বধ্যভূমির দিকে ঠেলিয়া লইয়া গিয়াছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির অপরাধ এতটা নরমধ? দাবিটা যদি বিচ্ছেদেরও হয়, তবু বন্টন এলাকার মার্কিনেরা মুখ ফুটিয়া বলুক তাহারাও একদিন একই অপরাধ করিয়াছিল কি-না? ইংরাজ-রাজের সঙ্গে তাহাদের তবু ভাষাটা এক ছিল। এই যুদ্ধের পরিণাম যাহাই হউক, একটা বিষয় ঠিক- দেড় হাজার মাইল দূরে দূরে দুই পা বিস্তার করিয়া পাকিস্তানরূপী কলােসাস যে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রটি আর আস্ত থাকিবে না। ফ্রান্স ও দীর্ঘকাল আলজেরিয়াকে তাহার অচ্ছেদ্য অংশ বলিয়া ভুলাইয়া রাখিতে চাহিয়াছিল- পারে নাই। ইয়াহিয়া বাহিনীও পূর্বদেশে, স্রেফ দখলদার ফৌজ বৈ কিছু তাে নয়। এত নিধন-উৎসাদনের পরে বাংলাদেশকে আজ শরিক বলায় মুখ তাহার রহিল না। থাকুক আমাদের ভাবনা ভারতকে লইয়া। প্রতিবেশী বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটিলে তাহার অর্থনীতি, তাহার সামাজিক ভারসাম্য, তাহার কূটনীতি এবং রাষ্ট্রনৈতিক নিরাপত্তা অটুট থাকিবে তাে? বাংলাদেশের সৈনিকেরা সেই হিসাবে আমাদের সংগ্রামও লড়িতেছেন। ফিরিবার পথ নাই, এ লড়াই একদিকে যেমন মানবতা বনাম দানবতার, অন্য দিকে তেমনই, নিছক জাতিগত স্বার্থের বিচারেও আমাদের বাঁচার লড়াই। নবজাতকের জন্ম হইয়াছে। এখন প্রয়ােজন সুনিপুণা এবং মমতাময়ী ধাত্রীর।
১৮ এপ্রিল ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা