You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মহান বুদ্ধিজীবীরা - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মহান বুদ্ধিজীবীরা

ইয়াহিয়া খাঁর হাতে অগণিত নিরপরাধ মানুষের রক্ত। একালের দুনিয়ার অন্যতম ঘৃণ্য ঘাতক তিনি। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের ধারনা অতি সেয়ানা ঘাতক। হিটলারের মতােই তাঁহার হত্যালীলার পিছনে একটি সুস্পষ্ট চিন্তাধারা কাজ করিতেছে। এস-এস’দের মতাে তাঁহার জল্লাদদের পকেটেও রহিয়াছে খুনের এক নকশা। হিটলার তাহার শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করিয়াছিলেন দুইটি রাজনৈতিক দল, আর একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে।  তিন গােষ্ঠী হইতেই তাহার প্রথম শিকার বুদ্ধিজীবিগণ । ইয়াহিয়া খাও বাংলাদেশের অনেককেই খুন করিতে চাহেন। বিশেষত, আওয়ামী লীগের অনুরাগীদের এবং হিন্দুদের। কিন্তু সকলের আগে তিনি নিশ্চিহ্ন করিতে চাহেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের। ঢাকায়, রাজশাহীতে এবং পরে রংপুরে তাহার রক্তলােলুপ নেকড়ের দল প্রথমেই নাকি ঝাপাইয়া পড়ে অধ্যাপক, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক এবং চিকিৎসক, আইনজীবী প্রভৃতি বৃত্তিজীবীদের ওপর। দলে দলে তাহাদের ফায়ারিং স্কোয়াড-এর সামনে আনিয়া দাঁড় করানাে হইয়াছে। কারণ আর কিছুই নহে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি আত্মশূন্য করিতে চাহেন, অর্থাৎ মস্তিষ্কশূন্য। সন্দেহ নাই, ইয়াহিয়া খাঁর তাক নির্ভুল। “শত্রু”কে চিনিয়া লইতে তাহার দেরী হয় নাই । সক্রেটিসের আমল হইতেই দেখা গিয়াছে সব স্বৈরাচারী, সব হঠকারী শাসকগােষ্ঠী এ ব্যাপারে অতিশয় দক্ষ। হিটলার, স্ট্যালিন, ইয়াহিয়া খা- সকলেই সমান বিচক্ষণ। ফরাসী-বিপ্লবের পাঁচ বছর আগে একটি নাটক পড়িয়া আঁকাইয়া উঠিয়াছিলেন ষােড়শ লুই; তাহার শঙ্কিত উক্তি- এ নাটক যদি অভিনীত হয় তবে বাস্তিলের পতন অনিবার্য। বুদ্ধিজীবীরা আত্মতুষ্টির মুহূর্তে জিজ্ঞাসা-প্রশ্ন তােলেন, তথাকথিত স্থিতির মূলে নির্দয় হাতে আঘাত হানেন। অন্যেরা যখন আতঙ্কে স্তব্ধ, ইহারা তখন প্রতিবাদে মুখর। রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র কোন বাধাই তাহাদের কাছে চুড়ান্ত নয়। আমরা জানি ফরাসী বিপ্লবের মানসভুমি রচনা করিয়াছিলেন ভলতেয়ার, রুশাে, দিদিরাে, বােমার কেইস প্রভৃতি লেখকের দল।  আমেরিকার স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের ভাষা এবং বক্তব্যে এখনও স্পষ্ট অনুভব করা যায় ফ্রাঙ্কলিন আর জোর্সনকে। কোনও অভুথান, কোনও বিপ্লবই বিশুদ্ধ হস্তশিল্প নয়, এই মহৎ অ্যুত্থানের পিছনে রহিয়াছেন নবযুগের বুদ্ধিজীবী দল। বাংলাদেশের বিবেক তাহারা, আওয়ামী লীগ তাহাদেরই রাজনৈতিক হাত মাত্র। সুতরাং ইয়াহিয়ার উদ্বেগ বােঝা যায়। জল্লাদ বাহিনী প্রথমেই হানা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, খবরের কাগজের অফিসে, বুদ্ধিজীবীদের মহল্লায়।

আগেই বলিয়াছি চিরকাল ইহারা সে-চেষ্টাই করে। এবং চিরকাল তাহারা ব্যর্থ। টমাস মুর-এর মাথা- – কাটা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “ইউটোপিয়া” তথা কল্পরাজ্যের জন্য মানুষের আকুলতা স্তব্ধ হইয়া যায় নাই। প্রমাণ হইয়া গিয়াছে “আইডিয়ার মৃত্যু নাই। গ্রন্থাগারে জীর্ণ পুঁথি পাতায় লুকানাে বীজ বহু যুগ পরে আবার। অঙ্কুরিত হইয়া উঠিয়াছে এই দৃশ্য যত্রতত্র। বস্তুত বলা চলে, একালের অনেক বিপ্লবীই পুঁথির সন্তান। সুতরাং ভয় সেখানে নয়। বাংলাদেশের হৃদয় হইতে যে “জয়বাংলা” ধ্বনি উথিত হইয়াছে তাহা মৃত্যুত্তীর্ণ। ভয়, এই ব্যাপক হত্যালীলা হয়তাে একালের সুফলা বাংলাকে অতঃপর কিছুকাল নিলা কাটাইতে হইবে।  জাতি যাহারা গড়েন সেই মানুষ-গড়া কারিগরদের অভাবে এক অভাবনীয় দীনতার মধ্যে কাটাইতে হইবে । তাহা ছাড়া আমরা এটাও জানি কপারনিকাসকে তাহার আবিষ্কৃত সত্য প্রকাশ করিতে মৃত্যু-বছর। পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইয়াছে। তাহার তিনশাে বছর পরে চার্লস ডারউইন-এর জীবনেও একই বিড়ম্বনা।। এই পরিস্থিতি বেদনাদায়ক সন্দেহ নাই। বাংলার মানুষের হাহাকার অন্যদেশের বুদ্ধিজীবীর হৃদয়কেও স্পর্শ। করিবে। অন্যত্রও মানুষ অবশ্যই তাহাদের জন্য কাদিবেন। কিন্তু সগর্বে। কেন না, নিজেদের জীবনের। বিনিময়ে তাঁহারা একটি নূতন জাতির জন্ম দিয়া গেলেন। একটি নূতন দেশেরও। সে দেশের নাম- বাংলাদেশ।

৯ এপ্রিল, ১৯৭১ 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা