বিশ্লেষণ বিচার সমীক্ষা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে যুদ্ধবিরতি নয়
–শংকর ঘােষ
রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ও নিরাপত্তা পরিষদে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ যুদ্ধের উপর একদফা আলােচনা হয়ে গেল। এই যুদ্ধে বাংলাদেশও যে এক শরিক তা রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বীকার করেনি; করতে পারেও না, কারণ তা হলে নিতে হয় যে খানেদের পাকিস্তান খান খান হয়েছে। | রাষ্ট্রপুঞ্জে যেমন একদিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে বিশ্বাসী তেমনি অন্যদিকে বিশ্বাসী সদস্য রাষ্ট্রগুলির ভৌগােলিক অখণ্ডতায়। বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিরােধ প্রধানত এই দুই মৌলিক ধারণার অন্তর্দ্বন্দ। বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে বিশ্বাস করেন, যারা মনে করেন গত আট মাসের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রমাণ করেছেন এই অধিকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। তারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা এই সগ্রামের সফলতা কামনা করছেন, যদিও তারা জানেন মুক্তি সংগ্রামের সাফল্যের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিকাংশ সদস্যই এই মতাবলম্বী নন। তারা অগ্রাধিকার দিয়েছেন সদস্য রাষ্ট্রগুলির ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষার দায়িত্বকে। তার ফলে বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তক্ষয় তাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে। ভৌগলিক পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে তারা বর্তমানের বাস্তবকে অস্বীকার করেছেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অভূতপূর্ব অত্যাচার মাফ করেছেন। অবশ্য সব রাষ্ট্রই যে বাংলাদেশ সমস্যাকে এই দুই আপাতবিরােধী নীতির লড়াই হিসাবে দেখেছেন তা নয়। ত দেখলে তারা হয়ত বুঝতেন, যে-ভৌগােলিক সত্তা রক্ষার জন্য লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ নিঃসহায় নরনারীকে হত্যা করতে হয় এবং এক কোটি লােককে সর্বস্বান্ত অবস্থায় দেশ ত্যাগ করতে হয় সে-সত্ত্বার পিছনে কোন নৈতিক যুক্তি থাকতে পারে না। এই গণ-দুর্দশাই প্রমাণ করে সেই ভৌগােলিক সত্ত্বা জনসাধারনের অভিপ্রেত নয়।।
যদিও রাষ্ট্রপুঞ্জে যখন কোন সমস্যা উপস্থাপিত হয় তখন সদস্য রাষ্ট্রগুলির সেটিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের কষ্টিপাথরে বিচার করার কথা, কার্যক্ষেত্রে তা খুব কম সময়েই ঘটে। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিকাংশ সদস্যই সমস্যাটির বিচার করেন তাদের নিজস্ব জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে, রায় দেন সেইভাবে যাতে তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যারা স্বাধীন বাংলাদেশকে তাঁদের জাতীয় স্বার্থের প্রতিকূল মনে করেন তারা পৃথিবীর এই নবতম রাষ্ট্রের অস্তিত্বই স্বীকার করেননি; সাড়ে সাত কোটি লােকের দাবিকে অগ্রাহ্য করে তারা বর্তমান যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে দুই দেশকে অস্ত্রসংবরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এই উপমহাদেশের বাস্তবকে উপেক্ষা করতে যাদের বিবেকে বেধেছে, যাঁরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীর বৃহত্তম মুক্তি সংগ্রামকে একটি নিছক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলে মনে করেননি তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের যে-প্রস্তাব পাশ হয়েছে তার বিরােধিতা করেছেন।
যে অল্প কয়েকটি দেশ কোন পক্ষেরই সামিল হয়নি তার মধ্যে আছে বৃটেন ও ফ্রান্স। নতুন ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠাতা দ্য গল গেছেন, কিন্তু তার প্রভাব এখনও আছে। দ্য গল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সকে আমেরিকা। ও বৃটেনের ল্যাংবােটে পরিণত হতে দেন নি। একালের মিত্রদের সমস্ত দ্রুকুটি উপেক্ষা করে তিনি স্বতন্ত্র নীতি অনুসরণ করেছিলেন; তিনি যে ভুল করেননি তার প্রমাণ ফ্রান্সের বর্তমান সমৃদ্ধি। রাষ্ট্রপুঞ্জে ফ্রান্স যে আমেরিকা ও চীনের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠের নির্দেশ মেনে নেয়নি তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বৃটেনের নিরপেক্ষতা আশ্চর্যকর। পাকিস্তান বৃটেনের সৃষ্টি এবং ভারত-পাকিস্তান বিরােধে বৃটেন তার এই মানসপুত্রটিকে বরাবর সমর্থন করে এসেছে। অথচ এবার যখন পাকিস্তানের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন তখন বৃটেন নিরপেক্ষ । এর একটি কারণ হতে পারে, এই উপমহাদেশের অভ্যন্তরিক অবস্থার সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয় থাকার ফলে বৃটেন বুঝেছে, বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করে কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করলে ভারত তা প্রত্যাখান করবে। আর ভারত প্রত্যাখ্যান না করলেও সে যুদ্ধবিরতি অর্থহীন হবে কেননা বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা সে-প্রস্তাব মানবে না। রাষ্ট্রপুঞ্জে নিরপেক্ষ থেকে বৃটেন সম্ভবত যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তার মধ্যস্থতার পথ খােলা রেখেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্যদের যে বিরাট অংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য অপসারণের পক্ষে রায় দিয়েছেন, তাদের চাই আমেরিকা ও চীন। এই দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে ছেটখাট যেসব দেশ জোট বেধেছে তারা সকলেই যে এক কারণে পৃথিবীর বৃহত্তম ইসলামিক রাষ্ট্রের দ্বিধাবিভক্তি চায় না, কেউ হয়ত নিজের অভ্যন্তরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে এমন কিছু করতে চায় না যার প্রভাব তার নিজের এলাকার গণ-আন্দোলনের উপর পড়তে পারে।
এই সব সঙ্কীর্ণ স্বার্থ বুদ্ধিকে সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযােগ দিয়েছে চীন ও আমেরিকা। আমেরিকা ও চীনের মধ্যে কে কাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তা নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে। যদিও চীনের সঙ্গে আপস আলােচনায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে আমেরিকার উপস্থিতির অবসানের পর এই অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলির কী ভুমিকা হবে সে সম্বন্ধে চীন আমেরিকার একটি প্রাথমিক আলােচনা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে হয়েছে এবং যদিও আমেরিকা ও চীন। দুজনেই ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তিকে তাদের পরিকল্পিত শক্তিসাম্যের বিঘ্নস্বরূপ মনে করে তাহলেও বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে তাদের মনােভাব শুরু থেকে এক নয়। আমেরিকার আগেই চীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরােধিতা করেছে। মুক্তি সংগ্রামের প্রথম তিনমাস আমেরিকা সে সম্বন্ধে নীরব ছিল এবং অন্য অনেক দেশের মতােই এটিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরিক সমস্যা বলে অভিহিত করেছিল। আমেরিকার মনােভাব পরিবর্তনের প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পায় প্রেসিডেন্ট নিকসনের ব্যক্তিগত দূত হিসাবে ডঃ কিসিংগারের প্রথম চীন সফরের পর। ডঃ কিসিংগার দ্বিতীয়বার পিকিং যান যখন শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী য়ুরােপ-আমেরিকা সফর করছেন। সকলেরই স্মরণ থাকার কথা যে, ডঃ কিসিংগারের প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই আমেরিকা খােলাখুলিভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করছে। এই ঘটনা পরম্পরা থেকে সন্দেহ হতে পারে, আমেরিকার মনােভাবের পিছনে চীনের প্রভাব আছে। আগামী বছরে নির্বাচনে জেতার জন্য প্রেসিডেন্ট নিকসনের প্রয়ােজন ভিয়েতনাম থেকে সৈন্যাপসারণ।
এই অপসারণের মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হবে যদি তার ফলে ইন্দোচীন দেশগুলির বর্তমানের অস্থির ও অনিশ্চিত শান্তি ও বজায় না থাকে। তার জন্য আমেরিকার প্রয়ােজন চীনের সহযােগীতার। চীন এই সহযােগীতার মূল্য চায় । | যে-ঘটনা সমাবেশে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হতে চলেছে তার প্রভাব বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের নীতির উপর অনিবার্য। সে-সরকার স্বভাবতই ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্প্রীতি রেখে চলবে। চীন মনে করে এই শক্তি সমন্বয় তার পক্ষে ক্ষতিকর হবে। তাই আমেরিকার সহায়তায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সে ব্যর্থ করতে আগ্রহী। প্রেসিডেন্ট নিকসন চীনের সঙ্গে সমঝোতা করতে এত ব্যগ্র যে তিনি সহযােগীতায় রাজী হয়েছেন। আমেরিকায় সর্বশেষ কয়েকটি ঘটনা থেকে মনে হয় তিনি এ বিষয়ে বিশেষ কয়েকজন ছাড়া আর কারাের সঙ্গে পরামর্শ পর্যন্ত করেননি। চীনা মনােভাবের আরও একটি কারণ থাকতে পারে, যার ইঙ্গিত রাষ্ট্রপুঞ্জে চীনা প্রতিনিধি দিয়েছেন। তিনি তিব্বতে বিদ্রোহী বিভেদকামীদের সাহায্য করার জন্য ভারতের উপর দোষারােপ করেছেন; তেমনি করেছেন সােভিয়েট ইউনিয়নের উপর সিংকিয়াং অঞ্চলে তথাকথিত রুশ হস্তক্ষেপের জন্য। চীনের ভয় বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধকে সমর্থন করলে তার প্রান্তীয় অঞ্চলের বিক্ষোভ কঠোর হস্তে দমন করার কোন নৈতিক যুক্তি চীন সরকারের থাকবে না। সত্যই যদি তাই হয় তাহলে বলতে হবে বিপ্লবের দুই দশক পরেও চীনে অভ্যন্তরিক-স্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, চীন এখনও বিক্ষোভ ধূমায়মান, চীনের সামরিক শক্তি অভ্যন্তরিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও সন্তোষের দ্বারা পুষ্ট নয়। তার বর্তমান অবস্থায় চীন ও আমেরিকার পাকিস্তান প্রীতি মৌখিক পর্যায় থাকারই সম্ভাবনা।
যে দেশ এত বছর যুদ্ধের পর ভিয়েতনাম থেকে পালিয়ে আসতে চায় সে-দেশ নতুন করে অন্য কোন দেশে সেনাবাহিনী পাঠাবে মনে হয় না। প্রেসিডেন্ট নিকসনের সে রকম কোন বাসনা থাকেও, আমেরিকান সেনেটর বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটি আগে ভাগে তাতেও বাদ সেঁধে রেখেছেন। এই সপ্তাহেই এই কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিল অনুমােদন করেছেন যার ফলে পৃথিবীর কোন জায়গায় আমেরিকান সৈন্য পাঠানাের আগে। প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের সম্মতি নিতে হবে। এই সাধারণ নিয়মের কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের ব্যবস্থাও বিলে আছে। তবে বিলটিতে যে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অনেক খর্ব করা হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় নিকসনপন্থীদের ঘাের বিরােধিতায়। দেশে দেশে মুক্তি সগ্রামের যত বড় পৃষ্ঠপােষকই চীন হােক না কেন একমাত্র কোরিয়া ছাড়া আর কোথাও চীনা সেনা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। কোরিয়ায় করেছিল, কারণ চীন তখন আক্রান্ত। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে চীন এই নীতির ব্যতিক্রম করবে মনে হয় না। আমেরিকার মতােই চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করছে। তাছাড়া চীন আর কোনও সাহায্য করবে কিনা তা নাকি দু একদিনের মধ্যে জানা যাবে। অর্থাৎ এই সাহায্য ঘােষণা করা হবে বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর যখন সাহায্য পাওয়া না পাওয়া পাকিস্তানের পক্ষে সমান কথা। এসব পর্যালােচনা করেই ভারত সরকার তার নীতি স্থির করেছেন এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ঐ প্রস্তাবে পাকিস্তানের শর্তাধীন সম্মতির পরও এ নীতি পরিবর্তনের কোন কারণ নেই । পাকিস্তান কেবল সম্মতিই জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি করেনি। যুদ্ধের বর্তমান অবস্থায় পাকিস্তানের সম্মতি আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছু নয়। এই সম্মতির একটি উদ্দেশ্য হল ভারত যদি অনুরূপ মনােভাব দেখায় তাহলে বাংলাদেশের মুক্তি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যুদ্ধ করে পাকিস্তান যে ফল পায়নি, যুদ্ধবিরতি করে তা পাবে। আর ভারতের মনােভাব যদি অপরিবর্তিত থাকে তাহলে নিরাপত্তা পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে ভারতকে যুদ্ধবাজ বলার আর একটি অছিলা সৃষ্ট হবে। ভারতের পক্ষে রাষ্ট্রপুঞ্জের দরবার বিনাদোষে অভিযুক্ত হওয়া এই প্রথম নহে। কিন্তু এই প্রথম ভারত সেই অন্যায়কে উপেক্ষা করার মনােবল দেখিয়েছে। এই মনােবর যতদিন বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানী ফৌজের কবলমুক্ত না হয় ততদিন প্রয়ােজন। যুদ্ধবিরতি যদি হয় তাহলে তা হবে পশ্চিমরণাঙ্গনে বাংলাদেশের মুক্তির পর। তার আগে যুদ্ধবিরতির কোন প্রস্তাব বিবেচনা ভারত সরকারের গত আটমাসের সফল নীতির পরিপন্থী হবে।
১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা