You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.15 | আদর্শ নয় স্বার্থ  বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের এই ভূমিকা কেন -আবদুল গাফফার চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক

আদর্শ নয়, স্বার্থ  বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের এই ভূমিকা কেন

–আবদুল গাফফার চৌধুরী

বাংলাদেশ প্রশ্নে নয়াচীনের ভূমিকার একটি সাধারণ ব্যাখ্যা অনেকেই দিয়ে থাকেন। ব্যাখ্যাটি হল এশিয়ায় ভারতের প্রভাব হ্রাস ও নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির স্বার্থে একেবারে ভারতের দুয়ারেই পাকিস্তানের মত একটি বৈরী রাষ্ট্র তার অবাস্তব ও অস্বাভাবিক অখণ্ডতা নিয়ে টিকে থাকুক এবং শুধু টিকে থাকা নয়; ভারতকে সর্বক্ষণ যুদ্ধের হুমকির মুখে বিব্রত রেখে চীনকে নিরুদ্বেগে এশিয়ায় তার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য ও রাজনৈতিক মুরুব্বিয়ানা প্রতিষ্ঠার অব্যাহত সুযােগ দিক, এটাই পিকিংয়ের কর্তাদের আসল মতলব। চীনের আসল মতলবের এটা একটা সাধারণ ব্যাখ্যা। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে নয়াচীনের বর্তমান ভূমিকা এবং সরাসরি সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য বিরােধিতার অন্তরালে কোন আদর্শ নয়, সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্যের সঙ্গে একেবারেই সংকীর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ কাজ করছে। এ সত্যটি বাংলাদেশের বাইরে অনেকের কাছেই হয়ত স্পষ্ট নয়।

ত্রিশের জারমানীতে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের তাগিদে রাজনৈতিক প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য নাৎসীবাদের অ্যুদয়। প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজিত ও বিধ্বস্ত জারমানী দ্রুত আত্মসম্প্রসারণের জন্য গণতন্ত্রের মুখােশ ফেলে দিয়ে নাৎসীবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। দীর্ঘকাল জাপানী আক্রমণ ও গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত নয়াচীন কম্যুনিসট শাসনপদ্ধতি গ্রহণ করার পরও এশিয়ায় দ্রুত বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ও তার পূর্বশর্ত হিসাবে রাজনৈতিক প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য ত্রিশের জারমানীর পথ অনুসরণ করতে চাইবে কিনা, এটা চীন সম্পর্কিত পাশ্চাত্ত্য বিশেষজ্ঞদের অনেকের কাছেই একটা বহুদিনের প্রশ্ন। সােভিয়েট ইউনিয়ন ইউরােপে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান এবং পরস্পরের প্রভাব-বলয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করায় নয়াচীন এই নীতিকে “সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ” আখ্যা দিয়ে নিন্দা করেছে।  অনুরূপভাবে নয়াচীন এশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহ-অবস্থান এবং নিজ নিজ প্রভাব-বলয়ের সীমাসম্প্রসারণের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযােগে এশিয়ার কোন কোন দেশে জাতীয় বিপ্লব ও মুক্তি যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরােধিতা করার নীতি গ্রহণ করায় একে সামাজিক নাৎসীবাদ’ আখ্যা দেওয়া যায় কিনা, এই প্রশ্নটিও। নিশ্চয় ভেবে দেখার মত।  আমাদের প্রসঙ্গটি তাত্ত্বিক নয়, নেহাত বৈষয়িক। বাংলাদেশ সমস্যায় নয়াচীনের যে ভুমিকা, তাকে আদর্শের আলখেল্লা দিয়ে যতই মােড়ানাে হােক, এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খর সঙ্গে সংকীর্ণ বৈষয়িক স্বার্থ।

এই বৈষয়িক স্বার্থহানির আশঙ্কায় পিকিংয়ের নেতারা সকল আদর্শ ও নীতি কথা ভুলে পিনডির ফ্যাসিস্ট সমরচক্রকে সমর্থন দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। বাংলাদেশর গত এক যুগের আর্থিক কাঠামাের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলা দেশ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি বিশেষপণ্য ও ব্যবসায়ের একচেটিয়া বাজার, বলতে গেলে মনােপলি মারকেট। এই পণ্যের মধ্যে রয়েছে সূতাবস্ত্র, পশমবস্ত্র, ওষুধ, বেবী ফুড, সর্বপ্রকার চামড়ার তৈরি জিনিস (যেমন, জুতাে, বেল্ট, ব্যাগ, স্যুটকেশ) সাবান, বনস্পতি তেল, সর্বপ্রকার প্রসাধন দ্রব্য, হালকা যন্ত্রপাতি, সিমেন্ট ও অন্যান্য গৃহনির্মাণ সামগ্রী, লােহা, পেরেক ইত্যাদি। বড় ব্যবসায়ের সঙ্গে ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স ব্যবসাও পশ্চিম পাকিস্তানী বড় ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া দখলে। কিন্তু গত বার বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের পরই যে দেশটির আমদানিকৃত দ্রব্য বাংলাদেশের বাজার ভরে ওঠে, সে দেশটি হল নয়াচীন। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ এবং ১৯৬৫  সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান ও নয়াচীনের যৌথ বাণিজ্যিক উপনিবেশে পরিণত হয়। আগে বাংলাদেশের ছাপাখানার মালিকেরা প্রধানত আমেরিকা, জারমানি ও জাপান থেকে উন্নত মুদ্রণযন্ত্র এনে তাদের ছাপাখানা উন্নত ও আধুনিকীকরণের ব্যবস্থা করত, ছােট মাঝারি ছাপাখানাগুলাে ভারত থেকে তুলনামুলক সস্তাদামে ট্রেড়ল মেসিন, প্রুফ-মেসিন, টাইপ, সীসা ইত্যাদি সংগ্রহ করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখত। ভারত-বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যােগাযােগ বন্ধ হওয়ার পর বহু ছােট ছােট ও মাঝারি ছাপাখানা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান লুপ্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশের ছােট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সংকটের সুযােগ গ্রহণ করে নয়াচীন। দুপেনিয়ামের উপর নির্মিত। হালাক ডবল-ডিমাই ও ডিমাই সাইজের প্রিন্টিং মেশিন, ট্রেড্রল মেসিন ও প্রুফ তােলার মেসিনে বাংলাদেশ ভরিয়ে দেওয়া হয়। নিকৃষ্ট অথচ দামে কম এই মেসিনের প্রতি বাঙালী ছােট ও মাঝারি ছাপাখানার মালিকেরা সহজেই আকৃষ্ট হন।

এছাড়া অন্য যে-সব পণ্য পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হয় না,সে। সব চীন পণ্যে বাংলাদেশ ভরে ওঠে। যেমন অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি, সূচ, আলপিন, ডটপেন, রিফিল, ঘড়ির। চেন, ব্যানড, সাদা কাগজ, চায়ের কাপ ডিস প্লেট। অন্যান্য তেজস পত্র, স্ট্যাপলার, লেখার কালি, ফাউনটেনপেন, সাইকেল মেরামতের খুচরাে যন্ত্রপাতি, টাইম পিস্, ওয়াল ক্লক সর্বপ্রকার স্টেশনারী দ্রব্য, থার্মোমিটার, হালকা কৃষি ও ইঞ্জিনীয়ারিং যন্ত্রপাতি প্রভৃতি। ভারতীয় দ্রব্য আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে এবং কোন কোন দেশের উৎকৃষ্ট পণ্যকে প্রতিযােগীয় নামতে না দিয়ে চীনা পণ্যের উপর বাণিজ্যিক বিধি নিষেধ ও শুল্ক হ্রাস করে তা যথেষ্ট সস্তায় বিক্রি করার সুযােগ দেওয়ার সম্পূর্ণ আমদানি-নির্ভর বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান ও নয়াচীনের প্রায় একচেটিয়া পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। বড় বড় ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি বড় পরিবার ও পাশ্চাত্যের কোন কোন দেশের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে ছােট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে চলে বাঙালী উৎসাদনের অভিযান। ১৯৬৮ সালে ঢাকা চেমবার অব কমারসের জনৈক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে সংবাদ পত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন- “পাকিস্তানে—এমনকি বাংলাদেশেও বড় ব্যবসায়ে বাঙালীর কোন অংশীদারিত্ব নেই। মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রেও আমাদের উদ্যোগ ও উৎসাহ ধ্বংস করাই হচ্ছে। দেশের সবগুলো বড় ব্যাংক পশ্চিম পাকিস্তানীদের কুক্ষিগত থাকায় তাদের ক্রেডিট ফেসিলিটি ও পলিসি আমাদের স্বার্থের অনুকুল নয়। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে আদ্ৰন্তরীণ প্রয়ােজন মেটানাের জন্য একটা আলপিন তৈরির সুযােগও আমাদের দেওয়া হবে না। পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে-সব পণ্য। বাংলাদেশের বাজারে পাটাতে পারছে না, সেগুলাে আসছে চীন থেকে। আমরা একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক বা কলােনি এবং অন্যদিকে যৌথ ভাবে পশ্চিম পাকিস্তান ও নয়াচীনের রফতানি বাজার। বর্তমানে কাঁচামাল রফতানি ছাড়া আমাদের অন্য কোন ভূমিকা নেই-কিন্তু রফতানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও পিডির হাতে, আমাদের হাতে নয়।” ঢাকার বাজারে গত জুন মাস পর্যন্ত কোন্ কোন্ বিদেশী পণ্যের তুলনায় চীনা পণ্যের দাম কত ছিল, তা উল্লেখ করলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

একটি ব্রিটিশ থার্মোমিটার-সাড়ে চার টাকা (পাকিস্তানী মুদ্রার হিসাবে) একটি চীনা থারমােমিটার- ৭৫ পয়সা। একটি ইতালিয়ান ডটপেন-সাড়ে তিন টাকা একটি ভালাে চীনা ডটপেন-এক টাকা। সাধারণ চীনা ডটপেন- ৩৫ পয়সা। একটি জাপানী স্টীল ব্যানড (ঘড়ির)- আট টাকা থেকে নয় টাকা। একটি চীনা স্টীল ব্যানড (ঘড়ির) এক টাকা থেকে আড়াই টাকা। চীনা ফাউনটেন পেনের কালি-৬২ পয়সা। বিয়ারের বােতল (মারীতে তৈরি) নয় টাকা বিয়া বােতল চীনে তৈরি- (দেড় টাকা)। একটি জাপানী ডবল ডিমাই ছাপার মেসিন (ফ্লাট বেড)- ২৩ হাজার টাকা। একটি চীনা ডবল ডিমাই ছাপার মেসিন (ফ্লাট বেড)- ৯ থেকে ১২ হাজার টাকা।  এখানে উল্লেখ্য যে চীনে তৈরি জিনিসপত্র বাংলাদেশে আসতে শুরু করার সময় এর দাম আরও কম ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী আমদানিকারকরা এগুলাে আমদানি করার পর বাংলাদেশে রি-এক্সপােরটের ব্যবসা শুরু করেন এবং প্রতিটি আমদানি কৃত আইটেম শতকরা শত ভাগ মুনাফা লুটতে থাকেন। | সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারী হয়েছে চীনা কয়লা নিয়ে। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পর বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কলকারখানার উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালেই বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সংবাদপত্র ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক পুনস্থাপন এবং তুলনামূলক ভাবে অনেক কম দামে ভারতীয় কয়লা বাংলাদেশে আমদানির ব্যবস্থা করে উন্নয়ন ও উৎপাদনের শ্লথ গতি পুনরায় চাঙ্গা করার দাবি তােলেন। পিনডির জঙ্গীচক্র এই দাবিতে কর্ণপাত করেননি। বরং সাত সমুদ্র ঘুরে চীনা কয়লা অনেক বেশি দামে এনে বাংলাদেশের জ্বালানি সমস্যা ও কলকারখানার চাহিদা মেটানাের নীতি অব্যাহত রাখেন।

এই কয়লার দাম বেশি এবং বহুদূর থেকে সরবরাহ অনিশ্চিত হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দার বাব বাড়তে থাকে এবং ব্যবসায়ীমহলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক চালু করা এবং ভারতে পাট ও মাছ রফতানি এবং সেখান থেকে বাংলাদেশে তুলা, কয়লা কাঠ প্রভৃতি আমদানি সুযােগ দেওয়ার দাবি তীব্র হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ডানপন্থী সংবাদপত্র যেমন ‘পাকিস্তান অবজারভার’ ও পূর্ব দেশ পর্যন্ত এই সময় সম্পাদকীয় স্তয়ে বলা হয়, রাজনৈতিক বিরােধ সত্ত্বেও যদি কোন কোন কম্যুনিস্ট ও অ-কমিউনিস্ট দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে, তা হলে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে কেন বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক চালু হবে না; এই স্বাভাবিক বাণিজ্য-সম্পর্ক চালু করা না হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকানাে যাবে না। ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তান যে আর সিডি বা আঞ্চলিক উন্নয়ন জোট গঠন করেছেন, ভৌগােলিক দুরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার জন্য বাংলাদেশ সেই জোট দ্বারা কিছু মাত্র উপকৃত হবে না। বাংলাদেশকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে তাকে প্রতিবেশী পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও বরমার সঙ্গে আঞ্চলিক উন্নয়ন জোট গঠন করতে দিতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে এশিয়ার নয়াচীনের একক বৃহত্রাষ্ট্রের ভূমিকা গ্রহণের উচ্চাকাচ্ছা পূরণের পথেই যে শুধু বাধা সৃষ্টি হল তা নয় আর আশু ক্ষতি একটি বিরাট একচেটিয়া বাজার হাতছাড়া হওয়া। তাছাড়া ক্যানটন ঢাকা বিমান পথের রাজনৈতিক ও সামরিক দূরত্বও কম নয়। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ যতই আদর্শ ও নৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হােক না কেন, আশু বৈষয়িক ও বাণিজ্যিক ক্ষতির আশঙ্কায় পিকিংয়ের পক্ষে সম্ভবত উচ্চকণ্ঠ না হয়ে উপায় নেই।

১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা