You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.01 | প্রধানমন্ত্রী সফর তাে প্রায় শেষ -পান্নালাল দাশগুপ্ত - সংগ্রামের নোটবুক

প্রধানমন্ত্রী সফর তাে প্রায় শেষ। 

–পান্নালাল দাশগুপ্ত

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে যেদিন ফিরে আসবেন সেদিন তিনি কী নিয়ে ফিরবেন, এই জল্পনা কল্পনা এখনও যেমন চলছে; তখনও তেমনি চলবে। চমকপ্রদ কিছু পদক্ষেপ নেবেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে, এটা যারা ভাবছেন, তারা বােধহয় হতাশই হবেন আমাদের মনে হয় । ইন্দিরা গান্ধী আজও তাঁর মনস্থির করতে পারেননি; একমাত্র কালহরণ করে দেখি কী হয় এই নীতি ছাড়া । সমগ্রভাবে ব্যাপারটা যদি অশুভ বলে মনে হয়, তবে অশুভস্য কাল হরণ, নীতি ভার মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম ও তার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামটি কি ভারতের পক্ষেও একটা অশুভ ব্যাপার বা ঘটনা? এটা কি একটা অনভিপ্রেত উৎপাত, না অবশ্যম্ভাবী একটি ঐতিহাসিক জন্মবেদনা যার মধ্যে সৃষ্ট হচ্ছে এই উপমহাদেশের জন্য এক নবীন প্রভাত?  বিদেশী দরবারে ইন্দিরা গান্ধী যে যুক্তি নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করছেন তা বড় মিনমিনে। তাছাড়া ভারত বাদী বা বিবাদী কোনটাই নয়, আসল সমস্যা পাকিস্তান ও তার প্রজাদের মধ্যে অর্থাৎ এক্ষেত্রে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে। পূর্ববঙ্গের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে, বিশেষ করে মুজিবর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয়া খান কথা বলুন, রাজনৈতিক সমাধানের এটাই হলাে একমাত্র পথ- একথা ইন্দিরাগান্ধী সবাইকে বার বার বলেছেন। তবে এবারে একটা কথা ইন্দিরা গান্ধী এ সম্বন্ধে যা বলেছেন তা সত্যিই প্রণিধানযােগ্য। | তিনি লনডনে ও ওয়াশিংটনেও ইঙ্গিত করেছেন যে, যদি ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে না পারেন বা না চান, তবে ইয়াহিয়া খান কি পাকিস্তানের পক্ষে একান্তই অপরিহার্য? অর্থাৎ ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে দিলেই তাে হয়, একটা দেশের (পাকিস্তানের) চেয়ে একটি ব্যক্তি (ইয়াহিয়া খান) বড় হতে পারে না। ইয়াহিয়া খান অবশ্য একক নয়, একটি গােষ্ঠীর প্রতীক পাকিস্তানের সামরিক গােষ্ঠীর ও অতিরক্ষণশীল স্বার্থের প্রতীক । ইয়াহিয়া খান গেলে এই গােষ্ঠীকেই যেতে হয় এবং খাস পশ্চিম পাকিস্তানেই একটা বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে। এই জাতীয় একটা পথ যে ইন্দিরা গান্ধীই আবিষ্কার করেছেন তা নয়, এই পথটা ইতিহাসের ড্রয়িংরুমে উহ্যরূপে উপস্থিত আছে পশ্চিম পাকিস্তানেও এই প্রশ্নটি আছে, কিন্তু এ প্রশ্ন করার সাহস আজও সেখানকার কোন বিরােধী নেতৃত্বের পক্ষে আসেনি।

ইন্দিরা গান্ধীকেই শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্ন ও তার সমাধানের ইংগিতটি লনডন ও ওয়াশিংটনে উত্থাপন করতে হলাে। খবরের কাগজগুলি এই তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিতটার তেমন গুরুত্ব দেয়নি দেখে কিছু আশ্চর্য হতে হয়। ব্রিটিশ বা আমেরিকান সরকারও এই ইঙ্গিতটা যেন শুনেও শােনেনি এমনকিভাবে চুপ করে আছে। অথচ এই ইঙ্গিতটা কোন একটি ব্যক্তির ইঙ্গিত নয়, ইতিহাসেরই এই ইঙ্গিত পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে ইয়াহিয়া খানকে বিদায় করে দেবার ইঙ্গিত তা না হলে পাকিস্তানের কোন চিহ্ন থাকাও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে- ‘পাকিস্তান’ হিসেবে সম্ভাব্য কোন যুদ্ধের ফলে। | কিন্তু শেখ মুজিবর রহমানকে বিনা শর্তে মুক্তি দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ইয়াহিয়া খানকে বাধ্য করতে আমেরিকা বা ব্রিটেন কেউ চাপ দিতে রাজী হলাে না। আর চাপ সৃষ্টি করতে পারে কে? পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া বিরােধী কোন রাজনৈতিক শক্তি যদি থাকে, তবে তারা পারে। কিন্তু এই ভরসাও কিছু আত নেই। যে ভুট্টো কথায় কথায় অগ্নিবর্ষণ করে থাকেন, তার হাতে ক্ষমতা না দিলে তিনি ইয়াহিয়া খানদের যা তা। করে দেবেন বলে সেদিনও হুমকি দিয়েছেন, সেই ভূট্টোর ভূমিকাটা কি? তিনি ইয়াহিয়া খানের প্রধান প্রতিনিধি হয়ে সমর বিভাগের প্রধানদের নিয়ে গিয়েছেন পিকিং তাদের সমর্থন ও অস্ত্র পাতির সাহায্যের জন্য। পূর্ব বাংলাকে কোতল করার গােপন উপদেশ ও সমর্থন একদা দিয়েছিল এই ভূট্টোই ইয়াহিয়া খানদের। পূর্ববঙ্গের এই হাল করার দায়িত্ব ভূট্টোর কিছু কম নয়। অতএব আজ যদি ইয়াহিয়া খান ভূট্টোকে বলেন যে, তােমার বুদ্ধিতেই তাে আমার এই অবস্থা, আজ যদি তুমি পাকিস্তানের ক্ষমতা চাও, তবে পাকিস্তানকে রক্ষা করে, আর তুমিই তাে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের নতুন সম্পর্কের জন্মদাতা বলে প্রচার করে। থাকো, এখন তুমিই যাও পিকিং-এ। এবং তুমি যদি চীনের সক্রিয় ও প্রকাশ্য সমর্থন আদায় করে আনতে পারাে, তবে হয়তাে পাকিস্তান রক্ষা পাবে এবং তোমাকেই প্রধান মন্ত্রী করা যাবে’। ইয়াহিয়া খানের নিজের সব তাস খেলা হয়ে গেছে, তাই তার তথাকথিত বিরােধীদেরও নানা লােভ ও টোপ দেিয় নিজের টলমল অবস্থার সামাল দিতে চেষ্টা করবেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত বিরােধী দলগুলির নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এই থেকেই বােঝা যাবে। 

আপাতত পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর থেকে ইয়াহিয়া খানকে সরাবার মত কোন শক্তিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  একদা আৰখান মওলানা ভাসানীকে পাঠিয়েছিলেন পিকিং, মৌলানা সাহেব আজ তার সেই কর্মের জন্য । অনুতপ্ত, কিন্তু ভূট্টোর কোন লাজলজ্জাও নেই, সততাও নেই। ভূটো জানেন, ইয়াহিয়া খান গেলে তাকেও যেতে হবে।  মােট কথা পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক ওলটপালট এক্ষুনি আশা করা যায় না। একমাত্র বাংলাদেশের। মুক্তি যােদ্ধারাই ভরসা। তাদের কোমর বেঁধে বেশ কিছু কালের জন্য মরিয়া হয়ে লড়াই করে যেতে হবে। এবং তারা যাতে লড়াই করবার মত সাজসরঞ্জাম যথেষ্ঠ পরিমাণে পান; তাদের শিক্ষাদীক্ষা আরও উপযােগী। হয়- পাক বাহিনীর সঙ্গে ভালভাবে মােকাবিলা করার মত অস্ত্রশস্ত যাতে তাঁদের মেলে সেটাই একমাত্র কথা। তারা যাতে লড়ত না পারেন তার জন্যই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে সীমান্ত থেকে সরিয়ে আনবার জন্য চাপ দিচ্ছে আমেরিকা, ব্রিটেন প্রভৃতি কুচক্রীরা। অন্তত এ বিষয়ে যাতে ইন্দিরা গান্ধী অটল থাকেন এটুকু আজ। দেশবাসীকে দৃঢ়ভাবে দেখতে হবে।  আর ভারত সরকার যদি সত্যিই সক্রিয় হস্তক্ষেপ না করেন বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিয়ে যুদ্ধের ঝুঁকি না-ই নিতে চান, তবে তাদের পক্ষ থেকে মুক্তিবাহিনীকে অবিলম্বে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ নীতি গ্রহণ করে। ‘মুক্ত অঞ্চল সৃষ্টি করতে চাপ দেওয়া বা কোন উস্কনি দেওয়া উচিত নয়, আমাদের দেশের খবরের। কাগজগুলিকেও এ জাতীয় উস্কানি দিতে বাধা দেওয়া দরকার । মুক্ত অঞ্চল তখনই করা উচিত হবে, যখন মুক্ত অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ দূরপাল্লার, কামান, বিমান বিধ্বংসী কামান ইত্যাদি দেওয়া সম্ভব হবে। এবং তা চালাবার মত ক্ষমতা তাদের হবে। নইলে এই সব মুক্ত অঞ্চলগুলির উপর যখন পাক সামরিক বাহিনীর প্রচণ্ড প্রতিরােধ আসবে দূরপাল্লার কামান থেকে আর আকাশ থেকে বম্বারির ফলে, তখন। মুক্ত অঞ্চল থেকে আবার হটে আসতে হবে এবং মুক্তি যােদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যা অসম্ভব বড়ে যাবে। যদি এসব অস্ত্রশস্ত্র ও প্রতিরােধ শক্তির জোগান না-ই দেওয়া হয়, তবে তাদের সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীকে সাগর জলে ভাসিয়ে দেবার ঢালাও হুকুম দেওয়া উচিৎ হবে কি?

এ জাতীয় হুকুম বা বাহবা জাতীয় প্রচারণ থেকে স্মল আর্মস’ নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীকে মােকাবিলা করার উত্তেজনায় মুক্তি যুদ্ধে লিপ্ত ছেলেদের মধ্যে। হতাহতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই বেশ বেড়ে গিয়েছে। এভাবে এদের মরতে দেওয়া ঠিক নয়। বরং তাদের। শিক্ষাদীক্ষা আরও ভালাে করে দিয়ে একটু সময় নিয়েই করা হােক। মাত্র তিন সপ্তাহের ট্রেনিং-এ সম্মুখ যুদ্ধ হয় না; মুক্ত অঞ্চলের লড়াই হয় না। তারা গেরিলা যুদ্ধই এখন করুক, ব্যক্তি সন্ত্রাসের কর্মকাণ্ডই চালিয়ে । যাক, রেল, জাহাজ, মােটরের যােগাযােগ ব্যবস্থা অচল করতে থাকুক, মােট কথা ভারতের পক্ষ থেকে সক্রিয়। সাহায্য যদি না-ই দেওয়া হয়, তবে মুক্তিবাহিনীকেই তার শক্তি মত সময় নিয়ে লড়তে দেওয়া হােক। আর তাদের যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া-যার সাহায্যে পাক বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র যাতে তারা কেড়ে নিতে পারেন। | যদি মােটামুটি ভাবে ইন্দিরা গান্ধীর বর্তমান পলিসি সােভিয়েত রাশিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া প্রভৃতি। বন্ধুরাষ্ট্রগুলিও সমর্থন করে, অর্থাৎ পাকিস্তানের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম ভিন্ন অন্য সব উপায়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চায়- যা তাদের ভক্তরা বােঝাতে চেষ্টা করেন, তবে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে যাতে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র পৌছায় সে দায়িত্বও তাদের নিতে হয়। আজেবাজে অনেক কথায় এখন কোনও দাম নেই, কথা কখনাে কাজের স্থান নিতে পারে না। নিষ্ঠার কষ্টিপাথর এই ক্ষেত্র হলাে, এটা দেখা যায় যে মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছ কি দিচ্ছ না। কাউকেই কিছু চাপ দিয়ে রাজনৈতিক মীমাংসা করাতে পারলে না, ইয়াহিয়া খানকে টলাতে পারলে না, তবে ও সব বাজে কথা বলে লাভ? এ কথা ভাবতে লজ্জা লাগে যে, আজ মুক্তি যুদ্ধে আহত ছেলেদের দেহ থেকে বুলেট বের করে দেবার মত যথেষ্ট সারজিকেল ইনমেন্ট পর্যন্ত নেই, টরচের আলােতে ব্লেড দিয়ে বুলেট বের করার খবরও আছে। আসন্ন শীতে একটা করে সােয়েটার পর্যন্ত কেউ পায়নি। এসব কথা শুনতে ভাল লাগে না, ভাল লাগে কোন্ কোন্ অঞ্চল মুক্ত হয়ে গেলাে- নয়? ভারত আত্মপ্রতারণা থেকে মুক্ত না হলে বাংলাদেশ মুক্ত হবে না।

১ নভেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা