You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুদ্ধ অথচ যুদ্ধ নয় আসলে কী ঘটছে

— আবদুল গাফফার চৌধুরী

সারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা বড় রকমের যুদ্ধ লাগবে লাগবে ভেবে যারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন তারা একটু ঠাণ্ডামাথায় ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারবেন, যদি অভাবনীয় ও অকল্পনীয় কিছু ঘটে, তাহলে আগামী এক সপ্তাহ-এমন কি এক পক্ষকালের মধ্যেও এই সীমাবদ্ধ সংঘর্ষের বিস্তৃতি ঘটার কোন কারণ নেই এবং কারণ নেই যে নই শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী পারলামেন্টে দৃঢ় আস্থার সঙ্গে ভারতে এই মুহূর্তে জরুরী অবস্থা ঘােষণার সম্ভাবনা অস্বীকার করতে পেরেছেন। একথা সত্য, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যুদ্ধ তাদের সাফল্যও বড় রকমের । কিন্তু এই যুদ্ধের একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। মুক্তিবাহিনী বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল মুক্ত করছে এবং অসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করছে। শহর ও ক্যান্টনমেন্টগুলাের উপর তারা কেবল চাপ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু কোথাও কোন বড় শহর এলাকা দখল করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এটা সম্ভব হবে তখন, সাঁজোয়া ও বিমানবাহিনীর সহায়তায় তারা যখন পূর্ণশক্তিতে আক্রমণ পরিচালনা করতে পারবেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানী সৈন্যরাও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পল্লী এলাকাগুলাে- এমন কি সীমান্তের বিবর ঘাঁটিগুলাে ছেড়ে শহর ও ক্যান্টনমেনটে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে এবং তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করছে। বড় রকমের মুখােমুখি সংঘর্ষ তারাও যেন এড়িয়ে চলতে চাইছে এবং শক্তি সংহত করছে। ভারতীয় আকাশ-সীমা বারবার লঙ্ঘন বা সীমান্ত অঞ্চলে অনবরত গােলাবর্ষণও এখন পর্যন্ত উসকানি দানের এবং সীমান্ত সংঘর্ষের পর্যায়ে রয়েছে। ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও বড়রকমের শক্তিপরীক্ষা এখনও শুরু হয়নি।  তাহলে প্রশ্ন, এই উত্তেজনা সৃষ্টির এবং উত্তেজনা জিইয়ে রাখার আসল কারণ কী? সমস্যার এই জটটির কথাই আমি আগে উল্লেখ করেছি। এই জটটি হল আগামী ডিসেম্বর মাস।

এই ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার খসড়া শাসনতন্ত্র প্রকাশ করার কথা, জাতীয় পরিষদের বৈঠক ঢাকার বদলে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা এবং সর্বোপরি একটি অসামরিক সরকারের হাতে বর্তমান সামরিক জুনটার ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা । এই ক্ষতার লােভ পাকিস্তানে ভুট্টো ও নুরুল আমীন এখন কোমর বেঁধে কোন্দলে নেমেছেন। শক্তি সংগ্রহ ও তাঁর হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তরের চাপ সৃষ্টির জন্য ভুট্টো স্বেচ্ছায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষ দূতের চাকরি নিয়েছিলেন এবং ছুটেছিলেন পিকিং-এ। অন্যদিকে বাঙালী নুরূল আমিনকে সাক্ষী গোপাল খাড়া করে পশ্চিম পাকিস্তানের তিন মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, জমিয়তে উলেমায়ে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পারটি প্রভৃতি রক্ষণশীল ও সাম্প্রদায়িক দলগুলাে এক আটটি জোট খাড়া করেছে। বর্তমান। সামরিক জুনটা বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে যদি এই আট পারটি জোট অথবা ভুঠোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রহসনের নামে একটি অসামরিক সরকার খাড়া করতে পারে। এবং নিজেদের তৈরী শাসনযন্ত্র বলবৎ করতে পারে তাহলে এক ঢিলে তারা দুই পাখি মারবে।  প্রথম, বিশ্ববাসীকে তারা বােঝাতে চাইবে পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও অসামরিক শাসন-ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়েছে। দ্বিতীয়, এই ধাপ্পার আড়ালে বাংলাদেশের স্বশাসনের দাবিটি এড়িয়ে স্থিতিশীল কেন্দ্রের নামে ক্ষমতার আসল লড়াই জন্টার জেনারেলদের হাতেই রেখে দেওয়া যাবে। ডিসেম্বর একটি চরম সঙ্কটের মাস- এটা জেনেই বাংলাদেশ সরকার তাদের সীমিত সামর্থ্যসত্ত্বেও নভেম্বরের শেষ পক্ষে বাংলা দেশের অভ্যন্তরে মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা বহুগুণ বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। তারা হয়তাে জানেন এই চাপ সৃষ্টি দ্বারা সর্বাত্মক সাফল্য লাভ করা যাবে না। কিন্তু শত্রুপক্ষকে বাংলাদেশের স্বার্থের ও অধিকারের অনুকূলে একটা ন্যায় সঙ্গত রাজনৈতিক সমাধান মেনে নিতে বাধ্য করা যাবে, এমন একটা অশা তাদের মনে কাজ করে থাকতে পারে। অন্যদিকে পকিস্তানের সামরিক জুনটার নেতারাও জানেন এই ডিসেম্বর মাসই তাদের শেষ তুরুপের মাস। এই মাসে ইসলামাবাদ ও ঢাকায় তাদের পচ্ছন্দমত তথাকথিত অসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা ও বিশেষজ্ঞ দ্বারা তৈরি শাসনতন্ত্র বলবৎ করতে না পারলে বিশ্ব জনমতকে যেমন আর ধোকা দেয়া যাবে না, তেমনি ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অসহিষ্ণু রাজনৈতিক নেতা ও জনগণকেও আর সন্তুষ্ট রাখা যাবে না। তখন ঘরে বাইরে বিপদ দেখা দেবে। কিন্তু দীর্ঘ আট মাস চেষ্টার পরও তারা না পেরেছেন ঢাকায় একটি কার্যকর অসামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু করতে না পেরেছেন কেন্দ্রে ভুট্টো অথবা নুরুল আমিনের নেতৃত্বে তথাকথিত অসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ থেকে আশানুরূপ সমর্থন সংগ্রহ করতে। ফলে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ, ভারতের বিরুদ্ধে উসকানীমূলক যুদ্ধ তৎপরতা বৃদ্ধি এবং সবশেষে জরুরী অবস্থা ঘােষণা দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানে উগ্র ভারত বিরােধী বিকার এমন স্তরে তােলার চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে ডিসেম্বরে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি সম্পন্ন না হলেও বিকারগ্রস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের মধ্যে কোন বড় রকমের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা না দেয়। পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকদের মনে এখন দুটি মাত্র আশা। যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ-উত্তেজনার তীব্রতা বাড়িয়ে জাতিসংঘ অথবা বৃহৎ কোন শক্তির হস্তক্ষেপের আড়ালে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মুক্তিযুদ্ধের চাপ থেকে রক্ষা পাওয়া। অন্যথায়, ভারত-বিরােধী উত্তেজনা জিইয়ে রেখে ডিসেম্বরের প্রতিশ্রুতি-ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি এড়িয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ করার জন্য কালহরণের কৌশল অবলম্বন।

এই ব্যাপারে ইন্দিরা-সরকারের ভূমিকা থেকে এটা স্পষ্ট, তারা যুদ্ধ পরিহার এবং বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে এখনও আশা হারাননি। মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির চাপে পাকিস্তানের জঙ্গী চক্রের সুমতি ফিরবে এমনটা আশা হয়ত তারাও করেন। তাই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটি শ্রীমতী ইন্দিরা সম্ভবত পাকিস্তানের জঙ্গীচক্রের মাথায় সুক্ষ্ম সূতােয় বাঁধা তরবারির মত ঝুলিয়ে রেখেছেন। সীমান্তে ভারত পর্বতের মত দৃঢ়তা নিয়ে যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত। অন্যদিকে বাংলাদেশ সমস্যার ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক সমাধানের দাবিতেও সে অনড়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এখন সাপের ছুঁচো গেলার মত অবস্থা। যদি তিনি বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি ও শেখ মুজিবুর রহমানকে এড়িয়ে ইসলামাবাদে ভূট্টো বা নুরুল আমিনকে দিয়ে তারা তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করাতে চান তাহলে ভারত সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত প্রদান করবে। এই স্বীকৃতিদানের অর্থ কি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা তা ভালাে করেই জানেন। অন্যদিকে সামরিক এডভেনচার ছাড়া ভারতকে জব্দ করার জন্য কাশ্মীর রাজস্থানে আক্রমণ চালালে শুধু বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি তরান্বিত হবে না সর্বাত্মক যুদ্ধে পাকিস্তানের আত্মহত্যার পথও প্রস্তুত হবে। ইসলামাবাদে যতই চীনা সামরিক বিশেষজ্ঞ আসুক, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে চীন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না এটা আজ পাকিস্তানের সামরিক জুনটার কাছে স্পষ্ট। তাহলে তাদের জন্য এখন পথ কোথায়? আসলে এই উপায় এবং সমস্যা মুক্তির পথ খোঁজার কাজেই উন্মাদ হয়ে উঠেছে ইসলামাবাদের জঙ্গী  চক্র। তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের উপরই নির্ভর করছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বড় রকমের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হবে কিনা? যদি না হয় বিস্মিত হব না। যদি হয় তাহলেও ডিসেম্বরের প্রথম কয়েকদিন নিরাপদ এমন একটা ধারণা সম্ভবত পােষণ করা চলে।

২৭ নভেম্বর ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮ 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!