You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় প্রশাসনের অন্দরমহলে
পি এন ধর

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন পৃথ্বীনাথ ধর। পি এন ধরের জন্ম ১ মার্চ ১৯১৯, কাশ্মীরে। তিনি অর্থনীতিবিদ ছিলেন। ১৯৭৩ সালে পি এন ধর ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব হিসেবে যােগ দেন। ১৯ জুলাই ২০১২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পি এন ধরের স্মৃতিকথা ইন্দিরা গান্ধী, দ্য ইমার্জেন্সি, অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ডেমােক্রেসি (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০১) থেকে ‘দ্য বাংলাদেশ ক্রাইসিস’ অধ্যায়ের নির্বাচিত অংশ নিচে দেওয়া হলাে। অধ্যায়টি ২০০০ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলােতে প্রকাশিত হয়।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ২৪ মে লােকসভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেন। তাতে তিনি বলেন, এই ২৩ বছর ও তার বেশি সময় ধরে আমরা কখনােই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানাের চেষ্টা করিনি, যদিও পাকিস্তান একই রকম ব্যবহার দেখায়নি। এবং আমরা এখনাে কোনােভাবেই নাক গলাতে চাই না। কিন্তু আসলে ঘটছেটা কী? যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে দাবি করা হচ্ছে, তা এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হয়ে গেছে। আর তাই আমরা পাকিস্তানকে বলতে বাধ্য হয়েছি যে অভ্যন্তরীণ বিষয়ের নামে তারা যা করছে—যা কিনা আমাদের কোটি কোটি মানুষেরও শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলেছে—তা বন্ধ করতে। ভারতের মাটি ও ভারতীয় খরচের বিনিময়ে পাকিস্তান তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বা অন্য যেকোনাে সমস্যার সমাধান করতে পারে না। আর কোনাে উদ্বাস্তু না আসার মতাে পরিস্থিতি অবশ্যই করতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা ও মঙ্গল নিশ্চিত করতে হবে।’
পৃষ্ঠা: ১৭৬

ভারত আসলে যে জটিল সংকটের মুখােমুখি হয়েছিল, তা মােকাবিলার জন্য অসাধারণ দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। সে সময় একজন ধীরস্থির, অবিচল ও সচেতন নেতার প্রয়ােজন ছিল খুব বেশি, যিনি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন এবং সেই উদ্দেশ্যে জাতির সামগ্রিক সামর্থ্যকে ধাবিত করতে পারবেন। ইন্দিরা গান্ধী সেই সময়ের সেই নেতৃত্বই দেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সংকট মােকাবিলায় তিনি সরাসরি দায়িত্ব নেবেন। বেশ কিছু আমলা ও রাজনীতিবিদ এর তীব্র সমালােচনা করেন। সমালােচনার মূল বক্তব্যটা ছিল, তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে শুধু সামান্য কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে সমস্যা মােকাবিলার চেষ্টা করছেন। ওই কয়েকজন কর্মকর্তার গ্রুপটাকে বলা হচ্ছিল কাশ্মীরি মাফিয়া। বস্তুত, ওই গ্রুপটা অ্যাডহক কমিটি ছাড়া আর কিছু ছিল না। কোনাে নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানে ভারতের প্রশাসন প্রায়ই এ ধরনের কমিটি গঠন করে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি এন হাকসার (আমি যার স্থলাভিষিক্ত হই), বহিঃস্থ গােয়েন্দা কার্যক্রমের দায়িত্বে নিযুক্ত সচিব আর এন কাও এবং পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল ছিলেন মূল দায়িত্বে। তাঁদের সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব টি স্বামীনাথন ও প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লাল। এই গ্রুপের সদস্যদের সংক্ষিপ্ত নােটিশে ও অনানুষ্ঠানিকভাবে একত্র হওয়ার সুযােগ ছিল মূলত তাদের স্ব স্ব দপ্তরের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সচিবের মাধ্যমে এই গ্রুপের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ রাখতেন এবং নিজে সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকার জন্য মাঝেমধ্যে প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে যােগাযােগ রাখতেন। তারা ‘পঞ্চায়েত নামে নিজেদের পরিচয় দিতেন এবং স্বরাষ্ট্রসচিব গােবিন্দ নারায়ণ, অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক সচিব আই জি প্যাটেল এবং চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল (পরবর্তী সময়ে ফিল্ড মার্শাল) এম এইচ এফ জে মানেকশর সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রেখে চলতেন। এ ছাড়া অন্য কর্মকর্তাদেরও প্রয়ােজন অনুসারে তারা ডেকে নিতেন।
এটা বললে ভুল হবে যে এই গ্রুপটা কোনাে রকম মতবিরােধ ছাড়াই সব কাজ করত। তাদের মধ্যে অহংবােধ ও মেজাজের সমস্যা ছিল। ছিল ভিন্ন। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন। কাওয়ের যেকোনাে কিছুতে তাৎক্ষণিক জবাব প্রস্তুত থাকত। কোনাে রকম ধীরস্থির চিন্তাভাবনা তার ধাতে ছিল না। তিনি সব সময়ই দ্রুত যেকোনাে কাজ করতে ও ফলাফল পেতে চাইতেন। হাকসার খুব সতর্কভাবে পরামর্শ দিতেন এবং যে কাজের জন্য পরামর্শ দেওয়া হবে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট ভাবতেন। তিনি সদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নীতিমালাসমূহ পর্যালােচনা করতেন, তবে তা সুনির্দিষ্টভাবে। কাও সব সময় এই ভেবে উদ্বিগ্ন থাকতেন যে তার বুদ্ধি-পরামর্শগুলাে যেন বেশি কল্পনাপ্রবণভাবে ব্যাখ্যা করা
পৃষ্ঠা: ১৭৭

হয়। কে বি লাল সবকিছুতে অতিরিক্ত সময় নিতেন এবং গ্রুপের সবচেয়ে বুদ্ধিমান সদস্য হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে চাইতেন। এ ব্যাপারটায় কোনাে কোনাে সময় মানেকশ রূঢ়ভাবে, যাকে বলে প্রায় ধমকে উঠতেন। তিনি আবার নিজেকে উচ্চ আইকিউ-সম্পন্ন বলে দাবি করতেন। একজন খাস আমলা গােবিন্দ নারায়ণ সব সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান রক্ষা করতে চাইতেন এবং নিজের সীমানায় কাউকে প্রবেশ করতে দিতে চাইতেন না। স্বামীনাথন ছিলেন একজন ভালাে চেয়ারম্যান, যিনি সবাইকে নিজ নিজ বক্তব্য দেওয়ার সুযােগ দিতেন। তবে সমাপনী টানতে চাইতেন নিজে।
রাজনৈতিক পর্যায়ে এই সংকটপূর্ণ বিষয়গুলাে মন্ত্রিসভায় রাজনৈতিক কমিটির বৈঠকে বিবেচনা করা হতাে। এই কমিটি সময় ও সুযােগমতাে বসত এবং পরিস্থিতি পর্যালােচনা করত।
বাংলাদেশ সরকার খুব শিগগির ভারত ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আবেদন জানায়। ভারতের জনমত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুকূলে ছিল। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলও এর পক্ষে মত দেয় এবং এটি রােধ করতে ইন্দিরা গান্ধীর সমস্ত দক্ষতা প্রয়ােগ প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। স্বীকৃতি না দেওয়ায় তাঁকে কঠোর সমালােচনার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ কারণ ছিল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে পাকিস্তানের সঙ্গে আরেক দফা খারাপ সম্পর্ক এবং একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ জটিলতা তৈরি করা। কোনাে কোনাে রাজনৈতিক দল তাদের সমর্থন জোগাচ্ছিল মূলত তাদের দলীয় স্বার্থ ও আদর্শগত প্রচারণার জন্য। সিপিএম, যাদের পশ্চিমবঙ্গে ছিল অগণিত সমর্থক, চাচ্ছিল তাৎক্ষণিকভাবে স্বীকৃতি দিতে; কিন্তু কোনাে সামরিক সহায়তা ছাড়া। তাদের মতে, এটা করা হলে বাংলাদেশে যে জনতার লড়াই চলছে, তার জন্য ব্যাপারটা নিরাপদ হবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করতে পারে, এ বিষয়টার তারা তােয়াক্কাই করছিল না। তাদের চীনপন্থী মনােভাব এবং পূর্ব পাকিস্তানে সমমনা গােষ্ঠীর সঙ্গে যােগসূত্র ভারতের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) ছত্রচ্ছায়ায় অধিকতর চরমপন্থী দলগুলাে তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি চাচ্ছিল এ জন্য যে এতে ভারতে তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালাতে তারা সীমান্তের ওপার থেকে সমমনাদের ব্যাপক সমর্থন ও সহায়তা পাবে। এমনকি নির্বাচনে ও সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী তুলনামূলকভাবে কম চরমপন্থী বাম দলগুলােও উদ্বাস্তুদের নিজেদের ভােটব্যাংক বাড়ানাের কাজে প্ররােচিত করছিল। প্রচুর পরিমাণে উদ্বাস্তুর আগমন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও
পৃষ্ঠা: ১৭৮

ত্রিপুরায়, তাদের জন্য ভােট বাড়ানাের সুযােগ সৃষ্টি করেছিল।
উদ্বাস্তুদের মধ্যে বেশ কিছু বিরােধী শক্তি সংগঠিত হয়েছিল, যাদের একের সঙ্গে অন্যের কোনাে সুসম্পর্ক ছিল না। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্যরা ছিলেন পেশাগতভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক, যারা উচ্ছল’ গেরিলাদের ব্যাপারে অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করতেন। এ ছাড়া ছিল সামান্য রাজনৈতিক মতবাদ ও আদর্শগত কারণে বিভক্ত সশস্ত্র রাজনৈতিক কর্মিদল। বামপন্থী ছাত্রদলের কাছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা সহযােদ্ধা হওয়ার যােগ্য ছিলেন না। বিপরীতে বামপন্থীদের আওয়ামী লীগের কর্মীরা মনে করতেন যে এরা মস্কো বা বেইজিংয়ের ছাত্রচ্ছায়ায় পরিচালিত, আর তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য হুমকি। প্রতিটি দলই আলাদা আলাদা। দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য লড়াই করছিল। বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন বহুবর্ণিল ও ধারণাতীত ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যার প্রতি আমাদের বিশেষভাবে নজর রাখতে হয়েছে। সংকট শুরু হওয়ার আগে তিনি নিজেকে একজন শক্তিশালী চীনপন্থী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, যিনি ভারতবিরােধী হিসেবেও বিবেচিত হতেন। তাঁর ভাষায় ইয়াহিয়ার অমানবিক নির্যাতন’ এড়াতে তাঁকেও পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। প্রচণ্ডভাবে নিয়ত পরিবর্তনশীল ব্যক্তি ভাসানী বিস্ফোরণােন্মুখ বিবৃতি দিতে খুব পছন্দ করতেন। তাই আমরা চাচ্ছিলাম যাতে তিনি মিডিয়ার নজর থেকে দূরে থাকেন। বয়সের ভার ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের কারণেও তার জন্য শান্ত নিরালয়ে বসবাস করা অপরিহার্য ছিল। আর তাই রানীক্ষেতের এক মনােরম পাহাড়ি রিসাের্টে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তিনি এসবের ধার ধারতে চাইছিলেন না। এখানে আসার পরপরই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা পাঠাতে থাকেন, যাতে তিনি তাঁর দীর্ঘজীবী আদর্শের কথা এবং সেই আদর্শ অক্ষুন্ন রাখার কথা বলেন। আসামের ধুবরি গ্রামে যদি তাকে ‘পাঁচ একর জমি ও চারটি টিনশেড’ দেওয়া হয়, তাহলেই এটি অর্জন করা সম্ভব বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, সেখানে তাঁর ছেলের কবর ছিল। সেখানে থেকে তিনি তিনটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য লড়াই করবেন বলে জানান। প্রথমত, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন, দ্বিতীয়ত, স্বাধীন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং তৃতীয়ত, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠনের লক্ষ্যে কাজ করা। মওলানার তৃতীয় লক্ষ্য আমাকে ও কাওকে বিচলিত করে তােলে। তাঁকে বােঝাতে দুই মাসের বেশি সময় লেগেছিল যে ধুবরি একটা গােলযােগপূর্ণ এলাকা এবং তিনি যেখানে আছেন, সেখানে নিরাপদে থাকাই তার জন্য ভালাে।
পৃষ্ঠা: ১৭৯

অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ওসমানীর নেতৃত্বে প্রতিরােধ বাহিনী বা মুক্তিফৌজ গড়ে তােলে (পরে যার নামকরণ হয় মুক্তিবাহিনী)। অবশ্য ওসমানী নিয়মিত সেনাবাহিনীর বাইরে তাঁর কর্তৃত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। প্রতিরােধ আন্দোলনের রাজনৈতিক উপাদান তার জন্য অবােধ্য বলে প্রমাণিত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মন্ত্রিসভা অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাসে আক্রান্ত হয়। মন্ত্রিসভার কোনাে কোনাে সদস্য তাজউদ্দীনের সঙ্গে কমিউনিস্ট সংযােগ আছে বলে সন্দেহ করতে থাকেন। তাঁদের কেউ কেউ মন্ত্রিসভার অন্য কাউকে কিছু না জানিয়েই কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেটে যােগাযােগ করেন। তাদের মধ্যকার এসব বিরােধের জের হিসেবে স্বাধীনতাউত্তরকালে ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যবহার করার জন্য নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা গ্রুপ গড়ে তােলার তৎপরতা দেখা যায়।
এখানেই সবকিছুর শেষ নয়। আমরা ভালােভাবেই জানতাম যে মন্ত্রিসভার সবাই শেখ মুজিবের আস্থাভাজন নন। ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক আগে তিনি তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযােগ্য সহযােগীকে বলেছিলেন যে যদি তিনি মারা পড়েন বা সরে যান, তাহলে তাঁর যােগ্য উত্তরসূরি হবেন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত পাঁচজন ছাত্রনেতা, যাঁদের তিনি বলতেন খলিফা। তাঁরা ছিলেন শেখ মুজিবের ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও শাহজাহান সিরাজ। এই খলিফারা তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মােশতাককে একেবারেই পছন্দ করতেন না। তারা টি এন কাউল, পি এন হাকসার এবং ডি পি ধরের মস্কোঘেঁষা ইমেজের কারণে তাঁদেরও পছন্দ করতেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ওপর তাদের ছিল অগাধ বিশ্বাস। সেই সঙ্গে আর এন কাওকে তারা বিশ্বাস করতেন। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
এই খলিফারা মুজিব বাহিনী নামে আলাদা একটি বাহিনী গঠন। করেছিলেন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, প্রতিরােধ আন্দোলনের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে যেতে পারে এবং প্রকারান্তরে বামপন্থীদের প্রভাবে উপদলীয় হয়ে উঠতে পারে। আর তাই দুই দলের মধ্যে মারাত্মক সংঘাতের আশঙ্কা ছিল সব সময়ই। মুজিব বাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় একটি গেরিলাবাহিনী গঠন করেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি চীনের সমর্থনের কারণে চীনপন্থী কমিউনিস্টরা যথেষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল এবং নিজেরা অনেকগুলাে উপদলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে মােহাম্মদ তােয়াহার নেতৃত্বাধীন দলটি সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। তিনি দাবি করছিলেন যে
পৃষ্ঠা: ১৮০

তারা পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছেন। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ সােভিয়েত সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী নীতিতে প্ররােচিত হয়ে এই আন্দোলন করছে।
অবস্থা ছিল আসলেই বিপজ্জনক। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্যাপারে একক ও অভিন্ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে এসব বিভক্ত দলকে একত্র করাটা খুব প্রয়ােজনীয় হয়ে ওঠে। এটা আমাদের নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থেও দরকারি ছিল। কেননা, এ ধরনের বিভক্তি শেষ পর্যন্ত প্রতিরােধ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণের। বাইরে নিয়ে যেতে এবং ইতিমধ্যে সংলগ্ন ভারতীয় অঞ্চলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতাকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারত। ভারতের সহায়তা ছাড়া অস্থায়ী সরকারকে সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধী সােভিয়েত ইউনিয়নে তকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ডি পি ধরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে চেয়ারম্যান করে বহিঃসম্পর্কীয় মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি নীতিপরিকল্পনা কমিটি গঠন করেন। এক সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটি এককভাবে বাংলাদেশ সংকট বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিল।
ডি পি ধরের কাজটা ছিল খুবই ভয়াবহ, কিন্তু এ কাজের জন্য তিনি ছিলেন পুরােপুরি যােগ্য। তার আকর্ষণীয় ব্যবহার, অসাধারণ রসজ্ঞান ও নিখুঁত বুদ্ধিমত্তা এ কাজের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। নানা রকম ভিন্নমতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাত্রা আত্মস্থ করার অসামান্য বুদ্ধিমত্তা তাঁর ছিল। ধৈর্য না হারিয়ে বা কোনাে রকম বিরক্তি প্রদর্শন না করে শান্তভাবে বােকাদের কথা শােনার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। রাজনীতিবিদ, সৈনিক, সাংবাদিক ও বিপ্লবীদের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে তাদের ভাষায় চমৎকারভাবে কথা বলতে পারতেন। তাঁকে কমিউনিস্ট ভেবে পাঁচ খলিফা প্রথমে তার সঙ্গে দেখাই করতে চাননি। অথচ তারাই পরে ডি পি ধরের ভক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন বাঙালি নেতার সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলােচনার পাশাপাশি অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রাখার জন্য তিনি কলকাতায় একজন কমকর্তাকে নিয়ােগ করেন, যার মাধ্যমে মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ বজায় রাখতেন।
আগস্ট মাসটা পয়মন্ত বলে প্রমাণিত হলাে। কয়েকটি ঘটনা ইতিহাসের ধারাকে অনিবার্য করে তুলল, যা তুঙ্গে নিয়ে গেল ডিসেম্বরের যুদ্ধকে। ৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যাতে কোনাে রাখঢাক না করেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে সংকটের কোনাে শান্তিপূর্ণ সমাধান হচ্ছে না। সংকটের চালচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে শ্বেতপত্রে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে পুরােপুরি দায়ী করে বলা হয় যে তারা তাদের ম্যান্ডেটকে স্বায়ত্তশাসন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদে রূপান্তর করেছে। পুরাে শ্বেতপত্রে ছিল
পৃষ্ঠা: ১৮১

আওয়ামী লীগকে দোষারােপ এবং কীভাবে তারা পাকিস্তানকে ভাঙার পরিকল্পনা করেছে, সেই গল্প।
৯ আগস্ট ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে। আগের দুবছর ধরে এ চুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে বহু আলােচনা ও পর্যালােচনা হয়েছিল। কিন্তু তা কখনােই স্থায়ী বা জরুরি ভিত্তিতে নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পর্যায়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এ ধরনের একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা ও গ্রহণযােগ্যতার বিষয়ে সন্দেহ পােষণ করেন। ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে ভারতের ভাবমূর্তির। কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রীর নিজেরও এ ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীলতা ছিল। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ চুক্তির প্রতিক্রিয়া নিয়েও তিনি খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। বিশেষ করে, ভারত সােভিয়েত ইউনিয়নের শিবির হয়ে উঠবে বলে ডানপন্থীদের প্রচারণার ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হচ্ছিল। মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রচারকালে জেন সাং তাঁকে সােভিয়েত এজেন্ট বলে প্রচার। করেছিলেন। এর পাশাপাশি চুক্তির ফলে উৎসাহিত হয়ে বামপন্থীদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠার বিষয়টিও ইন্দিরার নজরে ছিল।
তবে সে সময় হেনরি কিসিঞ্জারের ঐতিহাসিক চীন সফরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর উপদেষ্টাদের মনােভাব চুক্তির অনুকূলে জোরালাে হয়ে ওঠে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিজে চীন সফর করার কথা ঘােষণার পর কিসিঞ্জার প্রকারান্তরে আমাদের এই বলে হুমকি দেন যে ভারতপাকিস্তানের বিরােধের ব্যাপারে চীন হস্তক্ষেপ করলে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে। এটা ছিল পররাষ্ট্রসচিব টি এ কাউলকে দেওয়া কিসিঞ্জারের আশ্বাসের উল্টো কথা। ১৭ জুলাই কিসিঞ্জারের সতর্কবাণীর পর যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রসচিব এই বলে পরামর্শ দেন যে ভারতের উচিত নিজ সীমান্ত এলাকায় গেরিলা কার্যক্রম বন্ধ করা এবং উদ্বাস্তুদের সাহায্যার্থে জাতিসংঘের সহায়তা নেওয়া।
