সম্পাদকীয় নয়
প্রাত্যহিক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে অভ্যস্ত পাঠকেরা মার্জনা করিবেন, ঠিক প্রাত্যহিক রীতিরক্ষা ইহা নয় । দুইটি দিনে যদি দখলদার ফৌজের হাতে এক লক্ষ মুক্তিকামী মানুষ খুন হন, সেদিন লেখার কিছু থাকে না। বড়ই অভিশাপ, অদৃষ্টের বড়ই বিড়ম্বনা, এত কাছে থাকিয়াও ওই বাংলায় কী ঘটিতেছে আমরা জানিনা। সম্পাদকীয় মানে যদি হয় অভিমত দেওয়া অথবা ঘটিয়া গিয়াছে এমন কোনও ঘটনার তাৎপর্য বাহির করিয়া আনা, তবে ইহা সম্পাদকীয় নয়। এই মুহূর্তে একটা খবর আসে, পর মুহূর্তে সব ভাসিয়া চলিয়া যায় । মুক্তিফৌজ কি কুমিল্লাকে মুক্ত করিয়া চট্টগ্রামের দিকে ধাইয়া চলিতেছে? জানি না, কিছুই জানি না। অসহায় অসামরিক মানুষের উপর ওই “বাংলাদেশের জনপদে জনপদে কি বােমাস্রাবী বিমান সবকিছু চুরাইয়া গুঁড়াইয়া দেওয়ার নেশায় মাতিয়াছে? জানি না, কিছুই জানি না। দানবের মূঢ় অপব্যয়-ইতিবৃত্ত চুলায় যাক, চুলায় যাক শাশ্বত অধ্যায়- যদি যুদ্ধ আজিকার জন্য কুকীর্তির একটা নজির রাখিয়া রেহাই পাইয়া যাইতে পারে, তবে সে লজ্জা আমাদের, সে লজ্জা সকলের, সে লজ্জা বিশ্বমানুষের। কেননা প্রদত্ত ভােটের ৭২ ভাগেরও বেশি একটি দল পাইয়াছে, গণতান্ত্রিক জগতের ইতিহাসে ইহার নজীর বেশি নাই । কেননা প্রায় সর্বসম্মত জনমতকে এক ফুৎকারে, নিছক পেশীর জোরে উড়াইয়া দেওয়ার স্পর্ধা ইতিপূর্বে কুত্রাপি কোনও স্বৈরতন্ত্রেরও হয় নাই । আজ পিণ্ডির মানুষখেকো বাহিনী সেই স্পর্ধার সুরসবে উন্মত্ত-একটা জাতির ইচ্ছাকে ট্যাঙ্ক নামক ক্যাটার পিলারের চাকার তলায় নিষ্পিষ্ট করিবে বলিয়া ক্ষিপ্ত। ঢাকার রােগীসমেত একটা হাসপাতালের গােটা-ইমারতকে উড়াইয়া দেওয়ার দৃষ্টান্ত চেঙ্গিস, তৈমূর কিংবা নাদির-কোনও পাশব অত্যাচারীর নৃশংস গণহত্যার লিপিবদ্ধ বৃত্তান্তেও নাই। এই মুহূর্তের একমাত্র প্রশ্ন, গােটা বিশ্ব কী করিতেছে ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত নামে দেশটি কী করিতেছে, কী করিবে! শ্রীমতী গান্ধীর বয়ান পড়িয়াছি। কোনও আশ্বাস নাই। বড় সতর্ক, বড় সাবধানী, কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী হইতে বড়ই প্রাজ্ঞ এবং বিবেচনাপ্রসূত। শুধু একটি মাত্র জিজ্ঞাসা, কোনও-না-কোনওভাবে পশ্চিম প্রান্তে এমন চাপ কি সৃষ্টি করা যায় না, যাহাতে জঙ্গীচক্রের মারণউচাটনের মাতামাতিতে একটু শিকল পরানাে। যায়, চাপ লাঘব হয় বাংলাদেশের উপর? জানিনা, কিছুই জানি না।
তবে নিশ্চয় করিয়া এইটুকু জানি, আজ “বাংলাদেশের মানবতা যদি না বাচে, তবে বাচিবে কে?- সে বাচার অর্থই বা কী? | মুজিব কোথায়? জানিনা। তিনি কি এখনও মুক্ত অথবা বন্দী? বন্দী হইলেও ভয় নাই, ভাবনা নাই, কারণ এই বন্দী সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণেশ্বর। যদি তিনি আজ অথবা আগামীকাল অথবা এই দীর্ঘস্থায়ী রক্তাক্ত মুক্তি মুক্তি সংগ্রামের শহীদও হন, তবু ভাবনা নাই, ভয় নাই। একটি অপসারণ লক্ষ লক্ষ প্রাণে অনুপ্রেরণার সন্ধি জোগাইয়া যাইবে, জ্বালিবে আগুন, এ তাহাই। একটি জীবনে জন্ম লভিয়া সকল দেশ জাগিবে। কত সংকল্প, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেশে সকলে জাগিবে। মরিয়াও যা মরে না দুরভিসারী দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া আমরা অব্যর্থ, জানিয়াছি- এ তাহাই বাংলাদেশ মরিবে না। আর টিক্কা খানের মৃত্যু? সব হত্যাই শােচনীয়, তবু ওই একটি ঘটনা যদি সত্য হয়- অমােঘ অঙ্গুলি তুলিয়া দেখাইয়া দিতেছে সেই ইতিহাস নামক নাটকে কেহ নায়ক, কেহ প্রতিনায়ক, এবং মৃত্যু, কখনও, কোনও দিন, কোনও খানে পদবির রেয়াৎ করেনা । যিনি যেই হউন, ইতিহাস রচনার চরিত্র-শুধু-দুঃশাসক টিক্কা আর অকালে নিহত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ মরণের চোখে সকলেই সমান।
২৮ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা