You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.11 | লড়াইকে ছড়াইয়া দেওয়ার ইঙ্গিত - সংগ্রামের নোটবুক

লড়াইকে ছড়াইয়া দেওয়ার ইঙ্গিত

যা, পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের ঘটনা যে পাকিস্তানের ‘ঘরােয়া ব্যাপার, নিজের এই অপপ্রচারটা পাকিস্তান। নিজেই মিথ্যা প্রমাণ করিয়া দিল। ‘ঘরােয়া’ হইলে বাহিরে প্রতিবেশী দেশের আকাশে আর আঙিনায় উন্মত্ত ইয়াহিয়া গােলামদের গােলাগুলি আসিয়া পড়িত না। সে নিজেই ইচ্ছা করিয়া এদেশকে জড়াইতে চাহে, জড়াইতেছে। ওদিকে কাশ্মীরেও নাকি নূতন করিয়া হাঙ্গামা বাধানাের ফন্দিতে পাকিস্তান তা দিয়া চলিয়াছে। তাজ্জব ব্যাপার বটে। কতখানি শক্তি ধরে ইসলামাবাদের শাসকগােষ্ঠী, যে অগণীত স্বধর্মী মানুষকে হত্যা। করিয়াও তাহাদের রক্তলালসা মেটেনা? পূর্ববঙ্গের এক শক্তিক্ষয়ী লড়াইয়ে যে জড়াইয়া পড়িয়াছে, সে একই সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকেও চ্যালেঞ্জ করিতে চায়? জানি না এই স্পর্ধার উৎস কোথায়, এই দুঃসাহসের রসদ। কাহারা জোগাইতেছে। জোগানদারদের সনাক্ত করা কঠিন নয়, তাহাদের আমরা চিনি- আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া। পিছনে নখদন্তহীন ইংরাজ। বৃহৎ শক্তিগুলির আদরে বিনষ্ট, মদতে মত্ত, আচারদ্ৰষ্ট পাক জঙ্গীশাহীর আচরণ আজ অবিকল সুরাপানে উন্মত্ত দানবের ন্যায়- মানবতাকে সে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায়, ধরাকে করে সরা জ্ঞান। আর কী আশ্চর্য, প্রশ্রয়দাতা, অস্ত্রদাতা মুরুব্বী মােড়লেরা- কেহ গণতন্ত্রী, কেহ সমাজতন্ত্রীবিবেককে বিলকুল বরখাস্ত করিয়া ন্যাকা সাজিয়া বসিয়া আছে। উহারা শক্তিমান, উহারা দূরের দর্শক, সব চোখ বুজিয়া বরখাস্ত করা উহাদের সাজে। ‘অন্যায় সহা’ নামক পাপের বিচার? সে প্রায়শ্চিত্তের দিনও আসিবে। তবে কিছু পরে। কিন্তু অন্যেরা? অন্যায় যে সহে এমন কী সহায়তাও করে, ভারতের পক্ষে সেই রকম সহিষ্ণু দর্শক থাকা অসম্ভব। কেননা ভারত দূরের দেশ নয়।

অতীতের যােগসূত্রের কথা স্মরণ রাখিয়াও- আজ ওই দেশ নরমেধযজ্ঞে যাহারা আহুতি হইলেন, তেইশ বছর আগেও তাহারা ছিলেন আমাদেরই জ্ঞাতি ও স্বজাতি- ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবিয়া ভারতকে তাহার বর্তমান কর্তব্য স্থির করিতে হইবে। এই কর্তব্য আদর্শগত; এই কর্তব্য বাস্তব। একই সঙ্গে দুইটা। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যে দেশ লড়াই। করিয়াছে, স্বাধীনতাকে জন্মগত অধিকার বলিয়া ঘােষণা করিয়াছে, গণতন্ত্র যাহার বিশ্বাস নিঃশ্বাসের মতাে মিশিয়া আছে, বাংলাদেশের এই অভুত্থানের মুহূর্তে সে দেশের মূক বধিরের ভূমিকা? না সে প্রশ্নই ওঠে। না। প্রতিবেশী সিংহলে নির্বাচিত সরকারের সাহায্যে যাহারা আগাইয়া গিয়াছে, আর-একটি দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উৎখাত করার চক্রান্তে চুপ করিয়া থাকা তাহার পক্ষে নীতিহীনতা। আদর্শের হত্যাকাণ্ডে সায় দেওয়ার সামিল। এক কথায় পাপ। | না হয় আদর্শও পরে। বাস্তব পরিস্থিতিও এই সত্যতা উপস্থিত করিয়াছে যে, সীমান্তের ওপারে যে আগুন। জ্বলিয়াছে তাহার আঁচ এপারেও লাগিবে । ত্রিপুরা এবং দিনাজপুরে পাকফৌজের নিয়মলন তথা গােলাবর্ষণ সেই সত্যকে উচ্চঃস্বরে জানাইয়া দিল মাত্র। দিনকয়েক আগে অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ যখন জনরােষে। বিস্ফোরণের মতাে ফাটিয়া পড়ে তখনই বােঝা গিয়েছিল হন্যে হানাদারেরা কোন সীমাই মানিবে না। তাহাদের বিমানবহর আকাশে উড়িয়াছে, যেহেতু আকাশে মুজিব নাই, আর নিরস্ত্র মানুষদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালাইয়া দিতে দিতে এদেশের আকাশসীমা লজ্জন করিতেও তাহাদের বাধে নাই। দিল্লি যদিও তখন। ব্যাপারটাকে উড়াইয়া দেয়, তবু সঙ্গে সঙ্গে এই নির্দেশও দিয়াছিল যে, বাড়াবাড়ি ঘটিলে অনুপ্রবেশকারীদের। যেন তাড়া করা হয়, দরকার হইলে বিমান ভূপাতিত করিতে হইবে।

আকাশের নির্দেশ কি মাটিতে খাটিবে। না? নহিলে পাকফৌজ এপারেও বিনা বাধায় গুলি চালাইয়া গেল কী করিয়া? পাকিস্তানের হঠকারিতার এইখানেই শেষ নয়। নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তিকে কাঁচকলা দেখাইয়া সে ভারতের সীমান্তে ফৌজ মােতায়েন করিতেছে । লড়াইএর প্রথম চোটে যে বীরপুত্রেরা চম্পট দিয়াছিল তাহারা আবার। ফিরিয়া আসিয়াছে। সীমান্তের দিকে গুটি গুটি আগাইয়া আসিতেছে যে পাকিস্তান, সেই পাকিস্তানই আবার। দুনিয়ার হাটে- সুবিধা করিতে পারুক, চাই না পারুক- ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নাকী সুরে নালিশ জানাইতেছে। অথচ ১৯৬৫ সনের ইতিহাস সাক্ষী সেদিন ভারত কিন্তু শত প্ররােচনাতেও পূর্ববঙ্গের দিকে। হাত বাড়ায় নাই। সেদিন যাহা ঘটে নাই, আজ যদি তাহা ঘটে তবে বুঝিতে হইবে, ইয়াহিয়া চক্রই। সম্পূর্ণরূপে দায়ী। তাহারাই ভারতের হস্তক্ষেপ অনিবার্য করিয়া তুলিতেছে। বেগতিক দেখিয়া প্রতিরােধ  সংগ্রামের স্বরূপ সমঝাইয়া- পিণ্ডির জঙ্গীশাহী হয়তাে যাহাকে বলে “এসকালেট”, অর্থাৎ লড়াইটাকে ছড়াইয়া দিতে চায় সীমান্তের প্ররােচনা তাহারই ইঙ্গিত।

১১ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা