রাজ্য ও রাজনীতি বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি পাকিস্তানকে সাহস জোগাচ্ছে।
— বরুণ সেনগুপ্ত
যে কোনও মুহূর্তে লড়াই শুরু হতে পারে, যে কোন মুহূর্তে গােলাগুলি বর্ষণ আরম্ভ হতে পারে বহুলােকের আজ তাই ধারণা। এই ধারণাটা ভুল না ঠিক, সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। তবে নানা জিনিস দেখে, নানা কথা শুনে এবং খবরের কাগজে দেশ বিদেশ থেকে আসা নানা খবর ও বিবৃতি পড়ে দেশের বহু লােকেরই ধারণা হয়েছে, যে কোন মুহূর্তে লড়াই শুরু হতে পারে। ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তে যে এখন প্রবল উত্তেজনা সে কথা শুধু ভারতবাসী কেন, বিশ্বের অনেকেই জানেন। দুপক্ষই জোর কদমে অসামরিক প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করছেন। দু দিকের সীমান্ত এলাকা থেকেই অসামরিক লােকজন সরে আসা শুরু হয়েছে। দু’দিকেই উত্তাপ বাড়ছে। দুপক্ষেরই সেনাবাহিনী সীমান্তে মুখােমুখি দাঁড়িয়ে। দুই রাষ্ট্রের নেতারাই দেশবাসীকে ‘কিছু কিছু বলছেন। | এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ যদি মনে করেন যে, যে-কোনও সময় লড়াই শুরু হয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা নিশ্চয়ই কোনও অন্যায় করছেন না। যুদ্ধ হােক আর নাই হােক, যুদ্ধাবস্থা এসে গিয়েছে। ভিতরে বা বাইরে আড়ালে কী ঘটছে না-ঘটছে সেটা যাদের জানার কোনও সুযােগ নেই, তাদের বাইরের পরিস্থিতি থেকেই অনুমান করতে হয়। যা শােনা যায়, বা দেখা যায় তা থেকেই তাদের আঁচ করতে হয় । এক্ষেত্রেও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তাই করছেন। উত্তাপ বাড়লেই বা সীমান্তে প্রস্তুতি রয়েছে বলেই যে যুদ্ধ হবেই তেমন কোনও কথা অবশ্য নেই। উত্তাপ থাকলে এবং অন্তত একপক্ষের প্রস্তুতি না থাকলে নিশ্চয় লড়াই হতে পারে না। উত্তাপ থাকলে প্রস্তুতি। চললে লড়াই হওয়ার ভয়ও থাকে। কিন্তু উত্তাপ থাকলেই যে লড়াই অবশ্যম্ভাবী তা অবশ্য নয়।
যেমন ধরুন এক্ষেত্রে। বাংলাদেশের ব্যাপারে সেই মারচ মাস থেকেই ভারত প্রচণ্ড উত্তাপ। বাংলাদেশের মানুষের উপর পাক সামরিক বাহিনীর অমানুষিক ও অভূতপূর্ব অত্যাচারের কাহিনী শুনে ভারতবাসী সেই মারচ মাস থেকেই প্রচণ্ড ভাবে উত্তেজিত। সেই অত্যাচারের ফলে প্রায় এক কোটি শরণার্থী চলে এসেছেন এপারে। তাদের সব দায়িত্বও নিতে হয়েছে ভারতকেই। এখনই দৈনিক প্রায় তিন কোটি টাকার খরচের বােঝা। ভারতের প্রতিরক্ষা বরাদ্দের প্রায় সমান সমান খরচা। এই অবস্থায় ভারতের বহুদল ও ব্যক্তি প্রকাশ্যে বলছেন, ভারত সরকারের উচিত বাংলাদেশ সরকাকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য দেওয়া এবং সেজন্য প্রয়ােজনে যুদ্ধেরও ঝুঁকি নেওয়া। কিন্তু তবু ভারত সরকার সে পথে যাননি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও বেশ কয়েক মাস আগই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাদের সাহায্য চাইব, তারপর আপনারা ভারতীয় সেনা বাহিনীকে মুক্তিফৌজের সাহায্যার্থে পাঠাবেন, তাহলে মুক্তিফৌজ দশ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে পাকবাহিনীকে বিতাড়িত করতে পারবে। ভারত সরকার সে পথটাকেও সঠিক বলে মনে করেন নি।
