You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.02 | রাজধানী রাজনীতি নিরাপত্তা পরিষদে এ প্রস্তাব কার -রণজিৎ রায় - সংগ্রামের নোটবুক

রাজধানী রাজনীতি নিরাপত্তা পরিষদে এ প্রস্তাব কার

–রণজিৎ রায়

ভারত-পাক উপমহাদেশে যে সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত কী রূপ নেবে বলা কঠিন। শ্ৰীমতী গান্ধী বিদেশ সফরের সময় এবং সফর শেষে এমন একটা ধারণা দেওয়া হচ্ছিল যে তার সফর যথেষ্ট সফল হয়েছে; বাংলাদেশে রাজনীতিক সমাধানে আসার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার উপর চাপ দিতে এবং ঐ সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শেখ মুজিবরের মুক্তির ব্যবস্থা করতে পশ্চিমী দেশগুলিকে প্ররােচিত করা গিয়েছে। ভারতীয় মুখপাত্রগণ এই দৃষ্টিকোন থেকেই প্রধানমন্ত্রীর সফরকে দেখছেন; সংবাদপত্রেও তদনুরুপ  খবর ছাপা হয়েছে। কিন্তু ঐ ধারণার ফানুস এক পক্ষ কালের মধ্যেই চুপসে গিয়েছে। দেশে ফেরার দু’দিন পর ১৫ নভেম্বর সংসদে নিজের সফরের সাফল্যের বিবরণ দিয়ে শ্রীমতী গান্ধী বলেন ঃ বাংলাদেশের ব্যাপারে যে রাজনীতিক সমাধান খোজা দরকার, শেখ মুজিবরের মুক্তি যে অপরিহার্য’-তা তিনি যেসব দশ পরিভ্রমণ করেছেন সেই সব দেশের তথা অন্যান্য দেশের নেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি আরাে বলেন প্রায় সব কটি দেশই ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকদের এ কথাটা বুঝিয়ে দিতে ইচ্ছুক। শেখ মুজিবরকে মুক্তি দিয়ে তার সঙ্গে জেনারেল যা আলােচনায় বসেন তার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিকসন ও জেনারেল ইয়াহিয়ার উপর চাপ দেবেন= ‘আমাদের বহির্বিষয়ক দফতর অপ্রকাশ্যভাবে এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। | বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত যে কোন মুসলিম দেশের সমর্থন পাবে না- এ সত্য দিল্পি আর এড়িয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশের আন্দোলনকে মুসলিম দেশগুলি মােটামুটি যে দৃষ্টিতে দেখছে তা হল ঃ গত ২৫ মারচের ঘটনা চিরন্তন পাক-ভারত বিরােধেরই বহিঃপ্রকাশ, এটা ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন এবং দুর্বল করে পৃথিবীর এই অংশে বৃহত্তম শক্তি সাজারই প্রয়াস।

এই সব দেশকে আমাদের অনুকূলে আনার জন্য মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এমন মন্ত্রী, এম পি ও অন্যান্য প্রতিনিধিদের মুসলিম দেশগুলিতে পাঠানাে হয়েছিল। কিন্তু তারা বিন্দুমাত্র সাফল্য লাভ করেননি এমন কী ভারতের অভিপ্রায় সম্পর্কে ওদের মনে যে ভ্রান্ত ধারণা পরিপুষ্ট হচ্ছে তাও আমাদের প্রতিনিধিরা বদলাতে সক্ষম হননি। ভারতের প্রতি ওদের মনােভাব স্পষ্টতই এত নেতিবাচক যে শ্ৰীমতী গান্ধীর বিদেশ সফরের তালিকায় কোন মুসলিম রাষ্ট্রই অন্তর্ভুক্ত হয়নি-এমন কি মিশরও নয়। ওদের । যা কিছু সামরিক এবং কূটনীতিক সমর্থন তা ইসলামাবাদের হিসাবেই জমা পড়ছে। ১৯৬৯ সাল থেকেই আমেরিকা চীনের সঙ্গে হৃদ্যতা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এমন সংবাদ। বহুবার কানে এলেও দিল্পি সতর্ক হওয়ার প্রয়ােজন বােধ করেনি- চীন নামক একটি সত্যকে অস্বীকার করেই চলেছে। বাংলাদেশের ঘটনাবলীর প্রথম তিন মাসেও পিকিং-এর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যে খুবই সচেষ্ট হওয়া দরকার- এ কথা দিল্লির মাথায় আসেনি। কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে এসে আশ্রয় নেবার পর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের ভাষায় কূটনীতিক অভিযান শুরু করেন। এ প্রয়াসের অঙ্গ হিসাবে অনেকগুলি রাষ্ট্রের প্রধানের কাছে শ্ৰীমতী গান্ধী চিঠি লেখেন; কিন্তু চীনের নাম সে তালিকায় ছিল না।  বাংলাদেশের বিষয়ে চৈনিক প্রধানমন্ত্রী শ্রী চৌ-এন লাইয়ের কাছে শ্রীমতী গান্ধী প্রথম চিঠি লেখেন। জুলাই মাসে। এ চিঠির বিষয়টি সম্পূর্ণ গােপন রাখা হয়েছিল। ২৫ আগস্ট দিল্পির পেট্রিয়ট পত্রিকায় ঐ চিঠির খবর ফাঁস হয়ে যায় । কিন্তু চিঠিখানা ঠিক কবে লেখা হয়েছে, কী লেখা হয়েছে তা অদ্যবধি জানা যায়নি। তবে একটি বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা হল ঃ শ্রী কিসিংগার গােপনে পিকিং-এ গিয়ে শ্রী নিকসনের সঙ্গে চীনের নেতাদের রাজি করানাের পরই ভারত দেখল ও আমেরিকা পাকিস্তানে অস্ত্র দিয়েই চলেছে। | দক্ষিণ আমেরিকা সমেত বহু দেশেই ভারতের দূত পাঠানাে হয়েছে। কিন্তু চীনে কাউকে পাঠানাে হয়নি। ভারতের মনােভাব সম্পর্কে পিকিং সন্দিহানই থেকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সমেত সর্বত্রই চীনের প্রবক্তারা ইসলামাবাদের প্রতিই পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে চলেছেন।

দিল্লী অবশ্য আশা করেছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে পিকিং নিশ্চয় ইসলামাবাদের হােয়ে লড়তে যাবে না। কিন্তু চীন যে কী করবে সে সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছেনা। তার ফলে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ও সম্ভাবনার পূর্ণ তুলনামূলক মূল্যায়নও সম্ভব হচ্ছে না। শ্ৰীমতী গান্ধী যে সব দেশ সফর করে এসেছেন তাদের কেউই পাকিস্তানের উপর কোন রকম চাপ সৃষ্টি করেছে বলে জানা যায় নি, কিন্তু তাদের কেউ কেউ ভারতের উপর চাপ দিতে শুরু করেছে তা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। শ্রীমতী গান্ধী বিদেশে বেরিয়ে সর্বপ্রথম গিয়েছিলেন বেলজিয়ামে। সেই বেলজিয়াম এই উপমহাদেশে শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব এনেছে। এটা স্পষ্টতই পাক-ভারত উত্তেজনাকে আন্তর্জাতিক রূপ দেবার প্রয়াস। তাছাড়া, এর ফলে ভারতকে পাকিস্তানেরই সগােত্র দাড় করানাে হল। বাংলাদেশের ঘটনা-ধারা এবং তার ফলে পাক-ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটার শুরু থেকেই ভারত এই বিষয়ের আন্তর্জাতিক রূপদানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছে। পাশ্চাত্তের দেশগুলিকে এ ধরনের প্রয়াস থেকে নিবৃত্ত করাই ছিল শ্রীমতী গান্ধীর বিদেশ সফরের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। বহির্বিষয়ক দফতরের বিশ্বাস ঃ বেলজিয়াম নিজে থেকে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে তােলেনি ? ব্রিটেন এবং আমেরিকাই বেলজিয়ামের বেনামে প্রস্তাবটি তুলিয়েছে। এই দুই দেশের হাত না থাকলে ইতালিও প্রস্তাবটি সমর্থন করতাে কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। বেলজিয়াম আনীত প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে আলােচনার্থ উঠলে ফ্রানস নিরপেক্ষ থাকবে বলেই নয়দিল্লি অশা করছে। চীনের ভােট সম্ভবত প্রস্তাবের পক্ষেই যাবে। তার মানে হলঃ প্রস্তাবের বিরােধিতা করার জন্য একমাত্র স্থায়ী সদস্য থাকছে সােভিয়েত ইউনিয়ন। তবে এর ফলে মসুকোর উপর ভারতের অতিনির্ভরতাই শুধু প্রকট হয়ে উঠবে না; বাংলাদেশ সমস্যার মত বিষয়েও আমাদের কূটনীতির প্রায় সম্পূর্ণ ব্যর্থতাও স্পষ্ট হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের সমস্যা যে পাকিস্তানেরই ঘরােয়া ব্যাপার; তাতে যে পাক-ভারত সম্পর্কের বিষয় জড়িত নয়। আমাদের একথায় পশ্চিমী দেশগুলি স্পষ্টতই কর্ণপাত করতে নারাজ।

পাকিস্তানও বর্তমান মুহূর্তে এ বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে যেতে দিতে খুব ইচ্ছুক নয়-এমন সংবাদ। সত্যও হতেও পারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন ফোরামে পাকিস্তান ভারত-বিরােধী বিষােধগার চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি দিন কয়েক আগে সাধারণ পরিষদে বলেছেন-ভারত ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে; সে তার দেশকে টুকরাে টুকরাে করে ফেলতে চায় । ইসলামাবাদ যে এধরনের অপ্রচার চালিয়ে যাবে। তা বলাই বাহুল্য। রাশিয়ার ভেটোর দ্বারা যদি বেলজিয়ামের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায় তাহলে তা ইসলামাবাদের পক্ষে অ্যানটি ক্লাইমেকস’ হয়ে দাঁড়াবে। জেনারেল ইয়াহিয়া সমগ্র পরিস্থিতি পুনর্বিচনার জন্য মসকোকে প্ররােচিত করতে নিশ্চয়ই যথাসাধ্য করছেন। এব্যাপারে তার হাতে তুরুপের তাস নেই; কিন্তু ওয়াশিংটনের মত মসকোও যে এই ভূখণ্ডে যুদ্ধের বিশেষ বিরােধী-সেকথা জেনেই তিনি অগ্রসর হচ্ছেন। কুটনীতিক দাবার চালে চূড়ান্ত কিস্তিমাত কে করবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। ইতিমধ্যে ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশ, এই উপমহাদেশ এবং পৃথিবীর সম্ভাব্য ঘটনাক্রম সম্পর্কে বাংলাদেশ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলােচনা করেছেন। আলােচনা কালে সম্ভবত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার প্রশ্নটিও উঠেছিল। গত এপরিল মাস থেকে এটা ভারতে একটা বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে সরকারকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত এই বলে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিক চাপ এড়াবার চেষ্টা করছেন। নয়াদিল্লির মতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যাওয়া।  ভারত যত দিন সম্ভব পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়িয়ে চলার চেষ্টাই করবে। তার যথেষ্ট কারণ আছে। মুক্তিবাহিনী। আগের চেয়ে অনেক সুসংগঠিত হলেও পাকিস্তানী বাহিনীকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে ফেলার মত শক্তি তারা এখনাে অর্জন করেনি। নিজেকে সুসজ্জিত করে শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে যে কোন গেরিলা বাহিনীরই অনেক দিন সময় লাগে। মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ শক্তিধর হতে হয়ত দীর্ঘ দিন লাগবে। ; কিন্তু তারা এখনও পাক বাহিনীকে নস্যাৎ করে ফেলতে পারে বলে যারা মনে করছেন তারা যুক্তির চেয়ে, প্রত্যাশাকে বড় করে তুলছেন। তাছাড়া, ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন, পাকিস্তানের প্ররােচনায় যুদ্ধ যদি বেধে যায়, তাহলে ভারত অতি সহজেই জয় লাভ করতে পারবে এমন আশা করা ঠিক নয়। তবে যুদ্ধ বাধলে ভারত সম্ভবত তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানাবে। সে দিক থেকে আগামী এক পক্ষকাল সময় খুবই জটিল এবং তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা