রাজ্য ও রাজনীতি মুক্ত বাংলায় এখনই অসামরিক প্রশাসন গড়ে তােলা চাই
–বরুণ সেনগুপ্ত
বাংলাদেশের বুক থেকে পাকিস্তানের সকল চিহ্ন অবলুপ্ত প্রায়। রাজধানী ঢাকা মুক্ত হতেও আর খুব বেশি। দেরি নেই। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এখন সমগ্র বাংলাদেশ থেকে পালাবার পথ খুঁজছে। পাকিস্তান অবশ্য এরপরও নানাভাবে বাংলাদেশের উপর কর্তৃত্ব দাবি করবে। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জে যাবে। বন্ধুদের দুয়ারে দুয়ারে। এবং নানা পথে বাংলাদেশের আবার অন্তত কিছুটা কর্তৃত্ব পাওয়ার চেষ্টা করবে। নানাভাবে এই চেষ্টা করবে বলেই পাকিস্তান নুরুল আমিন নামক ব্যক্তিটিকে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী বলে। ঘােষণা করেছে। দেখাবে, এই আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বাঙালী । সেই দেখানাে পুতুল প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমেই। তারা বাংলাদেশের উপর দখল চাইবে।। এই ব্যাপারে পাকিস্তান প্রধান বন্ধু পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। আর আছে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন। সঙ্গে থাকলে, বিশেষত মারকিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে থাকলে বহু ছােট রাষ্ট্রকেও সঙ্গে পেতে অসুবিধা হবে না। বাংলাদেশ পাকিস্তানেরই, তাই পাকিস্তানকেই বাংলাদেশে কর্তৃত্ব করতে দেওয়া হােক-এই দাবি মারকিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপুঞ্জের দরবারে উঠবেই । কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার একবার ঢাকায় পুরােপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তারপর কি আর তাকে সরানাে যাবে? পৃথিবীর যত শক্তিই চেষ্টা করুন সেটা সম্ভব হবে না। অন্তত রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় কখনও কোথাও তা সম্ভব হতে পারে না। যে সরকার দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে পুষ্ট তাকে রাষ্ট্রপুঞ্জে মাধ্যমে উচ্ছেদ করা যাবে না। যদি তা করতে হয় তাহলে প্রয়ােজন হবে সামরিক অভিযান। অর্থাৎ সৈন্য পাঠিয়ে আবার বাংলাদেশে পাক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেটাও আর একা পাকিস্তানের দ্বারা সম্ভব নয়। পাক সৈন্যের পক্ষে একা আর বাংলাদেশে দখল ফিরিয়ে পাওয়া অসম্ভবসে তারা যতই বিদেশী সাহায্য পাক। পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানী কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনতে হলে মারকিন বা চীনা সৈন্যকে তাদের সমর্থনে অ্যাকসনে নামতে অর্থাৎ বাংলাদেশে পাক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে মারকিন বা চীন সৈন্যের মাধ্যমে তা করতে হবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন মুখে যতই বলুক কার্যক্ষেত্রে তারা সৈন্য সামন্ত নিয়ে নামবে না অন্তত পাক কর্তৃপক্ষকে ঢাকায় আবার বসিয়ে দেওয়ার জন্য চীন বা আমেরিকা কিছুতেই সৈন্য পাঠাবে না। রাষ্ট্রপুঞ্জের নামে সৈন্য পাঠানােও অসম্ভব।
তাই ঢাকা থেকে পাকসৈন্য বিতাড়নের পর বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের দখলে ফিরিয়ে দেওয়া। কিছুতেই সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ সরকার বসবে। শুধু বাংলাদেশের মানুষই তখন বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। এইজন্য যতদিন সম্ভব ঢাকায় দখল বজায় রাখার জন্য পাকিস্তান চেষ্টা করবে। এই আশায় যে যদি রাষ্ট্রপুঞ্জ বা বন্ধু রাষ্ট্রগুলি ততদিনে চাপ দিয়ে বাংলাদেশে তাদের কিছুটা কর্তৃত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু ভারত সরকার ইতিমধ্যেই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে কারাে চাপে তারা। কোনও রফা করবেন না। বাংলাদেশের সরকার বাংলাদেশে পুরােপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যরা এবং মুক্তিবাহিনী পাক দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। | মারকিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যে কোনও বিশেষ প্রেমবশত পাকিস্তানের মিত্র তা নয়। মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ভারতকে শক্তিশালী হতে না দেওয়া। তারা জানে, পাকিস্তানের বিষ দাঁত ভেঙ্গে গেলে, বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র হলে এবং ওই ভাবে পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিরক্ষার জন্য ভারতকে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচা না করতে হলে ভারত অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ভারতের অর্থনীতি, ভারতের শিল্প আরও মজবুত হবে। তাতে আমেরিকার নানা ক্ষতি। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দুইভাবেই ক্ষতি। তাই মারকিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পূর্বে ও পশ্চিমে যে কোনও সময় ঝাঁপিয়ে পড়ার মত শত্রু পাকিস্তানকে জিইয়ে রাখতে চায়। | সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে মারকিন যুক্তরাষ্ট্র কী করবে? তারা নিশ্চয়ই ভারতের অগ্রগতিতে এবং শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টায় বাধা দেওয়ার সব পরিকল্পনা বাতিল করবে না। তারা অন্য বহু ভাবেই সেই চেষ্টা চালিয়ে যাবে। যেমন এখনও চালাচ্ছে। অন্যান্য কী কী ভাবে তারা চেষ্টা করছে সে আলােচনা ভিন্ন। আপাতত আলােচ্য বিষয় পকিস্তান ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশে যখন স্বাধীন সরকার পুরােপুরি কায়েম হবে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পরিকল্পনাটা পাল্টাবে। প্রথমত, তারা চেষ্টা করবে, যাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের ঝগড়া লাগিয়ে দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত তারা চেষ্টা করবে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং আবার তাকে সাময়িকভাবে শক্তিশালী করে তােলা যায়।
এখন থেকেই মারকিন যুক্তরাষ্ট্র সেই চেষ্টা শুরু করছে। তারা কীভাবে কী চেষ্টা করছে আপাতত সে আলােচনা থাক। আপাতত শুধু আমি একটা কথা বলতে চাই। যদি আমাদের সরকারী কর্তাব্যক্তিরা এবং বাংলাদেশ সরকারের সবাই এখন থেকেই সতর্ক না হন তাহলে এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আংশিক সাফল্য কেউ আটকাতে পারবে না। তারা এখনই ভারত-বাংলাদেশ বিরােধের বীজ বপন করতে চাইছে। এ বীজ যদি একবার তারা পুঁতে ফেলতে পারে তাহলে ভবিষ্যতে কোনও না কোনদিন গাছ জন্মাবেই। তাই এখন থেকেই এ ব্যাপারে আমাদের সকলের- ভারতের এবং বাংলাদেশের সতর্ক হতে হবে। আর চীন পাকিস্তানের সমর্থক কারণ সে ভারত বিরােধী। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র এবং শক্রর মিত্রও। আমার শত্রু এইটাই এ ক্ষেত্রে চীনের প্রধান ইজম। সেই মূলমন্ত্রকে ভিত্তি করেই চীন বাংলাদেশেরও বিরােধী। আরও একটা জিনিস এই সঙ্গে বলতে চাই। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সেখানে নানা বিদেশী শক্তির প্রচণ্ড খেলা শুরু হয়ে যাবে। সেই খেলা তারা চালাতে চাইবে বাংলাদেশের নেতা, অফিসার, জনতা সকলের মাধ্যমে। তাই এখন থেকেই বাংলাদেশ সরকারকে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এখন থেকেই তাদের শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যদি তারা সুষ্ঠু জনকল্যাণমূলক প্রশাসন গড়ে না তুলতে পারেন তাহলে চার পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে নানা গণ্ডগােলের দানা বেঁধে উঠবে। বাংলাদেশে সর্বত্র এখন প্রচুর ‘অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে রয়েছে। এইসব অস্ত্রশস্ত্র সরকারের হাতে তুলে নেওয়া বাংলাদেশ সরকারের আর একটা বড় দায়িত্ব। আর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হিতসাধন- বাংলাদেশে সত্যিকারের জনকল্যাণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এর কোন কাজই সহজ নয়। বাংলাদেশ সরকার যদি এখনই কাজে না নেমে পড়েন তাহলে আর কোনও দিন হাল ধরার সুযােগ পাবে কিনা বলা কঠিন হবে।
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা