You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.05 | মুক্তিযুদ্ধ নিছক দুর্গ দখলের লড়াই নয় -আবদুল গাফফার চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধ নিছক দুর্গ দখলের লড়াই নয়

–আবদুল গাফফার চৌধুরী

খবরের কাগজের পাঠক মাত্রেই যুদ্ধের খবরে অলৌকিক ও চমকপ্রদ কিছু প্রত্যাশা করেন। রণাঙ্গণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে প্রত্যহ শত্ৰুৰ্ঘাটির নতুন সংবাদ শােনা নিঃসন্দেহে রােমাঞ্চকর। তখন যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পার্থক্য খবরের পাঠকমাত্রই ভুলে যান। কোন যুদ্ধের পেছনে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। যেমন বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারেরা লড়ছে সামরিক বিজয়ের জন্য, রাজনৈতিক জয়ের জন্য নয়। বাংলাদেশের মানুষকে কোন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য বা আদর্শ দ্বারা তারা অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর লড়াই চমকপ্রদ সামরিক বিজয়ের জন্য নয়, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য। অর্জনের জন্য। এই লক্ষ জাতীয় স্বাধীনতা। এই রাজনৈতিক প্রেরণাই মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই শত্রুসৈন্য সংখ্যায় অনেক বেশী সশস্ত্র এবং সংগঠিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যাপক জনসমর্থনের বলে বলীয়ান মুক্তিবাহিনী চূড়ান্ত জয়ে আশাবাদী। যশাের সেকটরে মুক্তিবাহিনীর এক তরুণ অফিসার আমাকে বলেছেন “আপনারা যারা খবরের কাগজে লেখেন তাদের উচিত পাঠকদের বােঝানাে, আমরা বিস্ময় বা চমকসৃষ্টির জন্য লড়ছি না। লড়ছি স্বাধীনতার জন্য। আমাদের অস্ত্রবল, লােকবল ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতা আপনাদের মনে রাখতে হবে। ভিয়েতনামে লােকক্ষয় ও শক্তিক্ষয় এড়ানাের জন্য ভিয়েতকংদের টেট অফেনসিভের কথা আপনাদের মনে আছে। সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও, শুধু নিজেদের ভিয়েতকংরা এই মারকিন ঘাঁটিটি তিন মাস অবরােধ করে রেখেছিল। দখল করতে এগােয়নি।” প্রশ্ন করলাম, আপনারাও কি যশাের ক্যান্টনমেন্ট অবরােধ করতে চান? তরুণ অফিসার হেসে বললেন, চাই কি বলছেন, অবরােধ তাে করেই ফেলেছি। কেবল আমাদের শক্তিক্ষয় ও লােকক্ষয় এড়ানাের জন্য দুর্গটি সহসা দখল করছি না। কিন্তু চারিদিক থেকে তার সরবরাহ লাইন কেটে দিচ্ছি। সুতরাং সাতদিন, না সাত সপ্তাহ-কতদিন শত্রুপক্ষের মর্যাল অক্ষুন্ন থাকে, তার উপরই নির্ভর করছে দুর্গদখলের সঠিক দিনক্ষণ। বললাম, আগে তাহলে দুর্গ মুক্ত হচ্ছে? তিনি বললেন, তা বলতে পারবাে না। শত্রুপক্ষের কয়েকটি সুরক্ষিত ক্যান্টনমেনটের মধ্যে আগে কোনটি আমরা দখল করতে চাই, সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে ধাঁ ধাঁ সৃষ্টিই আমাদের রণকৌশল।

তবে আমরা চাই যে দুর্গটির আগে পতন ঘটুক, তা-যেন হয় ভিয়েতনামে ফরাসী জন্য দিয়েন বিয়েন ফুর ঘাঁটির পতনের মত। ওই একটি সুরক্ষিত ঘাঁটির পতনের পরই ভিয়েতনামে ফরাসী সৈন্যদের মনােবল ভেঙে গিয়েছিল। তারা লড়াই না চালিয়ে পাততাড়ি গুটিয়েছিল বাংলাদেশেও এমন একটা সুরক্ষিত সামরিক ছাউনি আমরা আগে দখল করতে চাই। যে ছাউনির পতনের ফলে তাদের মনােবল ভেঙে যাবে; এবং অন্য ছাউনিগুলােতে প্রতিরােধ ও আত্মরক্ষার চেষ্টা না করেই তারা পাততাড়ি গুটাবে। তাতে আরও চারটি পাঁচটি সামরিক ছাউনি দখলের লােকক্ষয় ও শক্তিক্ষয় আমরা এড়াতে পারবাে এবং অন্যদিকে আমাদের উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে। তাই চমকপ্রদ ও তড়িৎ বিজয় লাভের নীতি গ্রহণ না করে আমরা ধীর অথচ অব্যাহত আঘাত ও চাপ সৃষ্টি দ্বারা শত্রুর মনােবল ও স্নায়ু নিস্তেজ করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের মানচিত্রটা সামনে রাখুন। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের একটা সমগ্র চিত্র আপনার চোখে আসবে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন উদ্যমে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার ফ্রনট একটি নয়, অনেক । তবে লক্ষ্যস্থল একটি-ঢাকা। এই ঢাকাকে কেন্দ্র করে উত্তরে যুদ্ধ চলছে দিনাজপুর ও রংপুরে, পশ্চিমে রাজশাহী কুষ্টিয়ায়, পশ্চিম-দক্ষিণে যশাের-খুলনায় এবং পূর্বে সিলেট, কুমিল্লায়, নােয়াখালি ও চট্টগ্রামে। মুক্তিবাহিনী। শুধু বিস্তীর্ণ এলাকা ও শত্রুঘাটি দখল করেনি, তারা পাকিস্তান বাহিনীর মূল ছাউনিগুলাের যােগাযােগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। যেমন, যশাের-মাগুরা সড়ক এখন বিচ্ছিন্ন। ফেনীর কাছে কুমিল্লা চট্টগ্রাম সড়কের একটা বড় অংশ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। হিলিতে নাটোর ঢাকা যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। ফলে একযােগে বিপন্ন হয়ে পড়েছে ময়নামতী, কুমিল্লা ও যশাের ক্যানটনমেনট। এসব ছাউনির পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থাও প্রায় অবরুদ্ধ। পাকিস্তানী সৈন্য অবরােধ ভেঙ্গে মুক্তিবাহিনীর অধিকৃত এলাকার অগ্রবর্তী ঘাটি বা ভারত সীমান্তের দিকে এগুবে, তাও পারছে না। কারণ মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র গেরিলা ইউনিট রয়েছে তাদের পেছনে, ‘ডানে ও বামে। সংখ্যায় তারা হাজার হাজার এবং তাদের গােপন অবস্থান রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। গেরিলা ইউনিটের এক অফিসার আমাকে বলেছেন আমরা এখন যে নীতি অনুসরণ করছি, তা হচ্ছে কোরিয়ামানচুরিয়া সীমান্তে ম্যাকআরথার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চীনা সৈন্যদের অনুসৃত নীতি।

ম্যাকআরথার তার বাহিনীকে বলেছিলেন, মানচুরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত চীনা সৈন্যদের তাড়িয়ে ও পরাস্ত করে দেশে ফিরে তারা বড়দিনের পিঠে খাবেন। কিন্তু এই পিঠে খাওয়া তাদের ভাগ্যে ঘটেনি। চীনা সৈন্যরা মার্কিন সৈন্যদের আক্রমণের মুখে দ্রুত পশ্চাদপসরণ করেছে, কিন্তু পেছনে, ডানে বামে অসংখ্য গােপন গেরিলা পকেট রেখে গেছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণে এবং পেছনে, ডানে বামে গেরিলাদের ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় মার্কিন সৈন্য রণক্ষেত্রে তিষ্টাতে পারেনি। গত আট মাসে বাংলাদেশের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী দেশের সর্বত্র। অসংখ্য গেরিলা-পকেট তৈরী করেছেন। এখন সামনে থেকে মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ এবং চারিদিকে গেরিলা ইউনিটের তৎপরতায় পাকিস্তানী সৈন্যরা অতিষ্ঠ। নয়াচীন থেকে তাদের কয়েকটি গেরিলা-তৎপরতা বিরােধী ইউনিট শিক্ষাগ্রহণ করে ফিরেছে। কিন্তু জনসমর্থনের অভাবে তাদের শিক্ষা কোন কাজে লাগছে না। প্রথম দিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ভেবেছিল, তারা মারচ মাসের মত সামরিক ছাউনিতে ঢুকে শক্তি সংহত করে প্রবল পাল্টা আক্রমণ চালাবে। কিন্তু এখন তারা দেখছে গােটা বাংলাদেশের জনগণ তাদের বিরুদ্ধে। চারিদিকে কুদ্ধ ও আঘাতহানার জন্য অপেক্ষমাণ সাধারণ মানুষ এবং গেরিলা ইউনিট দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে মুখােমুখি লড়াইয়ে নামতেও তারা ভয় পাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন সরবরাহ আসছে না। বাংলাদেশেও পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলাের অভ্যন্তরীণ যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিন্ন। এই অবস্থায় তারা একটি মাত্র আশাতেই দিন গুনছে আর সামরিক ছাউনির সুরক্ষিত বিবরে ঢুকে কালহরণের নীতি গ্রহণ করেছে, তা হল, বৃহৎ শক্তিবর্গের চাপে যদি মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা হ্রাস পায় কিংবা কোন তথাকথিত রাজনৈতিক আপােসের কাঠামােতে তারা বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার সুযােগ পায় । কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তরুণ অফিসারদের ধারণা এ সুযােগ তারা পাবেনা। মুক্ত এলাকায় যেখানেই তারা। যাচ্ছেন, সেখানেই জনগণের কাছ থেকে সাগ্রহ ও স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যর্থনা লাভ করে, তাদের নিশ্চিত ধারণা হয়েছে, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের বিরােধিতার মুখে এক পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে সমস্যার আর কোন সমাধান সম্ভব নয়। কোন কোন বৃহৎ শক্তি তা চাইতে পারেন, কিন্তু তা চাপিয়ে দিতে পারেন না। মুক্তিবাহিনীর এক তরুণ অফিসার আমাকে বলেছেন “পাকিস্তানী সৈন্যরা যে হারে বাংলাদেশে অত্যাচার। নারীনিগ্রহ, ধ্বংস, লুণ্ঠন চালিয়েছে, তাতে তাদের সঙ্গে আবার এক রাজনৈতিক কাঠামােতে মিলিত হওয়া দুরে থাক, আগামী একশ বছর যদি কোন বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানীদের মুখদর্শন না করতে চায়, আমি বিস্মিত হব না। ইহুদীরা পচিশ বছরেও এক আইখম্যানকে ভােলেনি। বাঙালীরা ইয়হিয়াকে ভুলবে, আপনি। কি তা ভেবেছেন?”

৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা