You dont have javascript enabled! Please enable it!

মৃত্যু হইতে জীবনে

শেখ মুজিবর রহমানের বাংলাদেশে এক দিকে পাক জঙ্গীশাহির যে অমানুষিক অত্যাচার ও অন্যদিকে মুক্তিসেনাদের যে অতুলনীয় প্রতিরােধ সংগ্রাম চলিতেছে, কলিকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় তাহার অনুপুঙ্খ বর্ণনা তে বাহির হইতেছেই, সেই সঙ্গে আলােকচিত্রও নিতান্ত কম বাহির হয় নাই। পাকিস্তানী ফৌজের কামানের গােলায় ধ্বস্ত গ্রামের ছবির সঙ্গে বাহির হইয়াছে পরিখার মধ্যে উদ্যত-রাইফেল-হস্তে অপেক্ষমাণ মুক্তিযােদ্ধাদের ছবি। পাক-বিমানের বােমায় বিধ্বস্ত টিনের চালাঘরের ছবির সঙ্গে দেখা গিয়াছে বৃক্ষের উপরে অতন্দ্র পাহারায় নিরত মুক্তিসেনার ছবি। পাঠক যেমন কুষ্টিয়ার খাঁ-খা নির্জন পথের ছবি দেখিয়াছেন, তেমনি আবার বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কুষ্টিয়া শহর দখল করিবার জন্য অগ্রসর হইতেছেন, এই ছবিও তাহার চোখে। পড়িয়াছে। কোনও ছবি দেখিয়া তিনি বিমর্ষ হইয়াছেন, কোনও ছবি দেখিয়া উৎফুল্ল। অত্যাচারের ছবি দেখিয়া যেমন তিনি শিহরিয়া উঠিয়াছেন, তেমনি সফল প্রতিরােধের ছবি দেখিয়া তাহার নিশ্চয় মনে হইয়াছে যে, চূড়ান্ত জয় মনুষ্যত্বেরই হইবে, দানবিকতার নয় । চূড়ান্ত জয় যে মনুষ্যত্বেরই হইবে, তাহার ইঙ্গিত আছে আরও একটি ছবির মধ্যে। ছবিটি একজন। 

মুক্তিসেনার। কাঁধে রাইফেল, যশােরের একটি পরিখার পাশে তিনি সযত্নে একটি চারাগাছ রােপণ করিতেছেন। পরিখার মধ্যে অন্ধকার ও পরিখার উপরে আলাে। সেই আলাের মধ্যে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছে একটি শিশুবৃক্ষ। চতুর্দিকে যখন গুলি গােলা আর বােমার তাণ্ডব আর ধ্বংসের হাহাকার, তখন তাহারই মধ্যে সেই শিশু বৃক্ষটি ধীরে-ধীরে বাড়িয়া উঠিবে, আলাে মাটি আর হাওয়া হইতে শুষিয়া লইবে তাহার প্রাণধারণের খাদ্য। চিত্রটি প্রতীকী, তাহাতে সন্দেহ নাই। দেখিয়া মনে হইবে, মৃত্যুর পরিবেশের মধ্যে। বসিয়াও ওই মুক্তিসেনা যেন মৃত্যুর দ্রুকুটিকে গ্রাহ্য করিতে চাহেন না। ধ্বংসের তাণ্ডবের মধ্যে বসিয়াও তিনি নূতন সৃষ্টির উপরে হাত রাখিয়াছেন। নিশ্চয় তিনি বিশ্বাস করেন যে, ধ্বংস নয়, সৃষ্টিই সত্য; বিশ্বাস করেন যে, মৃত্যুর ভস্মরাশির মধ্য হইতেই ওই শিশুবৃক্ষের মতাে মানুষের প্রাণ আবার মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে।  তা-ই দাড়ায়। প্রাণ তাে একেবারে বিনষ্ট হইয়া যায় না। সে হারাইয়া যায়, মিলাইয়া যায়, কিন্তু আবার ফিরিয়া-ফিরিয়াও আসে। নালন্দায় ধ্বংসস্তুপের মধ্যে যে গােধূমের দানা পাওয়া গিয়াছিল, সবাই ধরিয়া লইয়াছিল যে, তাহা মৃত। কিন্তু পুসার কৃষি-গবেষণা-সংস্থার চেষ্টায় কয়েক শত বৎসরের পুরানাে সেই দানা।  হইতেও আবার নূতন করিয়া অঙ্কুরােদ্দাম হইয়াছে, এবং তাহা হইতে আবার নূতন গাছ ও নূতন শস্যও মিলিয়াছে। ব্যক্তি-মানুষের না হউক, মানব-সংসারের প্রাণ যেন সেইরকমই দুর্জয়। সে কিছুদিনের জন্য সুপ্ত থাকে ঠিকই, কিন্তু লুপ্ত হইয়া যায় না, মৃত্যুর ভিতর হইতেও সে আবার মাথা তুলিয়া দাঁড়ায়। সেই বিচারে বলা যায়, বাংলাদেশের এক মুক্তিসেনার হাতে রােপিত ওই বৃক্ষটি যেন ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবহ এক প্রতীকী বৃক্ষ। ওই বৃক্ষই যেন বলিয়া দিতেছে, মৃত্যুই শেষ কথা নয়; জীবনপণ করিয়া যাহারা আজ মৃত্যুর পথে পা বাড়াইয়াছেন, বস্তুত মৃত্যুকেও জয় করিয়া তাহারা এক নবজীবনের ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হইবেন। তাহারা মৃত্যুঞ্জয়।

১২ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!