ইয়াহিয়া খানকে শেখ মুজিবের সঙ্গে কোনাে রাজনৈতিক সমঝােতায় বসতে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনীহা ছিল খুব পরিষ্কার। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গােপন যােগাযােগের বিষয়টি আমাদের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে দাড়ায়। বিষয়টা জানার পর তাজউদ্দীনও খুব ভীত ছিলেন যে তার সহকর্মী হয়তে একটা বিবাদ সৃষ্টি করবেন। এই গােপন যােগাযােগের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ইন্দিরা গান্ধী চিন্তা করলেন যে আমেরিকাকে মুজিবনগর
পৃষ্ঠা: ১৮২

সরকারের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করতে উৎসাহিত করবেন। সেই মােতাবেক এল কে ঝার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও কিসিঞ্জারকে এই পরামর্শ দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমেরিকানরা তাদের পছন্দের লােক ছাড়া আর কারও সঙ্গে যােগাযােগ করল না, যাকে তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা, এমনকি ওসমানী পর্যন্ত অবিশ্বাস করতেন। এতেই তাজউদ্দীনের আশঙ্কা নিশ্চিত হয়। কিছুদিন পর খন্দকার মােশতাককে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে আমরা জানতাম, এরপরও আমেরিকার সঙ্গে মােশতাকের গােপন যােগাযােগ অব্যাহত ছিল। ঘটনাচক্রে মােশতাক সম্পর্কে তাজউদ্দীনের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়, যখন ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে শেখ মুজিবকে সপরিবার হত্যা করা হয় এবং মােশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন।
আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে, এমন কোনাে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার বদলে মার্কিন সরকার ইয়াহিয়া খানকে তাঁর নেতৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানি স্বৈরশাসককে আরেক দফা সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশি মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভারত সরকারকে চাপ দেওয়া হয়। বস্তুত চীনের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা জোগানাের জন্য ইয়াহিয়া খানকে পুরস্কৃত করা হয়। এই পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধীও ভাবলেন যে যথেষ্ট হয়েছে। আমাদেরও এ বাস্তবতা মেনে নিতে হলাে যে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের পরিকল্পিত উদীয়মান ভূরাজনৈতিক বিন্যাসে আমরা ভুল অবস্থানে রয়েছি।
বস্তুত ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালে ভারত সফরকালে হেনরি কিসিঞ্জার আমাকে আলাদাভাবে এ কথা বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন যে ১৯৭১ সালে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা থাকলে মিসেস গান্ধী সে সময় যা করেছেন, তিনিও তা-ই করার পরামর্শ দিতেন। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। সময়টাই ছিল সে রকম। বর্ষাকাল কেটে যাওয়ার পরপরই আবারও উদ্বাস্তুদের ঢল নামে। আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম সমস্যার সমাধানের জন্য। তখন আমাদের সামনে একমাত্র পথ খােলা ছিল অস্থায়ী সরকার ও এর সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীকে সামরিক সহায়তা দেওয়া।
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার বারবার অভিযােগ করছিল যে তারা ভারত থেকে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র পাচ্ছে না। স্বদেশ থেকে যেসব অস্ত্র তারা বহন করে এনেছিল, তা বিএসএফ রেখে দিয়েছিল এ আশঙ্কায় যে এসব অস্ত্র স্থানীয় চরমপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে। মুক্তিফৌজ গঠন করার পর অবশ্য
পৃষ্ঠা: ১৮৩

এসব অস্ত্র ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু এসব চীনা অস্ত্র শিগগিরই অকার্যকর হয়ে গেলে ভারত থেকে এগুলাে প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছিল না। ভারতের সহযােগিতা ছাড়া, তখন পর্যন্ত যা শুধু আশ্রয় ও সরবরাহের মধ্যে সীমিত ছিল, এই আশঙ্কা ছিল যে মুক্তিযােদ্ধারা স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে স্ফুলিঙ্গ হয়ে ভারতে রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম উৎস হয়ে উঠতে পারেন। বস্তুত অব্যাহত উদ্বাস্তু আগমনের কারণে অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চাপ প্রায় সহ্যাতীত হয়ে উঠেছিল। এমনকি কংগ্রেস পার্টি, যার ওপর ইন্দিরা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারাও কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল, যাতে জনগণকে নিশ্চিত করা যায় যে ভারত ভুক্তভােগী নয়। তা ছাড়া পরের বছর মার্চ মাসে কয়েকটি রাজ্যে স্থগিত নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা তাতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে দলীয়ভাবে উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। যদিও রাজনৈতিক দলগুলাে যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিয়েছিল, তবু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। মুক্তিবাহিনী শক্তিশালী হয়ে ওঠায় বাঙালিদের প্রতিরােধ আন্দোলন দৃঢ় হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ বাড়তে থাকে।
সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে আসলে এ আভাস দেওয়া হয় যে ভারত পূর্ব বাংলার সংকটের এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান দেখতে চায়, যার মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হয়। তখন একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র সরকারই পারত ইয়াহিয়াকে যেকোনাে সিদ্ধান্তে প্রভাবিত করতে। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার অল্প কিছুদিন পরই এ বিষয়টি ভারত-সােভিয়েত যুক্ত ইশতেহারে তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়ােজনীয়। পাকিস্তানকে প্রভাবিত করার মতাে আরেকটি দেশ ছিল চীন। রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছিল।
এ ছাড়া চীন সরকার ইয়াহিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিল রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে সংকটের একটা সুরাহার জন্য। সম্ভবত ভারতসােভিয়েত চুক্তি চীনকে এ ধরনের একটি পরামর্শ দেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এটা বিশেষভাবে প্রয়ােজন ছিল এ জন্য যে কিসিঞ্জারের চীন সফরকালে পাকিস্তানে উচ্ছাস বয়ে গিয়েছিল এবং তা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়াকে আরও কঠোর করে তুলেছিল। এ ঘটনাবহুল আগস্টের মাঝে একটা ব্যাপার আমাকে ব্যক্তিগতভাবে উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল। হাকসার ৪ সেপ্টেম্বর অবসর নেন এবং আমি তার
পৃষ্ঠা: ১৮৪

স্থলাভিষিক্ত হই। এ রকম একটা কঠিন সময়ে এ ধরনের একটা পরিবর্তন মেনে নেওয়া আমাদের জন্য খুব কঠিন ছিল। হাকসার চলে যাওয়া মানে একটা কিংবদন্তির অবসান। রাশিয়ার সঙ্গে হাকসারের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, আমার সেটা ছিল না। সংবাদমাধ্যমের লােকজনের কাছেও হাকসার ছিলেন বন্ধুবৎসল, এ ক্ষেত্রে আমি ছিলাম তার অনেক পেছনে।
আমরা পূর্ব পাকিস্তান সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহ এবং শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝােতায় আসতে ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সরকারগুলােকে উদ্বুদ্ধ করছিলাম। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে সমর্থন বৃদ্ধি করা হয়। মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত লড়াইয়ের ক্ষমতা ইয়াহিয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে তার সামরিক সমাধান কাজ করছে না। আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরােধী মনে হলেও আমাদের এই দুই নীতির একক উদ্দেশ্য ছিল একটি রাজনৈতিক সমাধান এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিহার।
এই দুই নীতিমালার অংশ হিসেবেই ইন্দিরা গান্ধী মস্কো, ব্রাসেলস, ভিয়েনা, লন্ডন, ওয়াশিংটন, প্যারিস ও বন সফর করেন। প্রথমেই তিনি যান মস্কোতে। কয়েক সপ্তাহ আগে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এ সফরে তিনি সােভিয়েত নেতৃবৃন্দকে ক্রম অবনতিশীল পরিস্থিতি এবং উপমহাদেশে যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে বােঝাতে সক্ষম হন। সােভিয়েতের উপলব্ধির ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে তিনি অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পশ্চিমা ব্লকের দেশগুলাে সফর করেন। সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে ২৩ অক্টোবর দেশবাসী ও রাজনৈতিক দলগুলাের উদ্দেশ্যে এক বার্তা প্রদান করেন। তাতে সবাইকে শান্তভাবে ও ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা রাগান্বিত হয়ে বা চটজলদি কোনাে কিছু বলতে বা করতে পারি না। বিদেশ সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের নেতৃবৃন্দকে আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা এবং তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করা এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
ইন্দিরা গান্ধী যখন তার শান্তি অন্বেষণের সফরে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের জন্য জঙ্গি মনােভাব গড়ে তােলা হচ্ছিল। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ১১ আগস্ট ইয়াহিয়া খান কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমকে এক সাক্ষাঙ্কারে বলেন, দুই দেশ যুদ্ধের খুব কাছাকাছি এসে গেছে। আমি আপনাদের এই বলে সাবধান করে দিতে চাই যে আমার দেশকে রক্ষা করার জন্য আমি যুদ্ধ করব।’ ২৯ আগস্ট লাহােরে জামায়াতে ইসলামীর [জমিয়তে
পৃষ্ঠা: ১৮৫

ওলামায়ে ইসলাম] মহাসচিব মাওলানা মুফতি মােহাম্মদ ঘােষণা করেন, ‘পাকিস্তানের নিজের স্বার্থেই সশস্ত্র যুদ্ধ করে আমাদের প্রতিবেশীকে আবার শিক্ষা দিতে হবে, যা তারা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর ভুলে গেছে। জামায়াতের সিন্ধু প্রাদেশিক প্রধান পাকিস্তান সরকারকে এই বলে পরামর্শ দেয় যে, জাতিকে ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।’ মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত সাফল্যে বিচলিত হয়ে ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করে। বসেন, ভারতীয়রা যদি ভেবে থাকে যে যুদ্ধ ছাড়াই তারা আমার ভূমির এক কোনা দখল করে নিতে পারবে, তাহলে তারা বড় ভুল করবে। আমি আপনাকে এবং সারা বিশ্বকে সাবধান করে দিতে চাই যে এর মানে হলাে যুদ্ধ। এবং যুদ্ধ।
রাজনীতিবিদ, ইসলামি মৌলবাদী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের এ ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি পুরাে পাকিস্তানে যুদ্ধংদেহী মনােভাব তৈরি করে। তথাকথিত ‘আজাদ কাশ্মীর’ সরকারের প্রেসিডেন্ট সর্দার কাইয়ুম খান ১৮ সেপ্টেম্বর এই বলে হুমকি দেন যে, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হবে দুই দেশে ধর্মের ভিত্তিতে শ্ৰেয় যুদ্ধ। যুদ্ধের হুমকি দেওয়া থেকে। রাজনীতিবিদেরাও পিছিয়ে ছিলেন না। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকারকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিরােধে পিপিপি সর্বাত্মক সহায়তা দেবে।’ পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান ঢাকায় এসে ঘােষণা করেন, ‘পাকিস্তান ভাঙার ভারতীয় ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে মুসলমানরা একতাবদ্ধ। ভারত যদি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে যায়, তাহলে তাদের পালিয়ে বাঁচতে হবে।’ জামায়াতে ওলামায়ে পাকিস্তানের জেনারেল কাউন্সিলে এক প্রস্তাবে ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণার আহ্বান জানানাে হয়। যুদ্ধের হুমকি যে শুধু ধমকধামক দিয়েই শেষ নয়, তা বােঝানাের জন্য পাকিস্তান সমগ্র পশ্চিম সীমান্তে সেনা মােতায়েন ও সেনা চলাচল বাড়াতে থাকে। সেই সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের যুদ্ধবিরতি সীমানায় সৈন্যসমাবেশ বাড়াতে থাকে, যা ছিল পুরােপুরি যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন। অক্টোবরের মাঝামাঝি পাকিস্তান তার বেশির ভাগ সৈন্যসামন্ত ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধপ্রস্তুতির অবস্থায় নিয়ে আসে।
আমাদের কাছে এটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব বাংলায় যে সংকট তৈরি করেছে, তার কোনাে রাজনৈতিক সমাধানে না গিয়ে বরং উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে যুদ্ধোন্মাদনা ছড়াচ্ছে। সমগ্র মনােযােগ গৃহযুদ্ধ থেকে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের দিকে ফেরানাের চেষ্টা করা হচ্ছিল। বর্ষা মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ায় নভেম্বরের প্রথম দিকেই মুক্তিবাহিনী তাদের
পৃষ্ঠা: ১৮৬

আক্রমণ জোরদার করে এবং বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুক্তিবাহিনীকে তাদের অবস্থান থেকে পিছু হটানাের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত এলাকায় হামলা চালাচ্ছিল। ২১-২২ নভেম্বর রাতে এ রকম একটি যুদ্ধের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যশােরের কাছে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ট্যাংক, হেভি আর্টিলারি ও বিমানবাহিনী নিয়ে এই আক্রমণের একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে ফেলে এবং ভারতের বয়রা এলাকার গ্রামে হামলা চালায়। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী তিনটি পাকিস্তানি বিমান গুলি করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ভূপাতিত করে এবং বিমান থেকে প্যারাস্যুটে লাফিয়ে নামা পাইলট তিনজনকে আটক করা হয়। মজার ব্যাপার হলাে, এই আক্রমণের ঠিক আগের দিনই ইয়াহিয়া খান ভারতের উদ্দেশ্যে তাঁর বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারণের আহ্বান জানান এবং নতুনভাবে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ার আহ্বান জানান। আবার ঠিক এক দিন পরই ২৩ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন। এ-সংক্রান্ত ঘােষণায় তিনি বলেন, বাইরের আগ্রাসনের কারণে পাকিস্তান হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় সমগ্র দেশে জরুরি অবস্থা জারির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’
পাকিস্তানের সমস্যা পূর্ব পাকিস্তান নয় ভারতের সঙ্গে, এ দাবির সঙ্গে ইয়াহিয়ার এসব কথাবার্তা ছিল সংগতিপূর্ণ। দ্বিধা-দ্বন্দ্বপূর্ণ বিশ্ব জনমত থেকে তাঁকে এড়ানাের জন্য ইন্দিরা গান্ধী অবিলম্বে তার অবস্থান সুস্পষ্ট করেন। ২৪ নভেম্বর সংসদের এক ভাষণে তিনি বলেন, “নিজের সৃষ্ট অবস্থার দায় আমাদের ওপর চাপানাের জন্য তিনি (ইয়াহিয়া খান) এ ঘােষণা (জরুরি অবস্থা) দিয়েছেন। বয়রার ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, এটি পুরােপুরি স্থানীয়ভাবে নেওয়া পদক্ষেপ।’ তিনি আরও বলেন, আমরা কখনােই সংঘাতে যেতে চাইনি বা এ ধরনের পরিস্থিতির উসকানি দিইনি। আমাদের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আত্মরক্ষার প্রয়ােজন ছাড়া তারা যেন সীমান্ত অতিক্রম না করে। তিনি সংসদকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, পাকিস্তান জরুরি অবস্থা ঘােষণা করলেও আমরা এ ধরনের কোনাে পদক্ষেপ নেব না যদি না জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়ােজনে পাকিস্তান আমাদের তা করতে বাধ্য করে। পাকিস্তানি শাসকদের অবশ্যই বুঝতে হবে, যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দমনের চেয়ে শান্তিপূর্ণ সমঝােতা ও সহাবস্থান অনেক বেশি ফলদায়ক।
২১ নভেম্বরের ঘটনা নিয়ে আমি ও ডি পি ধর দীর্ঘ আলােচনায় মিলিত হই। ডি পি ধর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উসকানিমূলক ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য স্থানীয় কমান্ডারদের দায়ী করেন। এর আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের মারমুখী মনােভাব সম্পর্কে গােয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে
পৃষ্ঠা: ১৮৭

আমরা যে রিপাের্ট পেয়েছিলাম, মূলত তার ভিত্তিতেই তিনি এ মনােভাব ব্যক্ত করেছিলেন। ডি পি ধর মনে করছিলেন যে আমাদের এমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে ওসব মাথাগরম জুনিয়র অফিসারকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া যায়, এমনকি তাতে যদি যুদ্ধ বাধে, তবু। আমি অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন মনােভাব প্রকাশ করেছিলাম এবং ইয়াহিয়ার যুদ্ধের হুমকিকে মৌখিকভাবেই নিয়েছিলাম। আমার কাছে ২১ নভেম্বরের ঘটনা ছিল আগামী দিনে যা ঘটতে যাচ্ছে, তার প্রাথমিক প্রকাশ।
ইয়াহিয়া খান ও তার সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধকে বেছে নেওয়ার হিসাব সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ ছিল এ রকম: পূর্ব পাকিস্তানে তিনি কোনাে গ্রহণযােগ্য বেসামরিক শাসন কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে এবং এর নেতাকে বিচারের জন্য বন্দী করে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও কোনাে রকম সমঝােতায় আসার অবস্থা তার ছিল না। সব মিলিয়ে যুদ্ধ ছাড়া তাঁর বিকল্প কোনাে পথ ছিল না। জয়ী হওয়ার আশা না থাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় কোনাে ফল লাভ হতাে না। বরং যুদ্ধে হেরে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হবে। এতে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে, যা সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করবে। এই অবস্থায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান খােয়ানাে অনেক ভালাে। এই যুদ্ধের ফলে পাকিস্তান হয়তাে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের পুরােটা না হলেও কিছু অংশ পেতে পারে এবং ভারতকে কাশ্মীর প্রশ্নে আলােচনার টেবিলে বসাতে বাধ্য করতে পারে, যেখানে পূর্ব বাংলা হারানাের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কাশ্মীর আসতে পারে। পাকিস্তানিদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধে জয়ী হওয়ারও একটা সম্ভাবনা ছিল চীনের সহায়তায়। নভেম্বরের প্রথম দিকে চীন সফর করার সময় ভুট্টো এ আশ্বাস পেয়েছিলেন বলেও দাবি করেছিলেন। তা ছাড়া যুদ্ধ পরিস্থিতি যদি পাকিস্তানের প্রতিকূলে চলেও যেত, তাহলে প্রধান শক্তিসমূহ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে বা ভারতের ওপর সরাসরি চাপ প্রয়ােগ করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে দিত। আমি আমার বিশ্লেষণের সমাপ্তি টেনেছিলাম এভাবে যে পাকিস্তানের হিসাব-নিকাশ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এবং এখন আমাদের শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা উচিত, যাতে ইয়াহিয়ার ঘাড়েই প্রথমে যুদ্ধ শুরু করার দায়টা এসে পড়ে। আমি ডি পি ধরকে নেপােলিয়নের সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করিয়ে দিলাম : ‘যখন তােমার শত্রু কোনাে ভুল করতে যাচ্ছে, তখন তাতে নাক গলিয়াে না।’ ডি পি ধর এটা মেনে নিতে রাজি হলেন।
পৃষ্ঠা: ১৮৮

২১ নভেম্বরের ঘটনার পর রাজনৈতিক সমাধানের আর কোনাে আশাই ছিল না। আমরাও যুদ্ধ শুরু হলে তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সব রকম পরিকল্পনা জোরেশােরে এগিয়ে নিচ্ছিলাম। বয়রার ঘটনার আগেই ইয়াহিয়া খান এক মার্কিন সাময়িকীকে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ অনিবার্য নয়, এ কথা আমি আপনাকে বলতে পারছি না। কেননা, এটা অনিবার্য।…’ এবং বয়রার ঘটনার তিন দিন পরই তিনি ঘােষণা করলেন, এ ১০ দিন আমি হয়তাে রাওয়ালপিন্ডিতে থাকব না, থাকব যুদ্ধের ময়দানে। তিনি অবশ্য তাঁর কথা রেখেছিলেন।
অনুবাদ : আসজাদুল কিবরিয়া।
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!