You dont have javascript enabled! Please enable it! আঞ্চলিক ভেদবুদ্ধি -সতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী | মুক্তিযুদ্ধের ভারত - সংগ্রামের নোটবুক

আঞ্চলিক ভেদবুদ্ধি

–সতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

দুটি কথা প্রথমেই স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে মনে রাখা ভাল। প্রথম,-ভারতবর্ষ ইংলন্ড, জাপান, জার্মানী প্রভৃতি দেশের মতাে নেশন নয়। ভারতের জনগণের মধ্যে ভাষার বিভিন্নতা। ধর্মের বিভিন্ন প্রাচীন ইতিহাস ও কিম্বদন্তীর বিভিন্নতা, সামাজিক আচারের বিভিন্নতা বর্তমান। দ্বিতীয়-অথচ আমাদের দেশ এক। ইংরেজ-এক বিশাল ও জটিল রাষ্ট্রীয় স্বর্থের বন্ধনে সমগ্র ভারতবর্ষ যখন আবদ্ধ হল তখন থেকে আমাদের আধুনিক ‘নেশন’ গড়ে তুলবার সাধনার সূত্রপাত। আমাদের দেশে ধর্মের ও ভাষার বিভিন্নতা আছে বলেই গত পঞ্চাশ বছরের রাজনীতিতে নেশন গঠনের দুর্লঙ্ অন্তরায়ও বার বার দেখা দিয়েছে। হিন্দু মুসলমান সমস্যা ও ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের সমস্যা মাঝে মাঝেই সংকট সৃষ্টি করেছে। আবার এই দুটি সমস্যাও আবর্তিত হয়েছে অপর একটি মৌলিক প্রশ্নকে কেন্দ্র করে । প্রশ্ন উঠেছে সমগ্র ভারতবর্ষ কী এক জাতি? হিন্দু এবং মুসলমান কী দুই জাতি? ভারতবর্ষ কী বহুজাতিক রাষ্ট্র? মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগের দুই জাতিতত্ত্ব নিয়ে সংগ্রামের ফলে এক বিশেষ ঐতিহাসিক পূর্বে, ভারতভঙ্গ ঘটে, সৃষ্টি হয় স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানের। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে ভারতবর্ষ যে এক জাতি তা স্বীকার করত। স্বাধীনতা-উত্তর যুগে ১৯৪০ সাল থেকে মাঝে মাঝেই এদের মুখে শােনা গেছে অন্য কথা-ভারতবর্ষ এক জাতি নয়, বহু জাতির সম্মিলিত নাম। কমিউনিস্টরা নানা সময়ে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে ১৭টি বাসভূমিতে (হােমল্যান্ড) ভারতকে বিভক্ত করার। কথা বলেছে, পাকিস্তানের তত্ত্বকে সমর্থন করেছে মার্কসীয় মন্ত্র উচ্চারণ করে। কখনাে কখনাে ঘােষণা করেছে। যে, এই সব জাতির ভারতরাষ্ট্র হতে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারও আছে। সম্প্রতি জানা গিয়েছিল যে, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পারটি পুনরায় ১৯৭১ সালে ভারতবর্ষ এক নেশন নয় এই তত্ত্বে প্রত্যাবর্তন করছে।

মার্কসবাদীদের বক্তব্য-ভারতবর্ষ বিভিন্ন জাতির (নেশনালিটি) সমবায়ে গঠিত এক রাষ্ট্র। প্রয়ােজনবােধে যে কোন জাতি, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে থেকে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার দাবি করতে পারে। এ দাবি ন্যায়সঙ্গত এবং মার্কসবাদসম্মত। ১৯৪০ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির মুখেও এই তত্ত্বকথা শােনা যেত । আজ অকস্মাৎ দীর্ঘবিরতির পর আবার এই আওয়াজ কেন? পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব দাবিদাওয়া আছে, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বক্তব্যও আছে। সে বক্তব্য যে বিচারের অযােগ্য তাও নয়। অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে নতুন ভাবনা-চিন্তার অবকাশ। আছে তাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু অঙ্গরাজ্যের অভিযােগ আছে বলেই প্রমাণ হয় না যে, ভারতীয় নেশন শুধুই মায়া । মার্কসবাদী তত্ত্বকথার অসৎ ভাষা করে বলাও চলে না যে, ভারতবর্ষকে বহু জাতির বহু নেশনের বাসভূমি হিসাবে খন্ডবিচ্ছিন্ন করতে হবে।

কথা উঠতে পারে যে, রুশ অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় আছে। জাতীয় সমস্যা সমাধানের রুশ । পথই আমাদের পথ। জাতীয় সমস্যা নিয়ে মার্কসবাদের যে সব বক্তব্য আছে তা মানলে ভারত-বর্যকেও।  বহুজাতিক রাষ্ট্র বলে মেনে নিতে হয়। জাতিসত্তাগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করতে হয়। কিন্তু সত্যই কী তাই? একথা সত্য যে রুশ সাম্রাজ্য ছিল বহুজাতিক রাষ্ট্র। ঐ রাষ্ট্রে জাতি অধিজাতি ছিল একশতেরও বেশি। এদের মধ্যে অনেক জাতি, অধিজাতি বিভিন্ন নির্দিষ্ট ভৌগােলিক অঞ্চলে সংঘবদ্ধ সম্প্রদায় হিসাবে বাস করত। রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে যে সব জাতি ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য উক্রাইনীয়রা পােলরা বিয়েলােরুশরা, লিথুয়ানীয়রা, লেটরী, এস্তোনীয়রা, জর্জীয়রা, আর্মেনীয়রা। এ ছাড়া ছিল মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জাতি-তাতার, বাশকির প্রভৃতি। রুশিয়ার জনসংখ্যা শতকরা ৪০ ভাগ ছিল শ্বেতরুশরা। শতকরা ৬০ ভাগ ছিল অরুশ এবং পশ্চাৎপদ জাতিগত এলাকাগুলিতে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতায় বিড়ম্বনা ছিল অপরিসীম। বহু অ-রুশ জাতি জাতিগত উৎপীড়ন ভােগ করত। অ-রুশ এলাকাগুলিতে সরকারী কর্মকর্তারা সবাই ছিল একমাত্র রুশ । একমাত্র রুশ ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃত ছিল। অ-রুশ এলাকাগুলি হতে রাষ্ট্রীয় ডুমাতে সদস্য ছিল যৎসামান্য। মধ্য এশিয়া ও ইয়াকুতিয়ার জাতিগুলির ডুমার সদস্য নির্বাচিত করবার আদৌ কোন অধিকারই ছিল না। তথাকথিত “ইহুদি’ চোহন্দি টোন ইহুদিদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করতে বাধ্য করা হত । বিদ্যালয়গুলিতে ইহুদিদের আসন ছিল সীমাবদ্ধ। অ-রুশ জাতিগুলির ধর্মের উপর নানাভাবে নিপীড়ন হত । যারা রুশ অর্থোডকস গিরজার অন্তর্ভুক্ত ছিল না তারা কোন রাষ্ট্রীয় পদ লাভ করতেও পারত না। বিচার করলে দেখা যাবে যে, সমকালীন ভারতবর্ষের সঙ্গে প্রাক বিপ্লবী যুগের রুশ দেশের প্রায় কোন বিষয়েই মিল নেই।

যথা-ভারত সাম্রাজ্য বলে কোন পদার্থ নেই এবং এ দেশে শ্বেতরুশদের মতাে কোন ন্যাশনালিটি নেই, সমাজে ও রাষ্ট্রে যার নিরংকুশ একাধিপত্য আছে। শ্বেতরুশরা যেমন অ-রুশ ন্যাশনালিটির উপর ছড়ি ঘােরাত, অন্য ন্যাশনালিটিগুলির বিরুদ্ধে রুশদের লাগিয়ে দিত, জারতন্ত্রের নিরংকুশ শাসন বহাল রাখবার জন্য অ-রুশ জাতিসত্তাগুলির উপর নিপীড়ন চালাত ভারতবর্ষে সেই নিপীড়ক জাতিসত্তা (ন্যাশনালিটি) কোথায়? মনে রাখা প্রয়ােজন, মার্কসবাদ জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, এমন কী বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারের আলােচনা করেছে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার আলােচনা প্রসঙ্গে স্থান কাল ও পাত্রের কথা মনে রেখে। সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায় কোনও একটি জাতির শাসকেরা অন্যান্য জাতির দেশকে পরাভূত করে এমন রাষ্ট্র গড়ে তােলে, বা বেশ তালগােল পাকানাে এবং যে রাষ্ট্রে নিপীড়ক জাতি ও নিপীড়িত জাতির মধ্যে অনপনেয় অসঙ্গতি বর্তমান। ভারতবর্ষের কাঠামাে এমনকি মার্কসবাদী শাস্ত্ৰনুয়ায়ী এখনও ‘সাম্রাজ্যবাদী’ নয়। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও ক্রমহ্রাসমান । এই পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ ও জাতীয় সমস্যার সূত্রাবলী মেনে নিলেও বলতে হয় যে, ভারতের প্রত্যেকটি ন্যাশনালিটিরই স্বার্থ হল ভারতীয় ইউনিয়নকে শক্তিশালী করা, ভেদবুদ্ধিক নয়। বিশেষত ইতিহাসের এই পর্বে।

এখানকার কোন-কোনও রাজনৈতিক দল হয়তাে মুজিবর রহমানের বাংলা দেশের মুক্তিসংগ্রাম দেখে উৎসাহিত হয়েছে মনে রাখা দরকার পাকিস্তানে কোনদিনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, স্বৈরতন্ত্রের শাসনেই রয়েছে জনমঅবধি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে সেনা বাহিনীতে প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাঞ্জাবীদের একাধিপত্য রুশ দেশে যেমন ছিল শ্বেত রুশদের। মুজিবর রহমান তাই ৬ দফা দাবি তােলেন। এই ৬ দফা দাবি ছিল পূর্ববাংলার জাতীয় দাবি এবং কলােনি হিসাবে পূর্ববাংলাকে শােষণের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবি। এ দাবির ভিত্তিতে মুজিবর রহমান ও তার পার্টি পূর্ববাংলার বিধান সভায় এবং পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। ঐ ৬ দফা দাবি পাকিস্তানের জাতীয় দাবি হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ১২ কোটি পাকিস্তানবাসীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এই দাবির পিছনে সমবেত হয়। তারপর যা ঘটে তা নির্মম-করুণ। লক্ষ লক্ষ পূর্ব বাংলারর মানুষ ইয়াহিয়া শাহীর বলি হয়। সঙ্গে সঙ্গে দাবি ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাই। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পারটি প্রচারে ও বক্তৃতায় আজকাল বলে, পশ্চিমবঙ্গকে দিল্লির কলােনি করা যাবে। নিউ দিল্লিতে কোন বৃহৎ জাতির শােষক সরকার’ প্রতিষ্ঠিত? মারােয়াড়ি জাতি, হিন্দুস্থানী জাতি? কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনে, সৈন্যবাহিনীতে এবং অন্যত্র এই হিন্দুস্থানী জাতিরই কী একাধিপত্য? এ দেশে কী 

একমাত্র হিন্দুস্থানী ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃত? অ-হিন্দুস্থানী এলাকাগুলিতে কী বিধান সভা, হাইকোর্ট আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদানকারী বিদ্যায়তন, কিছুই নেই? কেন্দ্রীয় পারলামেন্টে কী বাঙ্গালী মারাঠী তামিল প্রভৃতি ন্যাশনালিটির সদস্য পাঠাবার কোন অধিকার নেই? দিল্লিতে কী “ইহুদি চৌহদ্দির মতাে বাঙ্গালী তামিল ও অন্যান্য ন্যাশনালিটির মানুষদের কোন নির্দিষ্ট এলাকার বাস করতে বাধ্য করা হয়? দিল্লি কী স্বৈরতান্ত্রিক সামরিকশাহীর দুর্গবিশেষ, না কী ভারতীয় জনসাধারণের ভােটে গঠিত সার্বভৌম পারলামেন্টের পীঠস্থান।  পূর্ববাংলার ৬ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন এবং পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম থেকে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পারটি যান্ত্রিক সাদৃশ্যই শুধু টেনেছে। আওয়ামী লীগ হল পাকিস্তানের নির্বাচনবিজয়ী জাতীয় দল। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পারটি পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের শক্তিশালী আঞ্চলিক দল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ টেকে না। বাঙ্গালীরা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৭ কোটি) অতএব বাঙ্গালার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ কী ভাবে আসে? সংখ্যাগরিষ্ঠরা কী নিজের দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়? মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি যখন কেরল ও পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকিয়ে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারের। কথা বলে তখন বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ সঙ্গতভাবেই আসে। কেন না সাড়ে চার কোটি বাঙ্গালী ও আড়াই কোটি কেৱলবাসীর ৫৫ কোটি ভারতবাসীর উপর নিজেদের মতাে চাপানাের অধিকার নেই। ইতিহাসের এমনই পরিহাস যে, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে আজ অঞ্চলসর্ব জাতিপাতিচেতনাকে সুরসুরি দিয়ে জাগিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। দুনিয়ার শ্রমিক এক হও” এই শ্লোগান আজ আর শ্রুত হয় না। তার জায়গায় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি আজ বাঙ্গালী জাগাে, কেরল জাগো-র পার্টি। যে পথ ধরে এবং এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে চলতে চাইছে তা দেশপ্রেম ও সমাজতন্ত্রের পথ নয়। মার্কসবাদী তত্ত্বানুসারী পথও নয়। এ পথের সঙ্গে আমাদের স্বদেশের ইতিহাস সভ্যতা ও সাধনারও কোন সঙ্গতিও নেই। এ জন্য যখন বাংলাদেশের উদাহরণ, অন্য স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে আরােপ করে, আমাদের লােকপ্রকৃতির বা সমাজ গঠনের সঙ্গে ভেজাল মার্কসবাদী মিথলজির সঙ্গতিসাধন-এর চেষ্টা হয় তখন তা মেনে নেওয়া সহজ নয়।

১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা