দুইযুদ্ধ, একযুদ্ধ, সীমাবদ্ধ না সার্বিকযুদ্ধ
— পান্নালাল দাশগুপ্ত
যুদ্ধ কি লাগবে, এই প্রশ্নটাই আজ সকলের। এ প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। ভারত সরকার বলেন, “আমরা জানি না। কেননা ভারত কখনও গায়ে পড়ে যুদ্ধে নামবে না। ভারত সরকার বলেন, যুদ্ধে হবে কি হবে না, জানে পাকিস্তান। পাকিস্তানই যুদ্ধ লাগাতে পারে, আচমকা অতর্কিত আক্রমণ করেও বসতে পারে। অতএব ভারত নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না, ভারতকে সার্বিক প্রস্তুতি করতে হবে সর্বপ্রকার অবস্থা ও ঘটনার জন্য। ভারত সরকার বলেন, তারা প্রস্তুত, প্রস্তুত প্রত্যুত্তর দেবার জন্য কিন্তু যুদ্ধ তারা বাধাবেন না, বাধায় যদি বাধাবে পাকিস্তান। এই একটি বিষয়ে ভারত সরকারের ভাষ্যকে বিশ্বাস করা উচিত। বাংলাদেশ সমস্যার গােড়া থেকেই ভারত যুদ্ধে যাতে নামতে না হয় তার জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করে চলেছে। যখন দুই দিকেই এখন সৈন্য সমাবেশ হয়েছে এবং আকাশে বারুদের গন্ধ পাচ্ছে সবাই, তখনও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমা দুনিয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বিশ দিনের জন্য বাইরে চলে গেলেন । যদি অবিলম্বে যুদ্ধ করা বা বাংলাদেশের ব্যাপারে কোন গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ করার প্রােগ্রাম থাকতাে, তবে প্রধানমন্ত্রী এত সমস্যা ও সঙ্কটসঙ্কুল ভয়াবহ। অবস্থাতে, ভারতকে ফেলে বিদেশে এতদিনের জন্য যেতে পারতেন না। স্রেফ নিমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় এটা নয়। আসলে বিদেশে রাষ্ট্রনেতাদের বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের। সমস্যা শেষবারের মতাে বােঝাবার জন্যই হয়তাে তার এই যাত্রা। যে উদ্দেশ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বর্ণ সিং। সহ প্রায় সব মন্ত্রীই বিদেশে ঘুরেছেন এবং অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক নেতারা গিয়েছিলেন, সেই উদ্দেশ্যেই প্রধানমন্ত্রীও যাচ্ছেন, অর্থাৎ যুদ্ধবিগ্রহ না করে বাংলাদেশ সমস্যা ও শরণার্থী সমস্যা কী করে দূর করা যায়। ভারতের রাষ্ট্রদূতেরা, প্রতিনিধিরা, মন্ত্রীরা সবাই যা করতে পারেননি, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজে গিয়ে দেখছেন বিদেশী রাষ্ট্রনায়কদের বােঝাতে পারেন কি না। সােভিয়েত রাশিয়াতে আগেই গিয়েছেন, ইন্দোসােভিয়েত বন্ধুত্ব চুক্তি করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশ সম্বন্ধে ভারতের নীতিকে সােভিয়েত-গ্রাহ্য করতে পারেননি। বাংলাদেশ সম্বন্ধে সােভিয়েত ও ভারতে মতৈক্য হয়নি—যদিও পরােক্ষে ভারতের উপর পাকিস্তান বা অন্য। কারাে সম্ভাব্য আক্রমণ-যে কোন কারণেই হােক—এই চুক্তির দ্বারা কিছুটা প্রতিহত হয়েছে। উদ্দেশ্যে একই। যাতে ভারত যুদ্ধ করতে না চাইলেও, অন্যরা যেন গায়ে পড়ে ভারতকে আক্রমণ না করতে আসে। এক্ষেত্রেও ভারতের যুদ্ধ না করার নীতিই প্রতিফলিত হচ্ছে। পাছে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করলেও পাকিস্তান যুদ্ধ। বাধিয়ে বসে, এই চিন্তা থেকেও এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
এত সব ব্যাপারের পরও যখন আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ ভারতকে সংযত থাকার জন্য এবং সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবার জন্য চাপ দিচ্ছে, তখন তার অর্থ কি? দুই দেশের সৈন্যবাহিনী মুখােমুখি দাঁড়িয়ে থাকলে, দুই দেশের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভুল বুঝেও হঠাৎ একটা যুদ্ধ লেগে যেতে পারে এই হবে এদের যুক্তি। কে আগে সৈন্যবাহিনীকে ব্যুহ রচনা করে সীমান্তে দাঁড় করিয়েছে, কে বাংলাদেশ বলে একটা সমস্যা সৃষ্টি করেছে, এসব বাছবিচার শান্তিকামী মুরুব্বীদের নেই। ভারত ও পাকিস্তানকে তারা একই চক্ষে দেখে, ব্যাপারটা যে কী, সে কথা এই মুরুব্বিরা জানেন না তা নয়। আসল ব্যাপারটি হলাে, বাংলাদেশে একটা যুদ্ধ চলেছে। সে যুদ্ধ লাগবে না, অনেকদিন ধরেই লেগে। গেছে। ভারতের কাছ থেকে পরােক্ষে যে সাহায্য পায় মুক্তিযােদ্ধারা সে সাহায্যটা কীভাবে বন্ধ করা যায় এই হলাে মুরুব্বিদের উদ্দেশ্য। মুক্তিযােদ্ধারা সীমান্ত বরাবর একটা নিরাপদ পশ্চাৎভূমি বা আশ্রয় পাচ্ছেন, দরকার মতাে এগুতে পেছুতে পারছেন হয়তাে সীমান্ত দিয়ে কিছু সংগ্রামের রসদ পাচ্ছেন-যত সামান্যই হােক, বাংলাদেশের কতক কতক অঞ্চলে আধিপত্য রক্ষা করে সংগ্রামের ক্ষেত্র রচনা করতে পারছেন এবং এর ফলে মুক্তিবাহিনী ক্রমশ একটা স্থায়ী ও বর্ধমান শক্তি হয়ে উঠতে পারে-এ সুবিধা যাতে মুক্তিবাহিনী না। পায় তারই জন্য ভারতকে সীমান্ত বরাবর সৈন্যবাহিনী দাঁড় করাতে মুরুব্বিদের আপত্তি। পাকিস্তানের ও এই আর্জি বিশ্ব মুরুব্বিদের কাছে। অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীকে উপােস করিয়ে চারদিক থেকে বন্ধ করে, গলা টিপে মারাই হলাে এই আপত্তির মূল উদ্দেশ্য! | অতএব বলা যায়, যুদ্ধ দুটি। একটি যুদ্ধ বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান, যে যুদ্ধ লেগেই আছে, লাগবে এবং উত্তরােত্তর তার তাপ ও চাপ বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। আর একটি যুদ্ধ হলাে পাকিস্তান বনাম ভারত-যে যুদ্ধটা লাগেনি, তবে লাগতে পারে।
তবে প্রথম যুদ্ধটি দ্বিতীয় যুদ্ধকে ডেকে আনতে পারে। যদি মুক্তিবাহিনীর মুক্তি-সংগ্রাম আরও বেশি দানা বেঁধে ওঠে এবং ক্রমশ দুর্বার হতে থাকে তবে পাকিস্তান গায়ে পড়েই ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপের আড়ালে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করবে। এ অবস্থাটা কার্যকারণ। সূত্রে আসবেই-যদি না কোন দৈব কিছু ঘটে যায়, অর্থাৎ খাস পাকিস্তানে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানেই কোন রাষ্ট্রীয় ওলটপালট ঘটে যায়। আর ভারত যদি কোন অবস্থাতেই যুদ্ধ করতে যাবে না মনে করে, তবে বাংলাদেশ বাঁচুক কি মরুক, মুক্তিযােদ্ধারা মুছে যাক বা না যাক-কোন প্রকার দায়িত্বই ভারত স্বীকার করবে। কিন্তু এতটা চোখ উলটে দেওয়া ভারতের নিজের স্বার্থেই অসম্ভব। ভারতের সমস্যা কেবল এক কোটি শরণার্থী-আর কিছু নয়-এ হেন যুক্তি হাস্যকর। যত কোটি টাকাই লাগুক এক কোটি শরণার্থীকে কয়েক বছর পুষতে, তাও যদি মুরুব্বিরা সবটা দিতে রাজী না হয় তবে কি ভারত চোখ উলটে বসে থাকতে পারে? এক কোটি লােক কেন, প্রতি বছর ভারতে দুই কোটি করে নতুন লােক বাড়ে-তাদেরকেও তাে ভারতকে পুষতে হয়, হবে। এক কোটি লােকের খরচ বা অর্থ নীতিটা আসল প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটি রাজনৈতিক। বাংলাদেশ বলে যে একটি ঘটনা বা ‘ফেনােমেনা’র উদ্ভব হয়েছে সেটি আকস্মিক নয়, অস্বাভাবিক নয়, অনৈতিহাসিক নয়, একটি ভারতবর্ষ বা পাকভারত উপমহাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বা দুটি দেশে ভাগ করেও সংশােধন করা যায়নি-১৯৪৭ সালে। এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার কি ভারতের ব্যাপার—এভাবে নির্দিষ্ট করা চলবে না। এটি এমন একটি ব্যাপার যা পাকিস্তানের, পাক-ভারত উপমহাদেশের এবং শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও সর্বমানবিক। এর সমাধানের মধ্যেই জড়িয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদের শেষ শিকড় জাতিপাতিজাত সাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক প্রগতির পথে যাবতীয় অন্তরায়ের মূলােচ্ছেদের চূড়ান্ত সমাধান। এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের দিক থেকে কোন আপস নেই-আপসের স্থান নেই।
এই জন্যই প্রথম যুদ্ধটি দ্বিতীয় যুদ্ধে ‘এসকালেট বা প্রসারিত হতে চায় এবং তাতে টান পড়ে সকল বৃহৎ শক্তিজোটের স্বার্থে,-মুরুব্বিদের মৌরসী পাঠায়। দুটি যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধেই প্রসারিত হতে চায়। যাতে দ্বিতীয় যুদ্ধটি লেগে গিয়ে একটা চূড়ান্ত সমাধান না হয়ে যায়-তার দিকে তীব্র দৃষ্টি মুরুব্বিদের, কেননা তাতে এই উপমহাদেশে মাতব্বরি করার আর কোন ক্ষেত্র থাকবে না কারও। কিন্তু বর্তমানে যুদ্ধের বাস্তব অবস্থাটা সত্যি কি? যে দুই যুদ্ধের কথা বলা হলাে, তা কি এখুনি একই যুদ্ধের আকার নিচ্ছে না? ভারতের পূর্ব সীমান্ত বরাবর যে গুলিগােলা ও হামলা প্রতিহামলা চলেছে, তা বাস্তবে পাকিস্তান ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও গােলাগুলি বিনিময়ে পর্যবসিত হচ্ছে। পাকিস্তানীরা দূর পাল্লার কামান ব্যবহার করছে, যার গােলাগুলি খাস ভারতের অভ্যন্তরে এসে পড়ছে, এমন কি আগরতলার মতাে ত্রিপুরার রাজধানীর মধ্যেও এসে পড়ছে। পাকিস্তানীরা বলবে, কী করবাে, বাংলাদেশ-মুক্তিবাহিনীকে তাড়া করতেই তাে হবে তাদের, তাদের বেসগুলি ভারতের সীমান্তে, দরকার মত তারা ভারতে আশ্রয় নেয় এবং ভারতীয় সৈন্যবাহিনী তাদের কামান ও মর্টারের কভার বা আচ্ছাদন দেয়। ভারত বলবে, বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধের ঝামেলা আমরা কত পােহাবাে এ ঝামেলা বা এ যুদ্ধ যাতে আমাদের গা ঘেঁসে পাকিস্তানীরা না করতে পারে তার জন্য সীমান্ত রক্ষায় ও স্বদেশ রক্ষার প্রয়ােজনে পালটা গােলাগুলি করতেই হবে। তা ছাড়া ইতিমধ্যেই গুপ্তচর বাহিনীর সাহায্যে কাছাড়ে ও অন্যত্র পাকিস্তান ভারতের মধ্যেই অন্তর্ঘাত ও অরাজকতা সৃষ্টি করে এক ধরনের গােপন যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়নি কি? এই কার্যকলাপ তাদের আরও বেপরােয়াভাবে চলবে বলেই ধরে নেওয়া উচিত।
এইভাবে সীমান্ত বরাবর একটা যুদ্ধ বা দ্বিতীয় যুদ্ধটাও লেগে গেছে। ভারতীয় নাগরিকেরাও সীমান্ত অঞ্চল ত্যাগ করে ভিতরে আসতে শুরু করেছে, আর পাকিস্তান তাে এ যুদ্ধ করবাে বলেই পূর্বনির্ধারিত পলিসি অনুযায়ী তাদের সীমান্ত বরাবর গ্রামগুলিকে জনশূন্য করে দিচ্ছে। কিন্তু এই যুদ্ধ সহসা একটা সার্বিক ‘শুটিং ওয়ার’ বা অল-আউট ওয়ারে পরিণত না-ও হতে পারে। যাকে বলে অঘােষিত “লিমিটেড ওয়ার’ বা ‘সীমাবদ্ধ যুদ্ধ তাই কিছুকাল ধরে চলতে পারে-দুই দেশের মধ্যে অর্থাৎ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। যেমন ভিয়েতনামের যুদ্ধ একটা খুব বড় যুদ্ধ, এমন কি তৃতীয় মহাযুদ্ধও বলা চলে, যেখানে বিশ্বের প্রায় সকল বৃহৎ রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে অংশ নিয়েছে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রটা বিস্তৃত হতে দেয়নি, একা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই সেই শক্তিপরীক্ষা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। তাই বলে গুলি-গােলা ও অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার ও লােকক্ষয়ের দিক থেকে তা সীমাবদ্ধ নয়, এত বােমা পড়েছে সেখানে যা গত দ্বিতীয়। মহাযুদ্ধেও ব্যবহৃত হয়নি। তেমনি যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশ’ সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন একটা সীমান্ত বরাবর সীমাবদ্ধ যুদ্ধ চলতে থাকে তার ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যবহারও সামান্য বা সীমাবদ্ধ থাকবে। -সর্বশক্তি দিয়েই এই সীমাবদ্ধ যুদ্ধে উভয় দেশ তাদের শক্তিপরীক্ষা করতেই থাকবে। এই পরিস্থিতিকে বুঝে স্বীকার করে নিয়ে দৃঢ়চিত্তে অগ্রসর হওয়াই সমীচীন নইলে এটাকে একটা টোআই-লাইট যুদ্ধ মনে। করে চললে বেয়াকুব বনে যেতে হবে এবং অযথা অন্তহীন দুঃখ ভােগ করতে হবে জনসাধারণকে দীর্ঘকাল পাকিস্তানের সঙ্গে এই যুদ্ধ ভারত সরকার চান না। না চাইলেও যদি যুদ্ধ করতে হয় তবে ভারতের স্বার্থ নিশ্চয়ই একটি সীমাবদ্ধ যুদ্ধে, সার্বিক যুদ্ধে নয়।
কেননা, ভারত পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তেই যুদ্ধ করতে চাইবে কেন? ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে অনায়াসেই দীর্ঘদিন ঘিরে রেখে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যােগসূত্র ও সরবরাহসূত্র অনায়াসে ছিন্ন করে দিতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশে পরাজিত হয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। তারা প্রতিশােধ নিতে চাইবে পশ্চিমাঞ্চলে। তারা অবিলম্বে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলার পক্ষপাতী, কিন্তু ভারত কেন গায়ে পড়ে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলতে যাবে? অবশ্য যদি পূর্বেই ভারত পশ্চিম ও কাশ্মীর সীমান্ত বরাবর সৈন্য সামন্ত মােতায়েন করতাে, তবে পূর্ব পাকিস্তানে অত সৈন্যসামন্ত ও সাজসরঞ্জাম পাঠাতে পাকিস্তান সাহস পেতাে না, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সংগ্রামটা সহজ হতাে, কিন্তু ভারত তা না করে ভুলই করেছিল হয়তাে। তবে ইতিমধ্যে পাকিস্তান যত সৈন্যসামন্ত আর যন্ত্রপাতিই পূর্ব পাকিস্তানে এনে থাকুক না। কেন, সেগুলি শেষ পর্যন্ত আটকা পড়েই যাবে-যদি সত্যি সত্যি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধটা সক্রিয় ও মুক্ত আকার নেয়। আটক অবস্থায় যা এনসারকেলড হয়ে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করার মতাে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পূর্ব বাংলায় বা বাংলাদেশে আজ পাকিস্তানের কিছুতেই হতে পারে না, যদি না চীন বা অন্য কোন রাষ্ট্রকে নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কোন দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলাতে পারে।
অবস্থাটা তাই পাকিস্তানের পক্ষে বেপরােয়া, অসহনীয় এবং যত দিন যাবে তত তার অবস্থার অসহায়তা তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে ছাড়বে। কাজে কাজেই পাকিস্তান সীমাবদ্ধ যুদ্ধের মধ্যে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না-তার পক্ষে এস্পার কি ওস্পার করে ঝাপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া স্বাভাবিক-উভয় ফ্রন্টেই যুগপৎ যুদ্ধ লাগিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপ ডেকে এনে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা সৃষ্টি করার প্রেরণা তার থাকা স্বাভাবিক এবং এই জন্যই তাকে অনবরত আক্রমণকারী উস্কানি দিতেই হবে। এত সত্ত্বেও, এত প্ররােচনা সত্ত্বেও ভারত সীমাবদ্ধ যুদ্ধের স্বার্থের কথা ভুলতে পারে না। আবার সর্বশক্তি নিয়ে সহসা ভারতের উপর সবদিক থেকে ঝাপিয়ে পড়ার পক্ষে এখনও পাকিস্তানের হয়তাে নানা ভাবনাচিন্তাও থাকতে পারে-বিশেষ করে রাষ্ট্রপুঞ্জ রাশিয়া চীন, আমেরিকা প্রভৃতি বৃহৎ শক্তিগুলির সম্ভাব্য ব্যবহার সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত। সে অবস্থায় এখন যে ধরনের সীমাবদ্ধ একটা যুদ্ধ লেগে গেছে, যার প্রধান অংশীদার বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী, পাকিস্তান ও ভারত সীমান্তের লড়াই, গেরিলা লড়াই, ভারতের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ এগুলিই ছােট বড় নানা আকারে অনবরত ফুটতে ফাটতে থাকবে। এর ঝামেলা কম নয়। এর আঘাত প্রত্যাঘাত এর ক্ষয়ক্ষতি ভারতীয়দের ভুগতে হবে, কিন্তু জনসাধারণকে সব। ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে না দিতে পারলে এবং এই সীমাবদ্ধ বা আংশিক যুদ্ধের সময়ে তাদের কার্যকলাপ ও ব্যবহার কী ধরনের হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে তাদের ওয়াকিবহাল না করে দিলে, তারা অযথা মরবে, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে। আর যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন, রাজ্য চালাচ্ছেন, যুদ্ধের প্রস্তুতি ও পরিচালনা করছেন, তাদেরও এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি, সীমা ও সীমাহীনতা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা-থাকা চাই। আমরা যেন কোন কনফিউশানে বা বিভ্রান্তিতে না ভুগি।
২৯ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা