You dont have javascript enabled! Please enable it! বারবার হাতছানি বারবার পরাজয়ের গ্লানি -বিশেষ প্রতিনিধি - সংগ্রামের নোটবুক

বারবার হাতছানি, বারবার পরাজয়ের গ্লানি

–বিশেষ প্রতিনিধি

এক হাতে মােরা মগেরে রুখেছি, মােগলেরে আর হাতে এই সগর্ব উক্তি বাঙালী কবির। ইতিহাস রচিত । হচ্ছে আজ বাঙালীর তাজা রক্তে। নতুন ইতিহাস। পিন্ডির মুঘলদের’ বিরুদ্ধে বাঙালী আবার বিদ্রোহী। কোনও উচ্চাভিলাষী ভূইঞা নয়, বিদ্রোহী এবার সাধারণ মানুষ। এ সময়ে স্বভাবতই মনে পড়ে পুরানাে । দিনের কথা। ইয়াহিয়া কী জানেন শ্যামল ওই পূর্ববাংলা একদিন সমান লুব্ধ করে তুলেছিল দিল্লির বাদশাহদেরও। তিনি নিশ্চয় জানেন না—অনেক রক্তের বিনিময়ে দিল্লিশ্বররা আবিষ্কার করেছিলেন এই  সত্য-রুটি আর রুটিতে প্লাবিত বাংলাদেশ এক নরক!-বীভৎস।’ হানাদারের কাছে বাংলা সত্যই চিরকালের নরক। বার বার ওই এলাকা হাতছানি দিয়েছে তাদের। বার বার পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে লুঠেরাদের ঘরে ফিরতে হয়েছে। সপ্তদশ অশ্বারােহী নিয়ে বখতিয়ার খিলজির নবদ্বীপ বিজয় খৃষ্টিয় দ্বাদশ শতকের ঘটনা। বলা হয় তখন থেকেই শুরু বাংলায় মুসলিম শাসনের। কিন্তু কোন্ মুসলিম? রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন-নবদ্বীপ লুণ্ঠন করে বখতিয়ার স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য। হইয়া প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন, তখন নবদ্বীপ বস্তৃতিয়ারের অধিকারভুক্ত হয় নাই, কারণ অর্ধশতাব্দী পরে । বাঙলার স্বাধীন সুলতান মুগীস-উদ্দীন-আজরফ নবদ্বীপ বিজয় কাহিনী স্মরণার্থ নূতন মুদ্রাঙ্কন করিয়াছিলেন ।  বাংলার এই স্বাধীন সুলতানদের কাহিনী সকলের জানা। বখতিয়ারের পরে যারা লক্ষণাবতীতে রাজত্ব। করেছেন তাদের মধ্যে একমাত্র আলিমদানই দিল্লির মসনদকে সালাম জানিয়েছেন,-আর কেউ নয় । দিল্লির । সঙ্গে এই বশ্যতার সম্পর্ক মােটামুটি ছাপান্ন বছর । তার পূর্বই বাংলা আবার স্বাধীন । প্রথমে বুলবন বংশ, তারপর তুঘলক বংশ। বিদ্রোহ। অবশেষে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পূর্ণ স্বাধীনতার ঘােষণা। তারপর হােসেন শাহ। হিন্দু কিংবা মুসলিম-বাংলার কোনও রাজ্যই দিল্লিকে মেনে নেয়নি সহসা। কখনও এখানে রক্ত, কৃষ্ণ, শ্বেত এই তিনবর্ণের চন্দ্রাতপ স্বাধীনতার প্রতীক, কখনও বা আপন মুদ্রণে রুজরক চন্দ্রাতপ ।

স্বাধীনতার কথা লিখেছিলেন, সুবর্ণগ্রামে ফখরউদ্দীন প্রচলন করেছিলেন সুদৃশ্য রৌপ্যমুদ্রার। এই সুবর্ণগ্রাম । তৎকালে পূর্ববাংলার রাজধানী একডালা দুর্গ কোথায়? সেও সম্ভবত পূর্ব বাংলায় । ইতিহাস পাঠক জানিনা। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে ফিরােজ শাহের অভিযানের কথা। ইলিয়াস আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। কিন্তু অপরাজেয় সেই দুর্গ। ঐতিহাসিক লিখেছেন ‘দ্বাবিংশতি দিবস এক ডালা দুর্গ অবরােধ করিয়াও সুলতান। ফিরােজশাহ নদী ও অরণ্যবেষ্টিত দুর্গ অধিকার করিতে পারেন নাই। দ্বিতীয় অভিযানও ব্যর্থ। দিল্লির দাসত্ব বলতে তক্কালে যা বােঝাত মােটামুটি তা প্রতীকী। কিছু উপটৌকন অথবা নজরানা । আর আনুগত্যের প্রমাণ হিসাবে তাবু নৌবং নাকারা, নিশান, একখানা কোমরবন্ধ আর একটি তলােয়ার।। বাংলার শাসকেরা তাও গ্রহণে রাজি নন। প্রমাণ-মুঘলের বাংলা। বাংলায় মুঘল আমলের সূচনা ১৫৭৫ সনে, দায়ূদ খাঁর পরাজয়ের পর । কিন্তু সে বিজয় নামেমাত্র । দায়ুদ। তারপর অপরাজেয় থেকে গেলেন। তদুপরি বারাে ভূইঞা। মুঘলরা দ্বিতীয়বারের মতাে বাংলাকে করায়ত্ত । করতে চাইলেন ১৫৭৬ সনে, রাজমহলের যুদ্ধে। দেশ তবুও অশান্ত। দিকে দিকে আফগান প্রধানদের। বিদ্রোহ। ১৫৭৯ থেকে ১৫৮৩-অস্থিরতার কাল । মুঘলরা নামেমাত্র এই এলাকার বাদশা । শাহবাজ খাঁ ব্যর্থ।  হলেন ইশা খাঁকে বাগে আনতে। ১৫৮৬ সনে আকবর বাংলাকে ‘সুবা’ হিসাবে খাতায় তুললেন। কিন্তু সুবা বাংলায় তার কর্তৃত্ব কাগজে কলমেই রয়ে গেল। বাধ্য হয়েই আসরে অবতীর্ণ হলেন-মানসিংহ। রাজমহলে বসে তিনি হাতছাড়া এলাকাগুলােকে হাতে আনলেন। কিন্তু তার সাময়িক অনুপস্থিতির সুযােগে বাংলায় আবার বিদ্রোহ। বাংলা হার মানে শেষ পর্যন্ত ইসলাম খাঁর দেওয়ানির আমলে। পূর্ব বাংলায় প্রথমবারের মতাে তখনই প্রসারিত হয় মুঘল শাসন। ঢাকা তখনই নির্বাচিত হয়-রাজধানী।  ইসলাম খাঁ গভর্ণর ছিলেন- ১৬০৮ থেকে ১৩ সন পর্যন্ত। তার পর নতুন গভর্ণরের আমলে (১৬১৩-১৭) আবার প্রচণ্ড বিদ্রোহ। চট্টগ্রামে দখল করতে গিয়ে মুঘল বাহিনী পর্যদুস্ত । একই ইতিবৃত্ত আধুনিক কাল পর্যন্ত। কখনও শান্তি, কখনও বিদ্রোহ। কখনও বশ্যতার ভান কখনও স্বাধীনতা। ১৫৮৭ সনে রালফু ফিচ বাংলার মুখ দেখে লিখছেন-চির অশান্ত দেশ চারদিকে কেবল বিদ্রোহ আর বিদ্রোহ। ১৫৯৭ সনে আইন-ই-আকবরী বলে-বাংলার আসল বাদশা ঈশা খাঁ ।

দিল্লির মুদ্রা ছাড়া সেখানে আর বাদশাহী কোনও কিছুই চলে না। এমন কী ১৬১৫ সনে টমাস রাে সুরাটের কুঠিয়ালদের পরামর্শ দিচ্ছেন-ওদিকে ইংরাজদের কোনও কুঠি স্থাপন না-করাই ভাল। বাংলাকে বিশ্বাস নেই ।  ইয়াহিয়া আর তার অনুচরেরা সেই বাংলায়ই নেমেছেন খােলা তলােয়ার হাতে। ইতিহাস বলছে তিনি ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন। বাংলা, বিশেষত পূর্ব বাংলা মসকোর মতই দুর্ভেদ্য। নেপােলিয়ান মসকোর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন, ফরাসী সৈন্যের শবের উপর দিয়ে হেঁটে। বহুকাল পরে আর এক অভিযাত্রী হিটলারকেও পিছু হটতে হয়েছিল—একই রক্তাক্ত পথ ধরে। ইয়াহিয়া-টিক্কা খাদেরও নিয়তি বােধ হয় তাই । | বলা হয়, নেপােলিয়ান যার কাছে হেরেছিলেন তার নাম জেনারেল স্নাে । বরফ মৃত্যুর মতাে শীতল বরফ। চাপ চাপ বরফ। পরদেশী হানাদারকে পূর্ব বাংলায় কবর দিয়েছে যে সে-বাংলার বর্ষা। অবিশ্রান্ত বর্ষণ। প্লাবন। ঐতিহাসিক লিখছেন-“সুবর্ণ গ্রামে ফখ উদ্দীন মুবারক শাহ বর্ষাকালে প্রবল হইয়া উঠিতেন। কারণ, তাহার আধিপত্য পূর্ব বাংলায়। ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক হয়তাে লিখবেন-গ্রীষ্মেও পূর্ব বাংলা সমাজ প্রবল। কারণ, সেদিন সেখানে বিদ্রোহী প্রত্যেকেই; শুধু নদী নালা খাল বিল নয়, বিদ্রোহী প্রতিটি মানুষ এবং তাদের প্রত্যেকের চোখে আগুন আগুন পতাকায়ও। সেখানে আঁকা জ্বলন্ত সূর্য।

ডিসেম্বর, ১৯৭১ 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা