পাক-ভারত সম্পর্ক কি যুদ্ধের দিকে
— পান্নালাল দাশগুপ্ত
বাংলাদেশ সমস্যা অনিবার্য কার্যকারণসূত্রে এখন পাক-ভারত যুদ্ধের আকার নিতে কি যাচ্ছে। দুই দেশেরই সীমান্ত বরাবর সামরিক প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের অনিচ্ছাসত্ত্বেও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, এজাতীয় সম্ভাবনার কথা কাগজেপত্রে লেখাও ভারত সরকার পছন্দ করতেন না। যুদ্ধ না করাই ভারতের নীতি-এটা আমরা সবাই মেনে নিলেও, যুদ্ধটা কখনই একমাত্র আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না। তাছাড়া আজকের দিনে শখ করে কেউ যুদ্ধে নামে না, বাধ্য হয়েই নামে। যুদ্ধ আমরা করবাে না বলে যদি সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতি না করি, বা ঢিলে-ঢালা শান্তিপ্রিয় সােয়ান্তিপ্রিয় মনােভাব নিয়ে বসে থাকি, তাতেই বরং প্রতিপক্ষ অতর্কিত আক্রমণে আমাদের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিতে লুব্ধ হতে পারে। | তাছাড়া যুদ্ধের প্রস্তুতি দেশের সামরিক বিভাগ যত গােপনেই করুন না কেন, একটা স্তরে নিয়ে। জনসাধারণকে বিশ্বাসের আওতায় আনতেই হবে, জনগণের মানসিক বল সৃষ্টি করতে হয়। বিশেষ করে যুদ্ধ ঘটে গেলে জনসাধারণের সক্রিয় সহযােগিতা ভিন্ন সার্থক যুদ্ধ পরিচালনা হতেই পারে না। কিন্তু এদেশে ভারত সরকার জনসাধারণকে সব কথা বােঝাতেও চান না, প্রয়ােজনীয় তথ্য পরিবেশনও করেন না। পাছে জনসাধারণের কাছে কোন কমিটমেন্ট হয়ে যায় তার জন্য জনসাধারণকে উৎসাহ দেওয়া হয় না কোন প্রকার। ব্যস্ত সহযােগিতার ব্যাপারে-সম্ভাব্য কোন যুদ্ধের ব্যাপারে। ভারত সরকার যুদ্ধ যাতে না করতে হয় এর জন্যই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে কোন কমিটমেন্টের মধ্যে যাননি। ব্যাপারটা যথাসম্ভব Open question, হিসেবেই’ ঝুলিয়ে রেখেছেন-ভারতীয় জনসাধারণের সুস্পষ্ট দাবি সত্ত্বেও।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেললে ভারতের কমিটমেন্ট দাঁড়িয়ে যায়, তাতে যুদ্ধ, হয়তাে অনিবার্য হয়ে ওঠে। পৃথিবীর অন্যান্য সব রাষ্ট্রও স্বীকৃতি দিয়ে নিজেদের বাঁধা পড়তে দেয়নি, তারাও একটা সুবিধাবাদী ভূমিকা পালন করে চলেছে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা যদি একা একা লড়তে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তবে বাংলাদেশ একটি lost cause হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়ে যাবে এই মনে করেই বাংলাদেশের প্রতি তাদের কর্তব্য পালন করেনি। শরণার্থীদের ভরণ-পােষণের জন্য-সাময়িকভাবে অবশ্য তাদের একটা কর্তব্য আছে মনে করে, কিন্তু শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশ সমস্যাকে তারা এক করে দেখে। অতএব, বাংলাদেশকে স্বাধীন ও স্বপ্রতিষ্ঠা করার কোন দায়িত্ব তারা নেয়নি। এমনকি পাকিস্তান পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশ নিয়ে একটিই দেশ এবং এই অখণ্ডতা বজায় রাখতে হবে-এমন যুক্তি থেকে সােভিয়েত রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, আমেরিকা কাউকেই এখনও পর্যন্ত নড়াতে পারা যায়নি। উপরন্তু ভারতের স্বর্ণ সিং মহাশয়ের মনােভাবও এই জাতীয়-অন্যরা তাঁরা বক্তৃতা সংশােধন করতে গেলেও স্বর্ণ সিং নিজে কিছুই সংশােধন করতে যাননি এবং স্বর্ণ সিং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী-কোন একজন সামান্য ব্যক্তি নন। উপরােক্ত চিন্তাচেতনা ও ভাবনার (ভারতেরটা সহ) পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পক্ষে সম্ভাব্য কোন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাবােধ থাকা স্বাভাবিক। ভারত এখনও কোন মনস্থির করে উঠতেই পারেনি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে-এর বেশি প্রত্যয়ের দৃঢ়তা তার নেই। You can hope for the best but be ready for the worst,-এই নীতির, শেষ অংশটুকু সম্বন্ধে ভারতীয় নেতৃত্ব এখনও সচেতন নয়। ভারতের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব যাদের হাতে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন না যুদ্ধ এড়াবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এটা বােঝা শক্ত। কাজে কাজেই “প্রস্তুতিটাও শেষপর্যন্ত অপ্রস্তুত করে ছাড়তে পারে আমাদের। পৃথিবীতে এমন অনেক হয়েছে। সেদিনও দেখা গেলাে চতুর ইসরাইল আরব শক্তিকে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে কেমন পরাস্ত করে দিল। দুর্ধর্ষ স্থিরপ্রতিজ্ঞ শত্রুপক্ষ অতর্কিত আক্রমণে আমাদেরও বেকুব বানিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সামরিক জুন্টার কোন নীতিজ্ঞান আছে, একথা কেউ বলবে? ভারতের প্রতি যুদ্ধের ন্যায়নীতি পালন করবে পাকিস্তান? নিজের প্রজা পূর্ববঙ্গের লােকদের উপর যারা গােপন প্রস্তুতি করে অতর্কিতে রাত্রির অন্ধকারে সকল মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে, সে ভারতের উপর নােটিশ দিয়ে, সময় দিয়ে, যুদ্ধ ঘােষণা করবে, এমন কথা পাগলেও ভাবতে পারে না। তাছাড়া জাপান গত মহাযুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধে নেমেছিল? অতর্কিত আক্রমণে পার্লহারবার চুরমার করে দেবার পর যথারীতি যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল। এসব কথা কি আমাদের রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক নেতাদের মনে পড়ে না?
লােটাস-ইটারদের মতাে শাস্তিনেশাগ্রস্ত নেতারা যদি হিসেব করতে বসেন, তবে অবশ্যই নানা হিসেব করে দেখাতে পারেন যে, পাকিস্তানের পক্ষে গায়ে পড়ে যুদ্ধে নামা সম্ভব নয়, যথা-১৯৬৫ সালের তুলনায় পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ যেমন বর্তমানে তাকে নিজেরই বিরুদ্ধে (পূর্ববঙ্গে) এক ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি অনেক হয়ে গেছে, তার সৈন্যবলের অনেকটাই যুদ্ধক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তার ব্যবসাবাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দেশে দেশে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় সমর্থন আজ তার নেই বললেই চলে। চীনও বেশি কিছু বলছে না, এবারে তার পক্ষে সখ করে যুদ্ধে নামা পাগল না হলে সম্ভব নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া পাকিস্তান তার সামরিক অস্ত্র শস্ত্রের সামান্যই নিজেদের দেশে তৈরী করতে পারে, সবাই তার আমদানি করা, অথচ ভারতের সামরিক সম্ভার তৈরির ক্ষেত্রে-ভারত প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতার শতকরা ৮০ ভাগ প্রয়ােজন দেশের শিল্পই করে থাকে—অতএব পাকিস্তান কোন সাহসে ভারতের সঙ্গে লড়তে আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলি খুব ভাল কথা, ভাল যুক্তি, কিন্তু আজ যারা পাকিস্তানী সরকারের অধিনায়ক–তারা তাে অত যুক্তিবাদীতা-ও হতে পারে, তারা তাে পাগলও হতে পারে। তারা জানে এভাবে চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ধরে রাখা যাবে না, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেও বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। যদি ওদের যেতেই হয়, তবে একটা Riksy gamble-এ নামবেই বা না কেন, বিদায়। নেবার আগে একবার শেষ চেষ্টা করেই বা দেখবে না কেন? পাগলামির একটা ভূমিকা আছে পৃথিবীতে, নইলে হিটলার-জাতীয় লােকদের কোন ভূমিকাই থাকতাে না ইতিহাসে। মুক্তিফৌজের হাতে পরাজিত হবার চেয়ে-শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামে যা হতে বাধ্য-ভারতের হাতে পরাজিত হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক, কেননা পাকিস্তান তাতে “শহীদ” হতে পারে দুনিয়ার চোখে, বিশেষ করে মুসলিম জগতের কাছে—এই বলে যে, একটা “হিন্দু রাষ্ট্রের অত্যাচারে তারা হেরে গেলাে। অন্তত যুদ্ধে হারলেও প্রচারের দিক থেকে হারবে না তাতে। তাছাড়া যুদ্ধ বেধে গেলে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও সিকিউরিটি কৌন্সিল হা হা করে এসে সীজ-ফায়ার করে দেবে, অতএব সীজ করার বা যুদ্ধবিরতির সীমারেখা যাতে পাকিস্তানের অনুকূলে হয় তার জন্য পারলে পাকিস্তান অতর্কিত প্রথম আক্রমণেই ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষের উপর এসে পড়তে পারে।
তারপর যা ছিল “বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান সমস্যা, তাই দাঁড়িয়ে যাবে “ভারত বনাম পাকিস্তান” সমস্যায় এবং হয়ে দাড়াবে একটা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চালচক্রের ক্রীড়াভূমি। জেতা ও হারা ছাড়াও আরও একজাতীয় অবস্থা আছে যুদ্ধের-যাকে না-হারা না-জেতা একটা অচলাবস্থা বা Stalemate বলা চলে, যা হয়েছিল কাশ্মীর যুদ্ধের বিরতির বেলায়, যা হয়েছিল তাসখন্দ চুক্তির ফলে। তাতে পাকিস্তানের বিশেষ কিছু অসুবিধা হয়নি, বরং তার নিজের দেশবাসীকেই বােঝাতে সক্ষম হয়েছে যে যুদ্ধে পাকিস্তানই আসলে জিতেছে, যদি তারা হয়তাে সত্যিই জেতেনি। যাই হােক-পাকিস্তান। হয়তাে নিজের দেশের মধ্যে বিপ্লব এড়াবার জন্যও হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়তে পারে ভারতের উপর, তার আভ্যন্তরীণ সমস্যাকে একটা পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার করে আন্তর্জাতিক কূটনীতির পক্ষপুটে আশ্রয় নিতে পারে এবং এটা সম্পূর্ণ পাগলামি চিন্তা নাও হতে পারে, এই Risk-টা Reasonable হতেও পারে। এবার দেখা যাক পাকিস্তানের হাতে কী পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যবল আছে এবং তা দিয়ে এজাতীয় ঝুঁকি নেওয়ার মতাে সর্বনিম্ন শক্তি আছে কিনা। Institute for Defence Studies and Analysis বলে ভারত সরকারেরই একটা সংস্থা আছে। তার Director Mr. K. Karunakaran, I.A.S.-এর হিসেব-মতাে পাকিস্তানের হাতে নিম্নলিখিত অস্ত্র ও সৈন্যবল আছে : সর্বমােট সশস্ত্র লােকবল-৩,৯৭,০০০ সৈন্য বা আর্মি – ৩,৭০,০০০ প্রতিরক্ষা বরাদ্দ (১৯৭০-৭১) ৩৪০ কোটি পাকিস্তানী টাকা ২টি আর্মার্ড ডিসিন ১টি ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মার্ড ব্রিগেড ১২টি ইনফেন্ট্রি ডিভিসন (আরও ২টি ডিভিসন তৈরি হচ্ছে) ১টি এয়ারফোর্স ব্রিগেড ৩৭০-৪০০ M/47748 প্যাটন ট্যাঙ্ক-আমেরিকা থেকে। ২০০ T/59 ট্যাঙ্ক-চীন থেকে। ২৫০টি T/54/55 ট্যাঙ্ক-সােভিয়েত থেকে। ২০০টি M-24 ও ৭৫টি M-41 ট্যাঙ্ক আমেরিকা থেকে। ৩০টি PT/76 হাল্কা ট্যাঙ্ক- সােভিয়েত থেকে। ৩০০টি M-13 আর্মার্ড পার্সোন্যাল ক্যারিয়ার-আমেরিকা থেকে । ৯০০টি 25-Pourder Guns (গত যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ সম্ভার থেকে। ১০৫ মিমি ও ১৫৫ মিমি হাউইটজার কামান-আমেরিকা থেকে। ২০০টি ১৩০ মিমি কামান-সােভিয়েত থেকে। “কোবরা’ অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল-পশ্চিম জার্মানির তৈরি।
নৌবহর নৌসেনা ১০,০০০ ৪টি সাবমেরিন (ফ্রান্স থেকে পাওয়া ৩টি Daphne class ও আমেরিকা থেকে পাওয়া একটি)। ১টি ডিপাে শিপ (ফ্রান্স থেকে)। ১টি লাইট কুইজার/ট্রেনিং শিপ, ২টি ডেসট্রয়ার ৩টি ডেস্ট্রয়ার এসকর্ট ২টি দ্রুতগামী ফ্রিগেট ৪টি পেট্রল বােট। ২টি উপকূলগামী মাইন সুইপার ২টি পেট্রল বােট (১০০ টনের নীচে) ২০/২৫টি নাগাদ মিডগেট সাবমেরিন (ইতালীয়)। বিমানবহর বিমানবহরের লােকশক্তি-১৭,০০০ কমবেট এয়ার ক্রাফট-২৭০ ১টি হাল্কা বম্বার স্কোয়াড্রন II,28 চীন থেকে। ২টি হাল্কা বম্বার স্কোয়াড্রন B-57B আমেরিকা থেকে ১টি হাল্কা স্কোয়াড্রন “মিরাজ III E”-ফ্রান্স থেকে। আরও ২টি মিরাজ স্কোয়াড্রন ১৯৭০-৭১ সালের মধ্যেই ফ্রান্স থেকে পাবার চুক্তি বর্তমান। ৬টি স্যাবার জেট ফাইটার স্কোয়াড্রন-আমেরিকা ও পশ্চিম জার্মানি থেকে। ৬টি ইন্টারসেপ্টার/ফাইটার বম্বার স্কোয়াড্রন-M-14–19s, চীন থেকে। ১টি ইন্টারসেপ্টার স্কোয়াড্রন F 104 A টাইপ-আমেরিকা থেকে। এছাড়া আমেরিকা থেকে C-130 ট্রানসপাের্ট বিমান ও হ্যালিকপটার পেয়েছে অনেক সােভিয়েত ও ফ্রান্স থেকেও। আধাসামরিক বা প্যারামিলিটারী ফোর্স ২,৫০,০০০ মিলিসিয়া ২৫, ০০০ ফ্রন্টিয়ার কোর। ২০,০০০ ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস দেশবিদেশে বিভিন্ন প্রকাশিত সরকারী সূত্র থেকে এ হিসেব নেওয়া। এছাড়া গােপনে কিছু কিছু সম্ভার সংগ্রহ হয়ে থাকবে। অন্যান্য সব দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্রপাতি সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে বটে কিন্তু আমেরিকা তা এখনও বন্ধ করেনি এবং চীন কী দিচ্ছে না দিচ্ছে তার কোন হিসেব এখন পাওয়া সম্ভব নয়। . উপরােক্ত হিসেব থেকে বােঝা যায় যে পাকিস্তানের নৌবহরের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড দূর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তার স্থলবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ করার ক্ষমতা আছে। আক্রমণই আত্মরক্ষার প্রধান উপায়-বিশেষ করে পাকিস্তানের বর্তমান বেপরােয়া পরিস্থিতিতে এমন হিসেব করে ভারতের পক্ষে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত প্রস্তুত করে ফেলাই উচিত। আন্তর্জাতিক চাপ পাকিস্তানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করিয়ে দেবে এমন ভরসা কোথাও নেই বলা চলে। তাছাড়া যতদিন যাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও বিদ্রোহ ঘনিয়ে উঠবে। ইয়াহিয়াচক্রকে এই মুহূর্তে যদি ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে পাকিস্তানের লােকেরা তবেই ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার গ্যাম্বল থেকে পাকিস্তানকে হয়তাে রক্ষা করতে পারে।
কিন্তু শেষ চেষ্টা না করে সামরিক গােষ্ঠী রাজনীতি থেকে বিদায় নেবে, একথা বিশ্বাস্য নয়। চীনের পক্ষে সম্ভাব্য কোন হস্তক্ষেপ ছাড়া পূর্ববাংলাকে-কোন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে-পাকিস্তানের পক্ষে রক্ষা করা অসম্ভব। আজ পাকিস্তানী সাম্রাজ্যের (!) দুর্বলতম অংশ হলাে বিদ্রোহী ও বহুদূরস্থিত বাংলাদেশ। পাকিস্তানের পক্ষে তার এখানে কোন পশ্চাৎভূমি নেই। সহসা অতর্কিত আক্রমণে পূর্ব-ভারতকে (আসাম ইত্যাদি) পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় মেল্যান্ডের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবার লােভ হয়তাে পাকিস্তানীদের হতে পারে-কিন্তু সে চেষ্টা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ও মূল্যহীন হতে বাধ্য। ততক্ষণে মুক্তিবাহিনীর হাতে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে যাওয়া উচিত। পশ্চিম অঞ্চলেই যুদ্ধ হবে-যদি সত্যিই যুদ্ধ হয়-সেখানেও এবার তাসখন্দচুক্তির কোন দ্বিতীয় সংস্করণ হতে দেওয়া উচিত নয়। সর্বোপরি, এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর বৃহৎশক্তিগুলি আগামী কয়েকদিন বা সপ্তাহের মধ্যেই খুব উঠে পড়ে লাগতে পারে-কিন্তু কোন প্রকার “মিউনিকচুক্তি” যেন বাংলাদেশকে নিয়ে না হতে পারে এটা দেখা দরকার। যে শক্তি বলে একদা হিটলার।মিউনিচুক্তি বা আত্মসমর্পণ ঘটাতে পেরেছিল সে শক্তি অবশ্য ইয়াহিয়াদের নেই কিন্তু ভারতে বন্ধুদের চাপটা কম নয়-মুরুব্বি ও বন্ধু সম্বন্ধে আজকাল যতটা সাবধান থাকা দরকার-শত্রুদের সম্বন্ধেও অতটা সাবধানতার দরকার করে না, একমাত্র সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকা ছাড়া।
২০ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা