You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.03 | অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন - সংগ্রামের নোটবুক

অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন

এই চ্যালেঞ্জ কাহার প্রতি? পূর্ব বঙ্গ বা “বাংলাদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের? সে তাে নিশ্চয়ই। মরণপণ এক সংগ্রামে তাহারা জড়াইয়া পড়িয়াছে। সভ্যতার ইতিহাসে চরম এক সংকটের, ভয়ঙ্কর এক দুর্যোগের সাত সাতটা দিন পার হইয়া গেল, তাঁহাদের অগ্নীপরীক্ষার এখনও শেষ নাই। এই আগুনে কত জনপদ পুড়িয়া ছাই হইল, ওই বাংলার নদী জপমালধূত প্রান্তর ছারখারে গেল, বীরের রক্তস্রোত অশ্রুধারার সঙ্গে মিশিয়া লবণাক্ত মােহানার পর মােহানার দিকে বহিয়া গেল, কিন্তু কী আশ্চর্য, বাহির বিশ্বে কাহারও যেন তন্দ্রা আজও ছুটিল না। অথচ আবহমানকালের ইতিহাসে এমন দৃশ্য কোথাও দেখা গিয়েছে কিনা সন্দেহ। একটা জোড়াতালি। রাষ্ট্রের মাইনরিটি মেজরিটিকে পায়ের তলায় র্থেতলাইয়া দিতে চায় শুধু তাই নয়, দরকার হইলে গােটা এক মানব-গােষ্ঠীকে তাহারা উৎসাদন করিবে, এই তাহাদের আস্ফালন। নতুবা পশ্চিম পাক ফৌজ কীসের আশায় ওখানে চড়াও হইয়াছে, তাহার অন্য কোন ব্যাখ্যা হয় না। একটা জাতিকে বিলকুল ফৌথ করিয়া নূতন পত্তানি। স্থাপন করিলে তাে তাহাদের মতলব হাসিল হয় না! পারিবে কি পারিবে না সেটা স্বতন্ত্র প্রশ্ন। তবে ইহা ঠিক, তুড়ি মারিয়া সব ঠাণ্ডা করার কেল্লাফতে করার লড়াই ইহা নয়। | সবচেয়ে লজ্জার কথা এই-বাহিরের গােটা দুনিয়া যেন ঠাণ্ডা রক্তে, অপ্রকোপিত পিত্তে চুপ করিয়া সব দেখিতেছে। হৃতমান, হৃতবল ব্রিটেনের কথা না বলাই ভাল— তথাকথিত কমনওয়েলথের একটি দেশের দুই ভাগে যুদ্ধ। ব্রিটেন অতএব পড়িয়াছে উভয় সংকটে।

আর এক মুরুব্বী আমেরিকা এখনও সুযােগসন্ধানী বেড়ার উপর বসিয়া; হিতপদেশের বাশি বাজাইতেছে। নীরাে ইহার চেয়ে বড় অপরাধ করেন নাই। রুশ আচরণের সঙ্গে ওই দেশের ঐতিহ্যের মিল আছে। কী করিয়াছিলেন স্ট্যালিন, ত্রিশের দশকে স্পেনের প্রজাতন্ত্রী বাহিনী যখন জবরদস্ত হুকুমতের সঙ্গে লড়াই করে? পিকিংয়ের কথা না তােলাই ভাল। পিন্ডিচক্রের সঙ্গে তাহার দোস্তি সুবিদিত। আর রাষ্ট্রপুঞ্জের নায়ক প্রগতিবাদী শ্ৰীযুক্ত উথান্ট? হস্তক্ষেপ দূরে থাকু, তিনি মানবতার তাগিদেও আন্তর্জাতিক রেডক্রশকে নিজে এত্তেলা দিতে চান না- বরাত দিয়াছেন ভারতকে। কী গণতন্ত্রের, কী সমাজ তন্ত্রের ধ্বজাধারী সব পুরােহিতই নির্বাক।  আরও চমকপ্রদ ছােটখাট প্রতিবেশি বা কাছাকাছি দেশগুলির ভূমিকা। ভারতের উপর দিয়া বন্ধ । আকাশপথটি ঘুরপথে খােলা রাখার জন্য সব রকম সুবন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছে বামপন্থী রাষ্ট্র সিংহল । সেখানকার অধিনেত্রী শ্রীমতী বন্দরনায়েককে “মা” বলিয়া ডাকা, নৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ কিছুতেই সিংহলের মন টলে নাই। শতাধিক বিমান এবং পূর্ববঙ্গ হইতে পশ্চিমে ফেরার পথে সিংহলে নামিয়াছে। কিন্তু পশ্চিম হইতে রােজ কত জেট গিয়াছে পূবে, তাহার নাকি কোনও সরকারি হিসাব নাই। আর বর্মার নে উইন-সরকার পাক জাহাজকে তেল দিতেছেন। তেল দেওয়াটা আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থে। এবং শ্রী নে উইনও নাকি সমাজতন্ত্রী। বাংলাদেশ সরকার করুণ আবেদন জানাইয়াছেন বিশ্বকে “পশ্চিম পাকিস্তানকে আর মারণাস্ত্র জোগাইবে না। আপনাদের নিকট হইতে পাওয়া আয়ুধে উহারা আমাদের মারিতেছে।”

বৃথা এ ক্রন্দন। সব কর্ণ বধির কেহ শুনিবে না। সব চতুর মন জানে, রুটির কোন্ দিকটায় মাখন  মাখানাে। অতএব বিশেষ দায় আসিয়া পড়িতেছে ভারতেরই উপর। এ দায় নৈতিক, এ দায় মানবিক । এদেশে হৃদয়াবেগের বান ডাকিয়াছে ঠিকই, কিন্তু ওদেশে যে বান ডাকিয়াছে রক্তের । অতীতে এই ভারতই আফ্রো-এশিয়ার হইয়া পিসীমার ভূমিকা অনেক লইয়াছে, কিন্তু বিনিময়ে পাইয়াছে গলাধাক্কা অন্তত কেনিয়ায়। আরবদের হইয়া গলা ফাটাইয়া ইজরায়েলকে আসামী বানাইয়াছে, অথচ কাশ্মীরের ব্যাপারে এক ছটাক আর নেকনজরও কুড়াইতে পারে নাই। এবার যাহা ঘটিতেছে, তাহা কিন্তু ভারতেরই দ্বারােপ্রান্তে। ঝাপটা ঝটকা সব এই দেশের গায়ে লাগিবে। যদি-যদির কথা বলিতেছি- বাংলাদেশের প্রজ্বলিত প্রাণাগ্নি নিবুনিবু হয়, তবে দলে দলে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বিপন্ন, বিতাড়িত মানুষের জোয়ার এদেশের তটে আছড়াইয়া পড়া ঠেকাইবে কে? প্রশ্নটা তাই ভারতের পক্ষে শুধু মানবতার নয়- আত্মরক্ষারও। ওখানকার। সংগ্রাম আমাদেরও সংগ্রাম। | এই দেশের অগণিত মানুষ আজ বড় আশায় এ দেশের দিকে চাহিয়া আছে। আমরা কী দিব তাহাদের, কী দিতে পারি তাহাদের? শুধু মামুলী রিলিফ নয়। সেটা এই পরিস্থিতিতে যাহারা রুটি চায় তাহাদের পাথর মারিয়া ফিরাইয়া দেওয়ার মতন। এমনকী শুধু হাল্কা হাতিয়ারেও কুলাইবে না। রণাঙ্গনের শেষের দিকটার রিপাের্টে ক্রমশ স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে যে, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সব আছে-বীরত্ব, সাহস ইত্যাদি সবকিছু- কিন্তু শুধু সাহস, এমন কী শুধু শত-সহস্র-লক্ষ শির ডালি দিয়াও এক যুগের যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত হয়তাে জেতা যায় না। ভারী অস্ত্র এবং মাথার উপর “বিমানছত্র চাই। ওই একটি বিষয়ে বাংলার মুক্তিফৌজ আজও অসহায় হইয়া আছে। বিপক্ষ তাহার পূর্ণ সুযােগ লইতেছে। “জেনারেল মনসুন’ কবে দেখা দিবেন কে জানে, তাহার আগে বাংলাকে বাঁচানাে চাই- বাঁচানাের উপকরণ সরবরাহ একান্ত জরুরী। যতটা তাহাদের স্বার্থে ততটা আমাদেরও। যদি কূটনৈতিক কলঙ্কের ভয়টাই বাধা হইয়া থাকে, তবে সেটাকে দূর করার সােজা রাস্তা আছে- সে রাস্তা লওয়ার বিস্তর ঐতিহাসিক নজিরও বর্তমান ও বিদ্যমান অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি।

৩ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা