You dont have javascript enabled! Please enable it!

অমানুষিক ছলনা

খঞ্জ একটি মানুষ পথিপার্শ্বে বসিয়া বিলাপ করিতেছে, এই দৃশ্য দেখিয়া অশ্বারােহী এক পথিকের মনে করুণার সঞ্চার হইয়াছিল, এবং নিজে পথে নামিয়া খঞ্জকে তিনি অশ্বপৃষ্ঠে তুলিয়া দিয়াছিলেন । পরমুহূর্তেই অবাক কাণ্ড। দয়ালু পথিক দেখিলেন, খঞ্জ তাহার অশ্ব লইয়া সরিয়া পড়িতেছে। তাহার খঞ্জতা আসলে ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়, এবং কান্নাও আসলে মায়াকান্না, অন্যকে ঠকাইবার একটা কৌশল মাত্র । যাওয়ার আগে পথিককে সে কিছু বিদ্রুপও করিয়া গিয়াছিল। উত্তরে সেই দয়ালু পথিক বলিয়াছিলেন, “আর যাহাই করাে, উপকারীকে ধোকা দিয়া কী ভাবে এই অশ্বটি তুমি চুরি করিয়াছ, জাক করিয়া কাহাকেও তাহা বলিও না। কেননা এই ঘটনার কথা যদি একবার রাষ্ট্র হইয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে হয়তাে কোন সত্যকার খঞ্জকেও কেহ দয়া করিতে সাহসী হইবে না।” সন্দেহ নাই যে, মার্চের শেষ দিকে ঢাকায় যাহা ঘটিয়াছিল, তাহারও মধ্যে। গল্পের বর্ণিত এই একই খলতা আর ছলনার ঘটনার পুনরাবৃত্তিই সকলের চোখে পড়িয়াছে। | গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জঙ্গী শাসকের চোখ হইতে যে কান্না ঝরিয়াছিল, বস্তুত তাহাও মুক্তিকামী মানুষদের ধোঁকা দিবার একটা অমানুষিক কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। একদিকে যখন আলােচনার বৈঠক সাজানাে হইয়াছে, অন্য দিকে তখন তাহারই আড়ালে আমদানি করা হইয়াছে সৈন্যদল; খলতা এ ক্ষেত্রে এতই প্রকট যে, আলােচনা নামক ব্যাপারটা সম্পর্কেই মানুষের মনে অতঃপর যদি সন্দেহ দেখা দেয়, তবে তাহাতেও সম্ভবত বিস্ময়ের কিছু নাই। জঙ্গী-চক্রের খলতার পরিচয় পরিস্ফুট হইয়াছে শ্রীহট্টের ঘটনার মধ্যেও। সংবাদে প্রকাশ, নিরুপায় একদল নারীকে সম্মুখে রাখিয়া দখলদার পাক বাহিনী সেখানে কামান দাগিতে দাগিতে শহরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়ে। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, মুক্তিসেনারা যে তাহাদের কার্যকরভাবে বাধা দিতে পারেন নাই, তাহার কারণ, বাধা দিতে গেলে, নিরুপায় সেই নারীদের মৃত্যুও অনিবার্য হইয়া দাড়াইবে। ছলনা ছিল, শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়া যুদ্ধ করার মধ্যেও। কিন্তু সন্দেহ নাই যে, বিশশতকীর এই ছলনার ঘটনা সব ছলনাকেই টেক্কা দিয়াছে । শিখন্ডীকে তাে তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজে লাগানাে হয় নাই; পাক হানাদারেরা সে-ক্ষেত্রে অসহায় একদল নারীকে তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছলনার কাজে ব্যবহার করিয়াছে। 

প্রণয়ে আর রণে সব কৌশলই ব্যবহার্য? ওই কথাটার কথা, একেবারে আক্ষরিক অর্থে ওই উক্তিটিকে গ্রহণ করা চলে না। তা যদি হয়, তবে মনুষ্যত্বের ভিতই একেবারে ধসিয়া পড়ে। যেমন খেলায়, তেমিন যুদ্ধেরও কতগুলি নিয়ম থাকে বইকী, মানুষকে সেই নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়। কিন্তু এ-সব কথাই বা বলা কেন? বুদ্ধিজীবীদের যাহারা পাইকারী ভাবে হত্যা করিয়াছে, এবং নারীর সম্মান ও শিশুর প্রাণকেও যাহারা রেহাই দেয় নাই, সেই পাক হানাদারেরা। কতটা মানুষ কিংবা আদৌ মানুষ কি? আগে এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার। মনুষ্যেচিত আচরণ। তাহাদের কাছে প্রত্যাশা করা চলে কিনা, সে প্রশ্ন পরে ।

নাদির-শাহ

পথভােলা পথিক প্রশ্ন করিয়াছিল- আমায় চেন কি? সন্ধ্যাবেলার চামেলী এবং সকালবেলার মল্লিকা সেই প্রশ্নে । সাড়া দিয়া বলিয়াছিল- চিনি। বনে বনে রঙিন বসনের প্রান্তটি উড়াইয়া যে নবীন পান্থ ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহাকে চিনিয়া ছিল সকাল ও সন্ধ্যার ফুল । নিসর্গের বক্ষে যে প্রীতি সঞ্চিত আছে, ঋতুরঙ্গে যাহা লীলায়িত হইয়া নূতন সৃষ্টি সম্ভব করে, যাহার আবেদনে প্রাণ রূপায়িত এবং রূপ প্রাণায়িত হয়, তাহারই তত্ত্ব কবির। উক্তিতে পথভােলা পথিকের এবং চামেলী-মল্লিকার সংলাপ হইয়া গুঞ্জরিত হইয়াছে। আমায় চেন কি? জিজ্ঞাসাটিকে জীবনের এক শান্ত স্নিগ্ধ ও কম রহস্যের জিজ্ঞাসা বলিয়া মনে করিতে হয়। এই জিজ্ঞাসাকে শুনিতে সকলেরই ভাল লাগিবে। কারণ, রূপের ও প্রাণের শােভা নূতন করিয়া সৃষ্টি করে যে রহস্য, তাহাকে জানিতে ও বুঝিতে কাহার না ইচ্ছা করে? কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে রাজনীতিক মসনদের কাছে দাঁড়াইয়া প্রবল প্রতাপের কোন মূর্তিধর যদি এইরূপ প্রশ্ন। করে, তবে শ্রোতা মানুষ নিশ্চয় চমকাইয়া উঠিবে, ঘরে বসিয়া কোন বন্যপ্রাণীর হঠাৎ চিৎকার শুনিলে যেমন চমকাইয়া উঠিতে হয়। ইতিহাসের কাহিনী আজিও স্মরণ করাইয়া দেয়, বলদৃপ্ত অনেক দিগ্বিজয়ী একদিন। এইরূপ প্রশ্ন করিয়াছিলেন- আমায় চেন কি? কেহ বলিয়াছিলেন, আমি হারকিউলিসের বংশধর। কেহ । বলিয়াছিলেন, আমি সূর্যের জ্যেষ্ঠপুত্র । আলেকজাণ্ডার একবার বলিয়াই ফেলিয়াছিলেন- আমিই ভগবান। তিনি এমন একজন দার্শনিককে খুঁজিয়া পাইতে চাহিয়াছিলেন, যিনি যুক্তি ও তথ্যের দ্বারা প্রমাণিত করিয়া দিবেন যে আলেকজান্ডারই ভগবান।। | সেদিনের মানুষ ওই সব নিদারুণ প্রতাপীদিগের জিজ্ঞাসা শুনিয়া ভয় পাইয়াছিল। আজিকার মানুষ কিন্তু হাসিয়া পারিবে না।

তাহাছাড়া, আজ কেহ যদি তাহার আত্মপরিচয়ের ওই রকম কোন প্রচণ্ড বংশতত্ত্ব। প্রচার করিয়া তাহার মাংসপেশী উত্তেজিত করে, তবে লােকে আরও বেশি হাসিবে। গিরগিটি ও কৃকলাস যদি আজ দর্প করিয়া বলে, তাহারা সেই বিরাটকায় ডাইনােসরের বংশধর, তবে সে সত্য কথাই বলিবে। কিন্তু শ্রোতা তাহা শুনিয়া বেশ কৌতুকও অনুভব করিবে। বুনাে কলাগাছের ঝােপ যদি বলে আমায় চেন কি, আমি আদিম যুগের সেই বিপুলকায় ফার্নের বংশধর, তবে নিশ্চয় পাশের কচুগাছের ঝােপও হাসিয়া কুটি কুটি হইবে। কংসরাজার বংশধর বলিয়া গর্ব করিবার মানুষ কেহ আছে বলিয়া মনে হয়না । শুধু ব্যঙ্গ-কবিতায় এ ধরনের আত্মপরিচয় ব্যক্ত করিবার অদ্ভুত মানুষটিকে পাওয়া যাইবে। বিস্ময়ের বিষয়, ব্যঙ্গ কবিতায় নহে, রাজনীতিক ক্ষমতার মসনদের কাছে দাঁড়াইয়া সত্যই একজন আধুনিক ব্যক্তি এই মর্মের বংশগর্বের কথা বলিয়াছেন। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁ তাহার এক বিবৃতিতে বিশ্ববাসীকে জানাইয়াছেন যে, তিনি হইলেন নাদির শাহের বংশধর। সেই নাদির যাহার নাম হইল ইতিহাসের একটি বীভৎস শােনিত্যক্ত ঘটনার নির্মম নায়কের নাম। নাদিরের ইচ্ছায় ও নির্দেশে তাহার সৈনিকেরা ছয় ঘণ্টার মধ্যে দিল্লির দশহাজার নিরীহ নাগরিককে হত্যা করিয়াছিল। | ইয়াহিয়া খাঁ কিন্তু বিনয় করিয়া বলিয়াছিলেন যে, নাদির ঐতিহ্যের কথা বলিলে ইহা বলিতে হয় যে, তিনি নাদিরের একজন কৃতী বংশধর । কারণ, দিল্লিকে আক্রমণ করিবার বাসনা তাহার নাই । বিশ্ববাসী কিন্তু সম্প্রতি বুঝিয়া ফেলিয়াছে যে, ইয়াহিয়া খাঁ বিনয় করিয়া বস্তুত মিথ্যা কথাই বলিয়াছেন। ইয়াহিয়া সত্যই  নাদিরের একজন কৃতী বংশধর। পার্থক্য শুধু এই যে, দিল্লি নহে, তিনি ঢাকাতে, বাংলাদেশের নরহত্যার। শােনিত স্রোত বহাইয়াছেন।

১৪ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!