You dont have javascript enabled! Please enable it!

রবিবাসরীয় আলােচনা বাংলাদেশকে স্বীকৃতির পরে

–শংকর ঘােষ

ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বড়াই করে বলেছেন, এই যুদ্ধই হবে ভারত-পাকিস্তানের শেষ যুদ্ধ। যুযুৎসু, রাষ্ট্রনায়কদের মুখে এ কথা নতুন নয়। কিন্তু তাদের কেউই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি; এক যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আর একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করছেন। ইয়াহিয়া খানের স্তোকবাক্যকেও উড়িয়ে দেওয়া চলত। যে অর্থে তিনি এই আশ্বাস দিয়াছেন, সেই অর্থে। তা সফল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বর্তমান যুদ্ধে ভারতের মত বিরাট দেশ সর্বকালের জন্য এমন শক্তিহীন হয়ে পড়বে যার ফলে আর কোন দিন সে পাকিস্তানের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় সম্মত হবে না, এ বিশ্বাস সম্ভবত স্বয়ং ইয়াহিয়া-খানেরও নেই। ভারত আগ্রাসক নয়, কাজেই ভারতের পাকিস্তান বা অন্য কোন দেশকে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠে না। পাকিস্তান যদি ভারত পাকিস্তানের এই তথাকথিত শেষ যুদ্ধও লড়তে হত।  পাকিস্তান সরকার যতদিন ভারত বিদ্বেষকে তাদের মূলনীতি গণ্য করবেন, ততদিন ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা দূর হবে না। ভারতীয় মাত্রেই বিশ্বাস করেন, এই যুদ্ধে জয় তাদের হবেই। যশাের দখলের পর এই বিশ্বাস নিশ্চয়। দৃঢ়তর হবে। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী ও তাদের সবাইকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অগ্রগতি এখনই অপ্রতিহত যে, হয়তাে এই লেখা বেরুনাের আগেই এই রণাঙ্গনের যুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তাহলেও এ-যুদ্ধের পরিণতি কী হবে তা নিশ্চিতভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। তবে ইয়াহিয়া খান যে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে পড়বেন না সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। এটাই ভারত ও পাকিস্তানের শেষ যুদ্ধ, কারণ যে পাকিস্তানের সঙ্গে পৃথিবী গত চব্বিশ বছর ধরে পরিচিত, সে পাকিস্তান অবলুপ্তির পথে। তার ভৌগােলিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এই যুদ্ধের শেষে পশ্চিম পাকিস্তান কী চেহারা নেবে তার উপর জল্পনার অবকাশ আছে; এই যুদ্ধের সামগ্রিক পরিণতির উপর তা অনেকাংশে নির্ভর করছে। কিন্তু অতীতের পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমানের বাংলাদেশ সম্পর্কে আর কোন অনিশ্চয়তা নেই। 

আট মাসের সামরিক অত্যাচার সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের মুক্তি যােদ্ধাদের দমন করতে সক্ষম হননি; বরং এই আটমাসে তারা আরও শক্তি সঞ্চার করেছেন। যেখানে পাকিস্তান তার পূর্ণশক্তি প্রয়ােগ সত্ত্বেও সফল হয়নি, সেখানে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধরত পাকিস্তান খণ্ডিত শক্তির দ্বারা জয়লাভ করতে পারে না। বাংলাদেশে পাকিস্তানের এই সম্ভাব্য পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার পর। এই স্বীকৃতির ফলে মুক্তিবাহিনীর ভারতের কাছ থেকে সবরকম সাহায্য পাওয়ার কোন বাধা থাকল না। সে সাহায্য যে অবিলম্বে পৌছেছে তার প্রমাণ স্বীকৃতির আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়। | বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সে-সরকারকে মেনে নেওয়ার দাবি ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল থেকে তােলা হয়েছিল। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর যে-প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতেও বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই প্রতিশ্রুতির অর্থ অস্থায়ী সরকারকে মেনে। নেওয়া-একথা অনেকেই বারবার বলেছেন। বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকেও কয়েক বার স্বীকৃতির জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানানাে হয়। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী এতদিন এই দাবি পুরণ করেননি। তিনি অবশ্য কোনদিনই স্বীকৃতি দানের বিরােধিতা করেননি। স্বীকৃতির ঔচিত্য সম্বন্ধে কোনদিনই তাঁর সংশয় ছিল না, ছিল স্বীকৃতির সময় সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন, স্বীকৃতির সময় তখনই আসবে যখন স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণের কোন ক্ষতি হবে না।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, গত আট মাসে প্রধানমন্ত্রীর মতে যে সময় আসেনি, আজ হঠাৎ কী করে। সে সময় উপস্থিত হল। তার একটি কারণ ভারতের উপর পাকিস্তানের অতর্কিত ব্যপক আক্রমণ। যতদিন পাকিস্তানী আগ্রাসন ছােটখাট সীমান্ত সংঘর্ষ ও ইয়াহিয়া-ভূট্টোর বিষােদগারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ততদিন  প্রধানমন্ত্রী আপস আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব মনে করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, পাকিস্তান সরকার মুখে যাই বলুন না কেন, তারা ক্রমে বুঝবেন, সামরিক শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে খর্ব করা যাবে না। সুতরাং আপাত অনমনীয়তা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার একদিন বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিনিধি ও তাদের নেতা, শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আপস | আলােচনার প্রবৃত্ত হবেন। প্রধানমন্ত্রী যতদিন মনে করেছিলেন, এই সম্ভাবনা আছে, ততদিন তিনি বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া স্থগিত রেখেছিলেন। কারণ স্বীকৃতির অর্থ পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেওয়া, তারপর ভারত সরকার পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন সমাধানে সম্মত হওয়ার পরামর্শ বাংলাদেশের নেতাদের দিতে পারতেন না।

ভারত আক্রমণ করে ইয়াহিয়া খান চূড়ান্ত ভাবে জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোন রকম আলােচনা তিনি করবেন না। বাংলাদেশ সমস্যার শুরু থেকেই তিনি তাঁর মুরুব্বী দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযােগ রেখে এসেছেন এবং তাঁর ভারত আক্রমণের পরিকল্পনাও তাদের অজানা থাকার কথা নয়। তাঁদের পৃষ্ঠপােষকতায় তিনি এখন আবার একটি মেকি অসামরিক সরকার গঠন করতে চলেছেন। কাজেই এই সব দেশগুলি যে চাপ দিয়ে ইয়াহিয়া খানকে সংযত করবেন তারও আর কোন সম্ভাবনা যুদ্ধ ঘােষণার পর রইল না। আপস মীমাংসার সমস্ত পথ রুদ্ধ হওয়ার পরই ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করে নিয়েছেন। স্বীকৃতি দেওয়ার আরও একটি কারণ আছে ভারতের উপর ব্যাপক আক্রমণ করার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো বলতে শুরু করেছিলেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অঘােষিত যুদ্ধ চলছে। এই অঘােষিত যুদ্ধের জন্য তারা ভারত সরকারকে দায়ী করে রেখেছিলেন এবং পাকিস্তানী আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তারা বললেন, তাঁরা বা করেছেন তা আক্রমণ নয়, প্রতিআক্রমণ। নিরাপত্তা পরিষদের বিতর্কে দেখা গেছে, পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচারে বিশ্বাস করার জন্য ব্যগ্র দেশের অভাব নেই। আমেরিকা ও চীন সরাসরি ভারতকে আক্রমণকারী বলে ঘােষণা করেছে। এই আক্রমণের কী উদ্দেশ্য তা এই দুই দেশের প্রতিনিধিরা স্পষ্ট বলেননি। তবে নিরাপত্তা পরিষদে তারা যে-মনােভাব। দেখিয়েছেন, তাতে তারা যে কিছু দিনের মধ্যেই বলতে শুরু করবেন যে, বাংলাদেশকে গ্রাস করাই ভারতের উদ্দেশ্য তাতেও কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকার করে ভারত সরকার এই অপপ্রচারের পথ বন্ধ করেছেন। তারা জানিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানী আক্রমণের ফলে যে-যুদ্ধে তাঁরা লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছেন, তার উদ্দেশ্য পাকিস্তানের কোন অংশ গ্রাস করা নয়।

বাংলাদেশের মুক্তির পর বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিনিধিরাই সে-রাজ্য পরিচালনার ভার নেবেন। ভারত সরকার বারবার বলেছেন, তাঁরা। শুধু চান বাংলাদেশের এমন অবস্থার সৃষ্টি হােক, যাতে সে-দেশের এককোটি শরনার্থী আবার সসম্মানে ও নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে। তারা এখনও তার বেশি কিছু চান না এবং তাদের বিশ্বাস স্বাধীন। বাংলাদেশের সরকার হিসেবে যাদের স্বীকৃতি দেওয়া হল, তারা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার গ্রহণ করলে শরনার্থীরা সকলেই ফিরে যাবে। এক কথায়, স্বীকৃতি দানের মধ্য দিয়ে ভারত এই অবাঞ্ছিত যুদ্ধে তার লক্ষ্য ঘােষণা করেছে।  এ যুদ্ধ কতদিন চলবে, সে প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই দেখা গেছে, যে সব যুদ্ধে কোন বৃহৎ শক্তি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেনি, সে সব যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার অর্থ এই নয় যে, এসব যুদ্ধে অল্পদিনের মধ্যেই জয়পরাজয়ের চূড়ান্ত মীমাংসা হয়ে গেছে। বৃহৎ শক্তিগুলিই তাদের যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করেছে যাতে অনিচ্ছা সত্বেও তারা নিজেরা এই সব যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে। বৃহৎশক্তিগুলি যদি যুদ্ধ করা স্থির করে তাহলে তারা স্থান কাল স্থির করে অগ্রসর হবে, ছােটখাট দেশের বিবাদকে উপলক্ষ করে নিজেদের শক্তিক্ষয় করবে না। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও বৃহৎশক্তিগুলির জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রধানমন্ত্রী তাে ঘােষণাই করেছেন, তাদের সে রকম কোন অভিপ্রায় নেই। সুতরাং এ যুদ্ধ যাতে শীঘ্র বন্ধ হয়, তারজন্য বৃহৎ শক্তিগুলি উদ্যোগী হবে। নিরাপত্তা পরিষদে ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে আলােচনা হয়েছে। সেখানে কোন মীমাংসার সূত্র  অবিষ্কৃত না হওয়ায় রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদেও বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি হয়নি এবং এ সম্পর্কে আবার চেষ্টা শুরু হয়েছে। যতদিনে মীমাংসার সূত্র উদ্ভাবিত না হয় ততদিনই মাত্র এই যুদ্ধ চলবে। রণক্ষেত্রে এই যুদ্ধের মীমাংসা হবে মনে হয় না।

বাংলাদেশ ও ভারত দুয়ের পক্ষেই আগামী কয়েকদিন খুব গুরুত্বের। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধ। বিরতির যে-প্রস্তাব বিপুল ভােটাধিক্যে গৃহীত হয়েছে তা ভারত সরকার সঙ্গত কারণেই অগ্রাহ্য করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী তা পাকিস্তানের মুরুব্বীরা স্বীকার করতে রাজী নন বলে পাকিস্তানী সুরে সুর মিলিয়ে তারা বলেছেন ভারত ও পাকিস্তান তাদের সেনাবাহিনী অপসারণ করলেই শান্তি ভঙ্গের আশংকা দূর হবে। বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তানী নেতারা ইতিপূর্বে আলােচনায় সম্মত হলে যেমন এই যুদ্ধ বাধত না, তেমনি এখনও যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে আপস আলােচনার সুপারিশ করে কোন প্রস্তাব রাষ্ট্রপুঞ্জ গ্রহণ করে ও পাকিস্তান। সরকারকে সেই প্রস্তাবে রাজী করাতে পারে, তাহলে যুদ্ধ বিরতি হতে পারে। পাকিস্তানের মুরুব্বীরা যখন বুঝবেন এই পথের বিকল্প নেই, তখন হয়ত তারা পাকিস্তানের চৈতন্য উদয়ের জন্য উদ্যোগী হবেন। অন্যথায় স্বয়ং রাষ্ট্রপুঞ্জকেই রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে হবে, যেমন দুই দশক আগে কোরিয়ায় হতে হয়েছিল। বর্তমান অবস্থায় এই রকম কোন চাল সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাজেই রাষ্ট্রপুঞ্জ যে কদিন ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের গ্রাহ্য কোন প্রস্তাব উদ্ভাবন করতে না পারছে, তারমধ্যে গোটা বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশের যতখানি সম্ভব মুক্ত করতে হবে।  যুদ্ধ বিরতি হবে তকালীন সৈন্য সমাবেশের ভিত্তিতে, সুতরাং যুদ্ধ বিরতির প্রাক্কালে বাংলাদেশের যত খানি মুক্ত হবে, স্বাধীন বাংলাদেশের আয়তন তার চেয়ে কম হবে না। যে দুর্বার গতিতে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ নেতৃত্বে মুক্তি সেনারা এলাকার পর এলাকা মুক্ত করে আজ ঢাকার প্রান্তে পেীছেছেন, তাতে মনে হয় রাষ্ট্রপুঞ্জে পরবর্তী পদক্ষেপের আগেই সারা বাংলাদেশ মুক্ত হবে এবং সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান জাতিসভায় বাংলাদেশ নামে ও পৃথিবীর নবতম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে।

১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!