You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরিক ও সৈনিক

–মনােজ বসু

পৃথিবীর নবীনতম গণতন্ত্র গণতন্ত্রী বাংলাদেশ। রক্ত-সাগরে অবগাহন করে সর্ব গ্লানি পাপবিমুক্ত হয়ে উঠে এলাে। প্রথম স্বীকৃতি দানের গৌরব ভারতের আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। একক ঐতিহ্যের অধিকারী আমরা- চব্বিশটা বছর আগে আমাদের দেশ ছিল একটাই । দুটি পৃথক রাষ্ট্র হয়েও আমরা একাত্ম আমাদের রাষ্ট্রিক আদর্শ সর্বতােভাবে এক। নব রাষ্ট্রকে আমি অভিনন্দন ও অভিবাদন জানাই। ভারতীয় জওয়ানেরা বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর পাশাপাশি লড়ছে। মুক্তিবাহিনী আর মিত্র বাহিনী।  লড়াই আমরা একেবারেই চাইনি। নানা সমস্যার নিরসন করে দেশকে সকল দিক দিয়ে দেশকে পরিপাটি করে গড়ে তুলব গরিবি হঠাব-সর্বপ্রযত্নে আমরা সেই আয়ােজনে ছিলাম। বলদৃপ্ত জঙ্গীশাহী বাংলাদেশ উৎসাদনের জন্য কেঁপে পড়ল। ঘরের পাশের মানুষের এ দুদৈর্বে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার বলে অন্যান্যদের মতাে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি। ইসলামাবাদের বড় আক্রোশ সেইহেতু আমাদের উপর। সীমান্ত তছনছ করেছে আগে থেকেই এক পরােক্ষ অভিযান চালিয়ে আসছে আমাদের বিপক্ষে। আরণ্য হিংস্রতায় প্রায় এক কোটি মানুষকে ঘর ছাড়া করেছে, তাদের একমাত্র অপরাধ গণতন্ত্রের উপর প্রীতি গণতন্ত্রের স্বপক্ষে তারা ভােট দিয়েছিলেন। প্রাণের আতঙ্কে সর্বস্ব ফেলে তারা ভারতের শরণার্থী হলেন। এই বােঝা ভারত আটমাস ধরে টানল, যার ফলে অর্থনীতি বানচাল হতে বসেছে, গঠন পরিকল্পনা সিকেয় উঠে গেছে। এক নৃশংসতম গণহত্যা ও গণতন্ত্রহত্যার যাবতীয় বিবরণ। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর দরজায় দরজায় ঘুরে জানিয়েছেন। এবং আমরাও। খুব তারিফ পেয়েছি আমরা, ভারত সহিষ্ণুতার পরাকাষ্টা দেখাচ্ছে। আজ যারা উল্টো সুরে গাইছেন তারা পর্যন্ত শতকণ্ঠে বাহবা দিয়েছেন। কিন্তু একমাত্র সােভিয়েত রাশিয়া ছাড়া বৃহৎ শক্তি কারাে কাছ থেকে বলিষ্ঠ সাহায্য ও প্রতিশ্রুতি মিলল না। গণতন্ত্র নিয়ে মস্তমন্ত বুলি যাদের মুখে তাদের কাজকর্মে হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছি।

নিজ স্বার্থের কড়াক্রান্তির হিসাব করে হত্যাকারীর হাতে হাত মেলাতে একটুও দ্বিধা নেই তাদের। এবং এই বাবদে দুলেরও অসদ্ভাব ঘটে না। বিস্তর অপেক্ষার পর সকল দায় অবশেষে নিজেরাই কাঁধে তুলে নিলাম। কারাে চোখ-রাঙানি বা পিঠচাপড়ানির তােয়াক্কা না রেখে অটল আত্মপ্রত্যয়ে আমরা বর্বরতার বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছি। গণতন্ত্র রক্ষায় আমাদের জওয়ানরা বীর মুক্তিযােদ্ধাদের সহযাত্রী। শরণার্থীরা সসম্মানে দেশে ঘরে ফিরবেন সে পথ তারাই প্রস্তুত করে দিচ্ছেন। ফেরা আরম্ভ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আতঙ্কে অর্ধমৃত অবস্থায় ধুকতে ধুকতে একদিন এসেছিলেন। তাদের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল, দৃঢ় পায়ে পরিজনদের আগুপিছু নিয়ে ফিরে চলেছেন। সীমান্তে দাড়িয়ে মানুষের পুনর্জীবনের এই দৃশ্য দেখে দেখে আর আশ মেটে না। | মানবিকতা নিয়ে এতাবৎ কত ভাষাবিন্যাস করেছি মনে মনে। আমাদের এই যুদ্ধ সেই মানবিকতার আহ্বানে। ঐতিহ্যবান ভারতবর্ষের প্রতি মাথানােয়াই কিন্তু এই উনিশে-এ-একাত্তরের ভারতের জন্য আমার। গর্বের সীমা পরিসীমা নেই। কোনপ্রকার বৈষয়িক লাভ ভারতের লক্ষ্য নয়। জঙ্গীশাহীর কবর থেকে একটি অঞ্চল যেইমাত্র উদ্ধার হলাে, গণতান্ত্রিক ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সঙ্গে সঙ্গে সেখানে সাংগঠনিক কর্মে লেগে যাচ্ছেন। এই জিনিসটাই ইয়াহিয়ার ব্যবস্থাপনায় হবে। প্রত্যাশা করা গিয়েছিল। এবং ইয়াহিয়ার। মুরুব্বিদের ধরে এই পরিমশই তার কাছে বার বার পাঠানাে হয়েছে, তিনি কর্ণপাত করলেন না। ফলে যুদ্ধ। যুদ্ধ বিজয়ের প্রাপ্তিটা ভারতের একলা নয়, সমস্ত মানব সমাজের। বিশ্ববিবেক নামক বস্তুটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে। সকলে সন্দিহান হয়ে উঠেছিলাম, তৎসম্পর্কে আস্থা ফিরে আসবে।

 এ লড়াই জিতবই। নইলে সভ্যতার অগ্রগমণ অনেক শতাব্দী পিছিয়ে যাবে। শুরু থেকেই নানা ফ্রনটে বিজয়বার্তা আসছে। উল্লসিত নিশ্চয়ই হব, কিন্তু আত্মহারা হই। অনেক চক্রান্ত পেছনে, গণতন্ত্রের উষ্ণীষধারী গণহত্যার সমর্থক অনেক আছে। নানা অনর্থের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, পতন-অ্যুদয় অনেকবার ঘটবে। স্বার্থসন্ধ কত বহুরূপী আরও কতবার রং পাল্টাবে, ধারণায় আসছে না। পূর্ণ বিজয়ের। জন্য এখনও অনেক রক্ত ঢালতে হবে। য়ুরােপীয় ও মারকিনী অনেক-লেখক লড়াইয়ের মধ্যে কলম ফেলে হাতিয়ার ধরেছেন। বিদেশের যুদ্ধেও স্বেচ্ছাসৈনিক হয়ে গেছেন। আদর্শ সাধনের জন্য নানা পন্থায় সমর প্রচেষ্টার-সহায়ক হয়েছেন। তারা আত্মদান করেছেন, অথবা লড়াইয়ের পর ফিরে এসে সাহিত্যকে সমৃদ্ধিতে ভরে দিয়েছেন। চীনের মুক্তিসংগ্রামের মধ্যেও মাও-তুন প্রমুখ বাঘা বাঘা সাহিত্যিক ঝাপিয়ে পড়ে অশেষ দুঃখ-লাঞ্ছনা-নির্যাতন সয়েছেন, তার চমকপ্রদ বিবরণ সেই সব লেখকের নিজ মুখের বর্ণনায় কিছু কিছু শুনে এসেছি। এ যুদ্ধের অন্যতম শরিক বলে নিজেকে আমি ভাবি-জলে স্থলে আকাশে যারা লড়ছেন, তাদের সমগােত্রিয় সৈনিক। সংবাদপত্র ও রেডিওর খবরগুলির উপর বাহবা দিয়ে গেলেই হবে না, হাতে-কলমে কাজ করার প্রবল তাড়না অনুভব করছি। কলম ছাড়াও হাতের কাজ রয়েছে। আসমুদ্রহিমাচল আজ একটি মাত্র স্বরে কথা বলছে,  এমন সংহত বলিষ্ঠ ভারত আমার দীর্ঘ-জীবনের মধ্যে আর কখনাে দেখেনি। বিশেষত বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বঙ্গসংস্কৃতি।

চব্বিশ বছর আগে এক বাংলা দুই বাংলা হল। সেটা রাজনৈতিক খণ্ডন, সাংস্কৃতিক কোনমতেই সম্ভব হল না। তারজন্য ক্রমাগত চেষ্টা চলেছে পাকিস্তানী উপর মহলে। গােড়ায় পূর্ব বাংলা থেকে বাংলাভাষা উৎসাদনের চেষ্টা। এই বাবদে পাকিস্তানের সেই গােড়ার আমলে ১৯৪৮ অব্দে জিন্নাহকে মুখােমুখি অপমান করতেও ছাত্রেরা ছাড়েনি। ভাষা নিয়ে বেঁধে গেল, মাতৃ ভাষার জন্য বাংলাদেশের ছেলেরা গুলির মুখে আত্মদান করলেন। পৃথিবীর মধ্যে তারাই প্রথম ভাষা-শহীদ। ভাষা যুদ্ধে পরাজয়ের পরেও ক্রমাগত চক্রান্ত চলল। বাংলা হরফের জায়গায় আরবি হরফ চালু করা, বাংলার সঙ্গে অন্তত চল্লিশ পারসেন্ট উরদু মিশাল দিয়ে ওপারের জন্য পৃথক এক বাংলাভাষা বানানাে, রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করণ, ইতাদি ইত্যাদি। এপারে ওপারে বইপত্রের চলাচল একেবারে বন্ধ– পরস্পরের মনের খবর যাতে জানা না যায়। কত রকম করে দেখল। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক শক্তি ইসলামাবাদ জানে, ভয় করে। তাই মাস আষ্টেকের এই স্বল্পকালীন পাশৰ শাসনের মধ্যেও সাইনবাের্ড, গাড়ির নম্বর, নেমপ্লেট ইত্যাদিকে তাড়াতাড়ি বাংলা হরফ পালটে উরদু বসিয়ে দিয়েছে বাংলা ভাষা লােকের যাতে নজরে না পড়ে।  কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিক আমরা বাংলাদেশের নেতাদের কাছে পুষ্পেপাহার নিয়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রতিভাষণে ভাষা-সংস্কৃতি শিল্প-সাহিত্যের জন্য তাদের সুদীর্ঘ সংগ্রামের কথাই বিশেষ করে বললেন। এই সংগ্রামের বিজয়লাভ বাঙালী সংস্কৃতি। বিজয় রাজনীতির অনেক উপরে তার জায়গা। নতুন বাংলাদেশের কেবল বীর্য ও সমৃদ্ধি হলেই হবে না, তাকে শ্রীমণ্ডিত সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। এই কর্মে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উভয় বাংলার লেখক-শিল্পীদের মিলিত উদ্যম কামনা করলেন। গণতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্মক্ষণে আজ আমাদের কঠোর আত্মসমীক্ষারও প্রয়ােজন আছে। একদেশ কেন দুটো দেশ হয়ে গেল? একহাতে কখনও তালি বাজে না-রাজনীতর চশমা না পরে মুক্তদৃষ্টি নিয়ে ধীর-স্থিরচিত্তে আমরা নিজ নিজ দোষ অনুধাবন করব। দুই দেশের মধ্যে বিরােধ ও রক্তক্ষয় কি জন্য ঘটেছিল? পাপের প্রায়শ্চিত্ত অনেক হয়েছে এখানে সর্বনাশ আর যেন কখনও না ঘটে- এই যুদ্ধই যেন ভারতের পক্ষে শেষ যুদ্ধ হয়।

১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!