You dont have javascript enabled! Please enable it!

মানবিকতার আহ্বান

আন্তর্জাতিক রেডক্রসের একটি ঔষধ বোেঝাই বিমান দিন দুই করাচিতে অপেক্ষা করিয়া ফিরিয়া গিয়াছে। বিমানটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাকে কুর্ণিশ করিতে আসে নাই- আসিয়াছিল ঢাকার আর্তদের সেবার সামগ্রী লইয়া। আশা ছিল পাকিস্তানী হুকুমতের মেজাজ যতই উগ্র এবং রুক্ষ হউক না কেন, মানবিকতার দাবি অন্তত সে উপেক্ষা করিবে না। ঢাকায় রেডক্রসকে তাহার কর্তব্যপালন যথারীতি করিতে দিবে। কিন্তু চোরা শশানে ধর্মের কাহিনী । আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের ধার ইয়াহিয়া খাঁ এবং তাহার দলবল আদৌ ধারেন । রেডক্রসই হউক আর ইউনাইটেড নেশূনই হউক, কাহার তােয়াক্কা তাহারা করেন? কাজেই রেডক্রসের সাধ্যসাধনার কোনও ফল হয় নাই। ঢাকা রওনা হইবার ছাড়পত্র তাহার নামঞ্জুর করিয়াছেন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। রেডক্রসের ভাগ্য ভাল যে, তিনি শুধু ওইটুকু করিয়াই নিরস্ত হইয়াছেন। জনতাকে দিয়া বিমানটি যে করাচি এয়ারপাের্টে আগুনে পােড়াইয়া ধ্বংস করেন নাই,কিংবা সােজাসুজি সেটিকে ক্রোকের পরােয়ানা জারি করিয়া বাজেয়াপ্ত করেন নাই, এ-তাে রেডক্রসের বহু ভাগ্য! কিন্তু তামাসা থাক। বাংলাদেশ আজ জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে। তাহার সমস্যা আজ তামাসার বিষয় নয়। জঙ্গীশাহীর বর্বর অত্যাচার সহ্য করিয়া সে যে আজও টিকিয়া আছে সে তাে মানব-ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় কাহিনী। কিন্তু গােটা দেশটা যে মৃত ও আহতে ভরিয়া গিয়াছে সেটা তাে আর অলীক কিছু নয়। যে মরিয়াছে সে তাে বাচিয়া গিয়াছে। তাহার সমস্যা তাে শেষ । কিন্তু লক্ষ লক্ষ আহতের সেবা ও শুশ্রুষা তাে একান্ত দরকার। তাহার ব্যবস্থা করে কে? বাংলাদেশের সাহায্য সীমিত। তাহার উপর সে সামর্থ্যকে কাজে লাগাইবার সুযোগও পশ্চিম-পাকিস্তানের নির্মম শাসকেরা দিতেছে না। স্থান কাল পাত্র কোনও কিছুই বিবেচনা না করিয়া তাহারা এখনও বােমা বর্ষণ করিতেছে। সে নিষ্ঠুর আক্রমণ কদাচিৎ সামরিক লক্ষ্যের উপর। সাধারণত তাহার লক্ষ্য জাতিধর্মনির্বিশেষে নিরস্ত্র বাঙ্গালী। শিশু বৃদ্ধ নারী রােগী আতুর কেহই বাদ  যাইতেছে না। মার্কিন মারণাস্ত্র এবং বিমানের ইয়াহিয়া খাঁ সদ্ব্যবহার করিতেছেন বটে। রাশিয়া ও চীনের দানও এতদিনে কাজে লাগাইবার মওকা মিলিয়াছে। 

এ পরিবেশে রেডক্রসের বিমানের আকস্মিক আগমনে ইসলামাবাদের মাথায় বাজ যে পড়িবে তাহাতে অবাক হইবার কিছু নাই । যে বাংলাদেশ হইতে কুলার বাতাস দিয়া ইয়াহিয়া খা দুনিয়ার সাংবাদিকদের বিদায় দিয়াছেন সেখানে সাধ করিয়া আন্তর্জাতিক রেডক্রসের জাত সাপকে ডাকিয়া আনিবেন এমন মূর্খ পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গী ডিক্টেটর অন্তত নন। রেডক্রসকে ঢাকায় যাইতে দেওয়ার অর্থ দুনিয়ার হাটে নিজের হাঁড়ি ভাঙিয়া দেওয়া। অতটা চালে ভুল কি আর তিনি করিতে পারেন? পত্রপাঠ তাই রেডক্রসের বিমানকে তিনি মানে মানে সরিয়া পড়িবার নির্দেশ দিয়াছেন। হুকুম তিনি না হয় দিলেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক রেডক্রস সে হুকুম তামিল করিল কেন? পলিটিক্স করা তাে আর রেডক্রসের কাজ নয়। তাহার কাজ আর্তের সেবা, বিপন্নের সহায়তা। ঢাকা যে আজ পর্যদস্ত ও বিধ্বস্ত এ কথা ইসলামাবাদ ঢাকিতে চাহিলেও তামাম দুনিয়ায়তাে অজানা নাই। ইয়াহিয়া খাঁর দাবড়ানিতে ঘাবড়াইয়া আন্তর্জাতিক রেডক্রস কেন কর্তব্যভ্রষ্ট ও আদর্শভ্রষ্ট হইল। ইয়াহিয়া খাঁ ছাড়পত্র মঞ্জুর না করিলে বাংলাদেশে যাওয়া অসম্ভব তাে আর নয়  করাচি ছাড়া সেখানে যাইবার ভিন্ন পথ নাই, এও তাে মিথ্যা। আর কোনও পথ না থাকিলে কলিকাতা দিয়া সেখানে অনায়াসে যাওয়া যাইত এবং এখনও যায়। আন্তর্জাতিক রেডক্রস সত্যিই যদি বাংলাদেশে আর্ত ও বিপন্নের সেবায় ব্রতী হইতে চায় তাহার পথ তাে খােলা রহিয়াছে। আর সে মতি যদি তাহার ইয়াহিয়া খাঁর চোখরাঙানিতে চলিয়া। গিয়া থাকে তবে ভারত সরকারই সে ভার লউন না কেন। যুদ্ধে আহত ও বর্বর বিমান আক্রমণে বিপন্নদের শুশ্রুষা ও চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স সহ নার্স ও ডাক্তার বাংলাদেশে পাঠাইতে বাধা কোথায়? স্পেনে ও চীনে যখন গৃহযুদ্ধ চলিতেছিল তখন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে জাতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক এবং মেডিক্যাল কোর পাঠাইয়াছিল। আজ সেই কংগ্রেস দেশ শাসন করিতেছে। বিদেশি শাসনের সময় যা। সম্ভব হইয়াছিল আজ স্বাধীন ভারতে সেটা অসম্ভব হইবে কেন? বাংলাদেশের আর্তবাণী আমাদের কানে যখন নিত্য পৌছিতেছে তখনও আইনের কচকচিতে সময় নষ্ট করিব, আমরা কী এতই হৃদয়হীন?

৫ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!