You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সমস্যার রূপান্তর (১)

–আবদুল গাফফার চৌধুরী

একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিকদেশ হিসেবে অ্যুদয় ঘটার পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু কথাটির অর্থ ও প্রকৃতি আমূল পাল্টে গেছে। পাকিস্তান, একটি ধর্মরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যতদিন এই ধর্মরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ছিল, ততদিন সংখ্যালঘু বলতে বােঝাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের । কিন্তু পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে জন্মলাভের পর বাংলাদেশে মুসলমান হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান প্রভৃতি ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন পার্থক্য রইল না। সকলেই এখন বাঙালী। এখন সংখ্যালঘু বলতে বােঝায় বাংলাদেশে বসবাসকারী বহিরাগত উরদুভাষী অবাঙালীদের। এখন যে সংখ্যালঘু সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে, সেই সমস্যরি কেন্দ্র এই বহিরাগত এবং ভিন্ন ভাষাভাষী অবাঙালীরা। বাংলাদেশে এদের ঘরবাড়ি, বিষয়সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও গত চব্বিশ বছর ধরে এদের স্থায়িভাবে ‘মােহাজের’ (শরণার্থী) নামে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। এবং বাঙালীদের সঙ্গে একত্রে বসবাস, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন—এমন কি, বাঙলা ভাষা শিক্ষার ব্যাপারেও অনুৎসাহী করা হয়েছে। ফলে বাঙালী মুসলমান ও অবাঙালী মুসলমানদের মধ্যে ভাষাবিরােধ, শিক্ষা-বিরােধ, ব্যবসাবাণিজ্যগত বিরােধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরােধ ও বিভেদ বাড়ছিল গত চব্বিশ বছর ধরেই। যে। বিরােধ ও বিভেদের চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গেছে গত মার্চ মাসে বাংলাদেশে অসহযােগ আন্দোলনের সময় বাঙালী-অবাঙালী বিরােধ এবং শেষ পর্যন্ত পঁচিশে মার্চের পর জেনারেল টিক্কার বাঙালী-নিধন অভিযানে উরদূভাষী অবাঙালীদের একটা উল্লেখযােগ্য অংশের অংশ গ্রহণে। ফলে উরদূভাষী অবাঙালীদের সম্পর্কে বাঙালীদের মনের এতদিনের পুঞ্জীভূত সন্দেহ ও অবিশ্বাস এখন কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিশােধ-স্পৃহায় রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশ হানাদারদের কবলমুক্ত হওয়ার পর তাই সাময়িকভাবে হলেও অবাঙালী সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। এই অবাঙালীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই নিরপরাধ, নির্দোষ এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু এখন এরা পাকিস্তানের সামরিক চক্রের ডিভাইড এনড রল পলিসি এবং নিজেদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একটা বড় অংশের রাজনৈতিক দুস্কৃতি ও কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত নীতির শিকার হয়ে পড়েছেন।

এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশে এই বিপুল সংখ্যক অবাঙালী সংখ্যালঘুর ভবিষ্যৎ কী? চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে মুখ্যত ভারতের বিহার রাজ্য এবং যুক্তপ্রদেশ, মাদরাজ, বােমবাই ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সরকারী উদ্যোগে বাংলাদেশে বাঙালী ও অবাঙালীগের মধ্যে বিরােধ ও বিভেদের বীজ বপন করা হয় এবং তা করা হয় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু রাজনৈতিক চেতনা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের কাজে এই অবাঙালী মােহাজের সম্প্রদায়কে করাচী বা পিনডির বিভেদ-নীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্য নিয়ে। উরদূভাষী অবাঙালী সন্তানেরা বাংলা ভাষা শিখলে বাঙালীদের সঙ্গে তাদের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যাবে এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে কালক্রমে তারা নিজেদের বাঙালী বলে ভাববে এবং বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকারকেই নিজেদের স্বার্থ ও অধিকার বলে ভাবতে শিখবে, এই ভয় থেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন সময়ের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশে বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিরুদ্ধভাবাপন্ন এবং বাঙালীদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, এমন একটি “মােহাজের’ নামধারী স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ঘটানাের জন্য গত চব্বিশ বছর ধরে চেষ্টা করেছেন এবং তাতে বড় রকমের সাফল্যও অর্জন করেছেন। করাচী ও পিনডির এই চক্রান্তে মদ জুগিয়েছেন এই অবাঙালীদের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি-যেমন মওলানা রগিব আহসান, অধ্যক্ষ হােসেন ফাতেমী, উরদূভাষী। সাংবাদিক নকভী, সালাউদ্দিন মাহমুদ, মােল্লা মওদুদীর, জামাতে ইসলামীর ধর্মান্ধ বাঙালী নেতারা এবং ঢাকার উরদূভাষী নবাব পরিবারের কর্তারা। নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এরা বাংলাদেশে পুনর্বাসিত অবাঙালীদের মধ্যে বাঙালী বিদ্বেষ প্রচার শুরু করেন-যে প্রচারের মূল কথা ছিল, বাঙালী মুসলমানেরা খাটি মুসলমান নয়। তারা হিন্দুদের ভাষা ও সংস্কৃতির অনুরাগী এবং নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় থেকে তাদের উৎপত্তি। বাঙালী মুসলমানেরা ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের চাইতে হিন্দু ভারতের প্রতি অধিক অনুরক্ত। তারা ইসলামী ভাষা উরদু পছন্দ করে না, হিন্দু ভাষা বাংলা পছন্দ করে এবং ইকবালের নাগমা ও মুশায়েরার চাইতে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা ভালবাসে। বলা বাহুল্য, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত বহিরাগত মুসলমানদের মধ্যে এই প্রচারণা অত্যন্ত কাজ দেয় এবং বাঙলা ভাষা শিক্ষা ও বাঙালী মুসলমানদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে তারা অনুৎসাহী হয়ে ওঠে—এমন কি, বাঙালী মুসলমানদের তারা রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হেয়জ্ঞান করতে শুরু করে। সংরক্ষণ কারীদের প্রস্তর নিক্ষেপে বিধ্বস্ত হয়।

এরপর ঢাকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের (তখন পূর্ববঙ্গ) তৎকালীন গবরনর স্যার ফিরােজ খান নুন এক সভায় হঠাৎ মন্তব্য করেন, ‘বাঙালী মুসলমানেরা তাদের ত্বকচ্ছেদ করে না এবং সন্তানের নামকরণের সময় তারা হিন্দু ব্রাহ্মণের বাড়িতে যায়। এই মন্তব্যের বিরুদ্ধেও তীব্র ছাত্র বিক্ষোভ হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ভােজসভায় আমন্ত্রিত হয়েও ফিরােজ খান নুন হাজির হতে পারেননি। বাঙালী মুসলমানের মনে শেষ আঘাত করা হয় জেনারেল আইয়ুব খাঁর আত্মজীবনী ‘প্রভু নয় বন্ধু’ পুস্তকের মন্তব্যে। জেনারেল আইয়ুৰ এই বইয়ে লেখেন বাঙালী মুসলমানদের উৎপত্তি বহুযুগের পরপদানত, অনুন্নত ও নিম্ন শ্রেণীর বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে সুতরাং তারা দাস-মনােভাব থেকে এখনও মুক্ত হয়নি এবং স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধিতে অক্ষম! তারা এখনও বর্ণ হিন্দুদের সামনে জুতাে পায়ে এবং ছাতা মাথায় হাটে না। জেনারেল আইয়ুবের এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ বেরােয় ঢাকার কয়েকটি সংবাদপত্রে। বুদ্ধিজীবীরাও প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন এবং পিনডি সরকার শেষ পর্যন্ত সংবাদপত্রে এই প্রতিবাদ প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেন। 

এই ধরনের প্রচার এক দিকে যেমন বাঙালীদের চরম বিক্ষুব্ধ করেছে, অন্য দিকে তেমনি তাদের সম্পর্কে অবাঙালী মুসলমানদের মনে হীন ধারণা ও বিরূপ মনােভাব জাগাতে সাহায্য করেছে। ফলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নিপীড়ন কিংবা সাংস্কৃতিক দমন নীতির ক্ষেত্রে অবাঙালী মুসলমানদের একটা বড় অংশ | বাঙালী মুসলমানদের দাবি-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল হননি, বরং পাকিস্তানী শাসকচক্রকে সমর্থন জুগিয়েছেন। অবাঙালীদের দ্বারা পরিচালিত এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র মর্নিং নিউজ, ইয়ং পাকিস্তান পাসন, করাচী ও পিনডির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিভিন্ন সময়ে ফজলুল হক, সােহরাওয়ারদী ও শেখ | মুজিবকে দেশদ্রোহী ও ভারতের চর আখ্যা দিয়েছেন এবং বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচারকার্যে অংশ গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান সংখ্যালঘু সমস্যার এটা হচ্ছে রাজনৈতিক পটভূমি।

২৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!