ভারত সরকার বরং রাজনৈতিক সমাধানের অর্থাৎ আপস-মীমাংসার পথে গিয়েছেন। সেজন্য বিশ্বজনমত গঠনের চেষ্টা করেছেন। দেশ বিদেশে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ-আলােচনা করেছেন। এবং যাতে তারা চাপ দিয়ে পাক সরকারকে একটা রাজনৈতিক সমাধানে বাধ্য করতে পারেন সেজন্য নানাভাবে তদবির তদারকি করেছেন ও করছেন। বুধবারও দিল্লিতে ভারত-যুগােশ্লাভ। যৌথ ইশতাহারে এই রাজনৈতিক সমাধান অর্থাৎ আপস-মীমাংসার উপরই দুই রাষ্ট্র প্রধান গুরুত্ব আরােপ করেছেন। এ ব্যাপারে অবশ্য ভারতের প্রচেষ্টা এখনও সামান্যও সফল হয়নি। বিভিন্ন রাষ্ট্র পাক সামরিক শাসনের উপর কোনও চাপ দিচ্ছেন কি দিচ্ছেন না বাইরে থেকে তা জানা মুসকিল। দিলেও কে কতটা দিচ্ছেন তাও বলা কঠিন। তবে বাহ্যত এটা দেখা যাচ্ছে যে পাক সামরিক শাসকরা একটুকুও টলেনি। পূর্ববাংলার মানুষকে রাইফেলের গুঁতােয় তাকে তাকে রাখার নীতি থেকে তারা এতটুকু সরে যায়নি। বাংলাদেশকে গায়ের জোরে, বন্দুকের জোরে নিজেদের দখলে রাখার পাকিস্তানী নীতি এখনও অটুট। সমস্ত প্রস্তুতি সেইভাবেই চলছে। তাহলে কি এই অবস্থা দেখে, অর্থাৎ পাকসামরিক শাসকরা কিছুতেই আপস মীমাংসায় রাজি হবে না এবং বৃহৎ শক্তিগুলিও এব্যাপারে তাদের উপর তেমন কোনও জোরদার চাপ দেবে না এই কথা মনে করেই ভারত সরকার তার নীতি কিছুটা পালটাচ্ছেন? না এও আসলে সেই পুরনাে পথই- শুধু কিছুটা কৌশল। পরিবর্তন, আপসমীমাংসাকে সম্ভব করে তােলার জন্য কিছুটা প্রকাশ্য প্রস্তুতি পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ যে বাংলাদেশ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে তাদের অবস্থা ক্রমশই কাহিল হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে তারা এখন বুঝতে পারছে যে সামরিকভাবে পূর্ব বাংলার দুচারটা ঘাটি আরও কয়েকমাস রাখা সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত ঢাকের দায়ে মনসাই বিক্রি হয়ে যাবে। অর্থাৎ পূর্ববাংলাকে দখলে রাখতে গিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে গােটা পাকিস্তানই ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা এও জানে, মুক্তিবাহিনীর ক্ষমতাও দিনকে দিন বাড়বে। তাই পাক সামরিক শাসকরা মরিয়া হয়ে ভারতের সঙ্গে একটা লড়াই বাধিয়ে দিতে পারে- এই আশায় যে ভারত-পাক সংঘর্ষ শুরু হলে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রগুলি এগিয়ে আসবেই এবং তখন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে “আন্তর্জাতিক বাহিনী” বসিয়ে মুক্তি বাহিনীকে নানা অসুবিধায় ফেলা যাবেই। এই রকম কোনও অনুমান করে পাকিস্তানের সমরনায়কদের পক্ষে হঠাৎ ভারত আক্রমণ করে বসা অসম্ভব নয়। বাংলাদেশ সমস্যার এই দিকটা মনে রেখেও ভারতের পক্ষে পুরােপুরি প্রস্তুত হয়ে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ।
কিন্তু এ পথে এগােতে হলেও পাকিস্তানের সমরনায়কদের আগাম বৃহৎ শক্তিগুলির মনােভাব জেনে নিতেই হবে। তারা যদি এটা বােঝে যে, তাদের এই অ্যাডভেনচার কোনও বৃহৎশক্তি সমর্থন করবে না, যদি বােঝে যে, এর ফলে বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীন হয়ে গেলে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিস্তৃত অঞ্চলে ভারতীয়। সেনাবাহিনী বসে গেলেও বৃহৎ শক্তিগুলি তাদের কোনােভাবেই সাহায্য করবে না, তাহলে নিশ্চয়ই পাকিস্তানী কর্তারা এতবড় ঝুঁকি নিতে পারে না। পাকিস্তানী কর্তারা এটা খুব ভালাে করে জানে যে, একা লড়াই করে। পাক-বাহিনী ভারতের সঙ্গে কিছুতেই পারবে না। | এই খানেই সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা আসছে, বৃহৎ শক্তিগুলি বাংলাদেশের ব্যাপারে কী মনােভাব নিচ্ছেন, পাকিস্তানের তথাকথিত অখণ্ডতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তারা পাক সামরিক বাহিনীকে কতটা সাহায্য করবেন? এই ব্যাপারটা মােটেই পরিষ্কার নয়। রাশিয়া, আমেরিকা, বৃটেন- সবাই বলছেন বাংলাদেশ নিয়ে ভারত-পাক সংঘর্ষ হওয়া উচিত নয়। সাবই বলছেন, বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান চাই। সবাই ঘােষণা করছেন, বাংলাদেশের শরণার্থীরা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন, তেমন একটা ব্যবস্থা করা। একান্ত আবশ্যক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কিছুই হচ্ছে না। অর্থাৎ ইয়াহিয়া খাঁ একচুলও নড়ছেন না। যদি সত্যিই বৃহৎ শক্তিগুলি বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চান, যদি সত্যিই তারা এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে চান যাতে শরণার্থীরা আবার দেশে ফিরে যেতে পারেন এবং যদি সত্যিই সেজন্য পাকিস্তানের উপর প্রকৃত চাপ দেন, তাহলে ইয়াহিয়া খার এমন কী শক্তি আছে যে সে সেই চাপকে অবজ্ঞা করেও বাংলাদেশে সামরিক অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারে? ইয়াহিয়া খাঁ নিজে বলেছে, ভারত লােকবল, সৈন্যবল এবং অস্ত্রবলে পাকিস্তানের চেয়ে পাঁচগুণ বড়। সেই পাঁচগুণ বড় রাষ্ট্রের ঘাড়ে এক কোটি শরনার্থীর বােঝা চাপিয়ে দিয়ে তাকে নাস্তানাবুদ করার সাহস পাকিস্তান পাচ্ছে কোথা থেকে? নিশ্চয়ই শুধু চীন এত শক্তি তাকে জোগাতে পারে না। পাকিস্তান নিশ্চয়ই। অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রের মনােভাবেও আশ্বস্ত। এই আশ্বাসটাই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে ভারত আক্রমণেও উৎসাহিত করতে পারে। বৃহরাষ্ট্রগুলির। মনােভাবের জন্যই পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করতে সাহস পেয়েছে ও পাচ্ছে। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির মনােভাব জেনেই পাকিস্তান বাংলদেশ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভারতের উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে।
২২ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা