জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ
তিনি শেখ মুজিবর শুধু বলিয়াছেন, তাঁহার “বাংলাদেশ” সার্বভৌম ও স্বাধীন। কিন্তু-হিংস্র নেকড়ের পাল ওই বাংলার বুকের উপর হঠাৎ ঝাপাইয়া পড়িয়াছে। একটি জাতির কৃষ্ণচূড়ার মতাে জলন্ত বাসনাকে তাহারা দলিত করিবে, একটি জাতির দীপ্র দাবিকে ছিড়িয়া ফেলিবে, এই তাহাদের আস্ফালন, এই তাহাদের নির্লজ্জ হুঙ্কার । মুঢ় এক নিরামক রূঢ় এক আঘাতে যেন ইতিহাসের স্রোতকে উল্টা দিকে বহাইয়া দিতে চায়। | বলা হইতেছে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু গৃহযুদ্ধ ইহা নয়। গৃহযুদ্ধ হয় একটা জাতির দুই বৈরী জাতি গােষ্ঠীর মধ্যে। পাকিস্তান একটা রাষ্ট্র বটে তাই বলিয়া একটা জাতি তাে কখনও ছিল না, কোনও দিন হইয়া উঠতে পারে নাই যেটুকু-বা ভান ছিল, তাহাও নিঃশেষে মুছিয়া গেল। গৃহযুদ্ধ হয় সমানে-সমানে। সেখানে এক পক্ষ সমরাস্ত্রে সজ্জিত, অপর পক্ষ নিরস্ত্র এক মানব সমাজ, সেখানে ওই শব্দটা খাটে না। গৃহযুদ্ধ নয়, ইহা গণহত্যা, ইহা পাইকারী হারে ফৌজী বলাৎকার। বলাৎকার শুধু অসহায় একটি জাতির নয়, বলাকার গণতন্ত্রের উপরেও। বিপুল একটি নির্বাচনী রায় ইহারা নস্যাৎ করিয়া দিতেছে, সমস্ত প্রতিশ্রুতিকে প্রহসনে পরিণত করিয়াছে। পিণ্ডির আত্মা বলিয়া যদি কিছু থাকে তবে সেই আত্মার—অথবা তাহার প্রেতের-একটিমাত্র নগ্ন উন্মত্ত বাসনা- ‘বাংলাদেশকে শৃঙ্খলিত করিয়া রাখা। প্রভুত্বের অন্ধ স্পৃহা সেই সাবেকী ক্রীতদাসত্বের অন্ধকার যুগকে কায়েম করিতে চায়। এক কথায়, জঙ্গী চক্র বুঝাইয়া দিয়াছে পূর্ববঙ্গ তাহাদের চোখে একটা কলােনি মাত্র। কলােনি-শাসনের আর শােষণের। ইহার পর কোনও দিন যেন ওই দেশের পশ্চিম ভাগের কেহ পূর্ববঙ্গকে নিজ দেশের অন্য ভাগ বলিয়া জাহির না করে। ওটা বুজরুকি। ধর্মীয় বেরাদরির একগাছি সূতা যা ছিল তাহা কবে ছিড়িয়া গিয়াছে। মুজিবর প্রকাশ্যেই বলিয়াছেন “উহারা শত্রু”। শত্রুর বিরুদ্ধে জাতির সকলকে রুখিয়া দাড়াইতে বলিয়াছেন।
কিন্তু শেখ মুজিবর এখন কোথায়? কেহ জানে না। তিনি কি অপহৃত, অথবা স্বেচ্ছায় অজ্ঞাতবাসে চলিয়া গিয়াছেন? সেখান হইতে দীর্ঘস্থায়ী এক সংগ্রামের সৈনিকদের প্রেরণা জোগাইবেন? কয়দিন আগে তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি যদি আপনাদের মধ্যে না থাকি”-আজ সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়াছে; তাহার তাৎপর্য ফুটিয়া উঠিয়াছে। যখন জঙ্গীশাহ ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাহার আলােচনা চলিতেছিল, মুজিবর তখনই ওই সম্ভাবনার কথা উচ্চারণ করেন। এখন একেবারে জলের মত সাফ এবং পরিষ্কার যে, ইয়াহিয়ার ঢাকা বৈঠকটাই ধাপ্পা, শুধুই, কালহরণের অছিলা। আকাশ পথ বন্ধ, তাই তিনি জাহাজ বােঝাই সৈন্য নামাইবার ওয়াদায় ছিলেন। সৈন্য নামিয়াছে, সামরিক আইন সাঁড়াশির মতাে সারা বাংলাদেশকে চাপিয়া ধরিয়াছে। সর্বত্র সান্ধ্য আইন বলবৎ। কিন্তু জঙ্গীশাসক জানেন না সন্ধ্যার পরে প্রভাত আছে। আর কথায় বলে ভােরের ঠিক আগের প্রহরটিই সবচেয়ে ঘাের কালাে । ইহা সত্য যে, পশ্চিম হইল অস্তের দিক, আর পূর্ব উদয়ের। পশ্চিমের উপর ওইখানেই পূর্বের জিৎ। কিংবা কে জানে ইয়াহিয়া নিজেও বুঝি-বা জঙ্গীচক্রের ক্রীড়নক মাত্র, ভুঠো কোম্পানীর হাতের পুতুল হইয়া রহিয়াছেন। তাহারা তাহাকে যেমন নাচাইতেছেন, তিনি তেমন নাচিতেছেন। তাঁহার পিঠে পিস্তল রাখিয়া যাহারা তাহাকে ঢাকায় পাঠাইয়াছিল, আসলে নিতান্ত-নােংরা একটা মতলব হাসিল করিতে চাহিয়াছিল। ইয়াহিয়া খান ভুট্টো তথা জঙ্গীচক্রের হাতের পুতুল, এই পর্যন্ত না হয় বােঝা গেল, কিন্তু ওই জঙ্গীচক্র কাহার পুতুল? চীনের নয় তাে?
ইহা ঠিক যে, পূর্ববঙ্গের জাতিয়তাবাদী অভ্যুত্থানকে চীন খুব খুশী মনে দেখে নাই। স্বাধীন জাতিয়তাবাদী পূর্ব বঙ্গ সত্য উঠিলে দুনিয়ার এই অঞ্চলে একটা চক্রান্তের ঘাঁটি চিরতরে চীনের হাতছাড়া হইয়া যায়। পাকিস্তান দুই টুকরা হইলে দোসর হিসাবে সে হয় দুর্বল, দুইজনে মিলিয়া ভারতকে জব্দ করাটা আর অত সস্তা থাকে না। দক্ষিণ-এশিয়ার শক্তিগত ভারসাম্যই উল্টাইয়া যায়। বশদ ভুঠো তাে ছিলই, ভুট্টোর মারফৎ জঙ্গীচক্রের একটা অংশকে হাত করিয়া পিকিং অবস্থাটা সামাল দিতে চাহিতেছে। আর পূর্ববঙ্গকে যথাপূর্ব-শােষণ-পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীতন্ত্রের ইহাই কমিশন” । বন্দোবস্তটা ভালই। কিন্তু শেষ হাসি কাহার, সে কথা জানে একমাত্র ভবিষ্যৎ। আর জানেন বাংলাদেশের ভাগ্যবিধাতা- সবকিছু নির্ভর করিতেছে ওই দেশের জনগণের প্রতিরােধ শক্তি কতখানি অনমনীয় তাহার উপর। ইস্পাত হইলে নুইয়া পড়িবে না, ফৌজী জুলুম যদি গােটা দেশকে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ বানাইতে চায়, তাহা হইলেও না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সমবেত প্রতিজ্ঞা যদি দুলিয়া ওঠে, তবে স্বৈরাচার, অনাচার, অত্যাচার সব সেই জলােচ্ছাসে ইতিহাসের আবর্জনার মতাে ভাসিয়া যাইবে । সমুদ্রর তরঙ্গকে, যাহারা ‘তিষ্ঠ’ বলিয়া শাসন করিতে যায়, পিন্ডি-করাচির জঙ্গী নায়কেরা এ যুগের সেই ক্যানিউট, সেই আত্মম্ভরী আহাম্মক। কিন্তু, কিন্তু… তাহারা পারিবে না। পারিবে না।
২৭ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা