You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দ্বিতীয় পর্যায়

–চণ্ডিকাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

গত ছয় মাস ধরে ইয়াহিয়া খার পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চলছে। কবে যে এই সংগ্রাম শেষ হবে, তা এখনও অনিশ্চয়তার গর্ভে নিহিত। এটা যেমন ঠিক তেমিন ঠিক যে, এই সংগ্রাম সফল হবেই এবং তা ইতিহাসের অমােঘ বিধানে। | খুবই আশার কথা যে, গত ছয় মাসে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির মনােভাবে বেশ খানিকটা পরিবর্তন ঘটেছে। যদিও কেউই পূর্ব বাংলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের পক্ষে রায় দেয়নি, তবু বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি আজ পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আগত উদ্বাস্তু সমস্যা সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছে এবং বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করছে। সবগুলি রাষ্ট্রই শেখ মুজিবর রহমানের বিচার প্রহসন স্থগিত রাখবার। অনুরােধ জানিয়েছে এবং সে অনুরােধ কার্যকরী হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিছক ভারত-পাকিস্তানের বিরােধের সমস্যা বলে তুলে ধরার। পাকিস্তানী অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রাথমিক নিশ্চেষ্টতা ত্যাগ করে রাষ্ট্রসংঘ ও তার মহাসচিব বাংলাদেশ সমস্যা সম্বন্ধে আজ অবহিত, এমন কি, যে চীন প্রথম দিকে ইয়াহিয়া খার পৃষ্টপােষকতা করছিল, সেও আজ নীরব। চীনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির যে পরিবর্তন প্রবণতা আজ লক্ষণীয়, তা যখন চূড়ান্ত রূপ নেবে,তখন চীন তার পূর্বেকার দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করতে পারে, এ সম্ভাবনাকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়।  বৃহৎ এবং মাঝারি রকমের রাষ্ট্রগুলির বহু গণ্যমান্য অধিবাসী ও সংসদসদস্য উদ্বাস্তু শিবিরগুলি পরিদর্শন করছেন এবং এই সমস্যা যে আন্তর্জাতিক সমস্যার রূপ ধারণ করেছে, এ বিষয়ে তারা সুস্পষ্ট অভিমত জ্ঞাপন করছেন। এক আমেরিকা ছাড়া সকল রাষ্ট্রই পাকিস্তানকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্যদানের রীতি পরিহার করছে, এটিও কম উল্লেখযােগ্য নয়। এমন কি, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি ও আজ বাংলাদেশ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামের অক্লান্ত একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে ভারতবর্ষের ভূমিকা, উদারতা মানবহিতৈষণা এবং গতিশীলতার এক অপূর্ব সমাবেশ। একথা ঠিক ভারতবর্ষ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি বা তার সাহায্যে অস্ত্রধারণ করেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সমস্যা যে আজ আন্তর্জাতিক সমস্যায় উন্নীত হয়েছে এবং বিশ্ববিবেক যে এই বিষয়ে সমধিক পরিমাণে জাগ্রত হয়েছে, তা বারত সরকারের নিরলস প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে দৌত্য প্রেরণের দ্বারা এবং অহর্নিশ। সক্রিয় প্রচারের মাধ্যমে ভারতই আজ বিশ্বমাঝে দিয়েছে তারে ছড়ায়ে’। সম্প্রতি সম্পাদিত ভারতসােভিয়েত চুক্তির দ্বারা ভারতবর্ষ শুধু পাকিস্তানী যুদ্ধবাজদের হুমকিরই কণ্ঠরােধ করেনি, এর দ্বারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিরাপত্তার বিধানও করেছে। নব্বই লক্ষ পূর্ব বাংলার শরণার্থীকে আশ্রয়। দিয়ে ভারতবর্ষ তাদের ইয়াহিয়া খান সৈন্যদের করাল কবল থেকে রক্ষা করেছে এবং তাদের আহার, বাসস্থান। ও চিকিৎসার জন্য কোটি কোটি অর্থ জলের মত ব্যয় করে আন্তর্জাতিক মানবিকতার ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব। নজির স্থাপন করেছে। এই প্রসঙ্গে একথাও স্মরণীয় যে, ভারত সরকারের এই অভূতপূর্ব শরণার্থী সমস্যার মােকাবিলা করার পেছনে রয়েছে কোটি কোটি ভারতবাসীর প্রগতিনিষ্ঠা ও স্বাধীনতাপ্রীতি।  প্রতিবেশী রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীর অবস্থিতি ও প্রতিদিন হাজার হাজার বাস্তুহারার সীমান্ত অতিক্রমণ। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক কাঠামাে ও তার সমাজবিন্যাসের ওপর যে ক্রমবর্ধমান চাপের সৃষ্টি করেছে, তার ফলে এ দেশের প্রশাসন ও সমাজ ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েনি তা ভারত রাষ্ট্রের প্রাণসারতা ও স্থিতিশীলতার সম্যক পরিচয় বহন করছে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে এ পর্যন্ত যা সাহায্য পাওয়া গেছে, তার পরিমাণ এগারাে কোটি চল্লিশ লক্ষ ডলার, প্রয়ােজনের তুলনায় এই সাহায্য নগণ্য।

বাংলাদেশ সমস্যার তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিজস্ব শক্তি। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় এ প্রশ্ন জেগেছিল যে, আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রণদুর্মদ পাকিস্তানী । সৈন্যবাহিনীকে বাঙালী মুক্তি সংগ্রামীরা কতদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? ইতিহাসের স্বাধীনতা সংগ্রাম গুলির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, সেগুলির সাফল্যের পেছনে মুক্তিকামী জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং অনুকূল বিদেশী রাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন বা সাহায্য পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। যৌথভাবে বা এককভাবে বিদেশী রাষ্ট্রের সাহায্য না পেলে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম বা গ্রীক স্বাধীনতা সংগ্রাম রক্তসিক্ত বিফল বিদ্রোহে পরিণত হত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল, সেখানকার মুক্তিবাহিনী কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সক্রিয় সাহায্য না নিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক সন্ত্রাসরাজের বিরুদ্ধে সিংহবিক্রমে লড়াই করে চলেছে। পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে প্রথম দিকে পর্যদস্তু হওয়ার পর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী বিগত মে মাস থেকে গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি গ্রহণ করে এই কয় মাসে। অভূতপুর্ব সাফল্য লাভ করেছে।  এই গেরিলা নীতির অনুসরণ করেই চীনের কম্যুনিস্টরা চিয়াং কাইশেকের সুবৃহৎ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছিল এবং এই নীতিই রূপায়িত হয়েছে ভিয়েতনামের রণক্ষেত্রে। তবে আজ বাংলাদেশের শ্যামল প্রান্তরে এবং সেখানকার অজস্র নদীনালায় এই গেরিলা যুদ্ধের অবতারণা করে সেখানকার মুক্তি বাহিনী পঁচিশ হাজারের ওপর পাক সৈন্যকে নিশ্চিহ্ন করেছে। শােনা যাচ্ছে শিগগিরই, তারা নৌ ও বিমান সংগ্রহ করে। আরও দুর্ধর্ষ হয়ে উঠবে। খাদ্যবাহী বিদেশী জাহাজগুলির ওপর আক্রমণ এবং টাইম বােমার আঘাতে ঢাকার এক নব নিযুক্ত মন্ত্রীর আহত হওয়ার ঘটনা মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক কর্মসূচীরই দ্যোতক। 

বাংলাদেশে যে লােকায়ত্ত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁরা স্থির করেছেন যে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের চলতি অধিবেশনে তারা তাদের বক্তব্য পেশ করবেন। ইতিমধ্যেই নিউইয়র্কে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল পৌছে গেছেন এবং তাদের নেতৃত্ব করছেন আবু সাঈদ চৌধুরী । মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানী এক সাম্প্রতিক বেতার ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ন্যায় ও সত্যরক্ষার সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল অধিবাসীকে শত্রুসেনা আক্রমণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গত ছয় মাসে বাংলাদেশের পটভূমিকা মুক্তিবাহিনীর সাফল্য আলােকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এবং বাংলাদেশ সমস্যা বিশ্বরাজনীতর পর্যায়ভুক্ত হয়েছে। এগুলি নিশ্চয়ই আশা ও আশ্বাসের কথা, কিন্তু কোন রাষ্ট্রই পুর্ব বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতার সম্ভাব্যতা বা প্রয়ােজনীয়তার উল্লেখমাত্র করেনি। যারা রাজনৈতিক সমাধানের সুপারিশ করছেন, তারা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কথাই ভাবছেন। এটা। লক্ষ্য করবার বিষয় যে, বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি ও রাষ্ট্রসঙ্ঘ শরণার্থী সমস্যার ওপরই সমাধিক জোর দিচ্ছে, যদিও পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী এবং সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভারতবর্ষ আশ্রয়গ্রহণকে অনেকেই মানব-ইতিহাসের এক চরমতম ট্র্যাজেডি বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর জন্য কেউই (সােভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া) সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করেননি, নিন্দা করাতাে দূরের কথা। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গােয়া অধিকার করার জন্য একদা নেহেরু সরকারের সমালােচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল, সে এখন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দানবীয় দস্যুতা সম্বন্ধে একেবারে নীরব। মুসলিম রাষ্ট্রগুলির মনােভাব বিশেষ করে নৈরাশ্যব্যঞ্জক। মিশর, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, ইরাক এমনকি আফগানিস্থানও এ পর্যন্ত একটি বারও পাকিস্তানের সমালােচনা করেনি, লক্ষ লক্ষ নিরীহ, নিরস্ত্র আবাল বৃদ্ধবণিতার গণহত্যা, ব্যাপক গৃহদাহ, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন- এতগুলি জঘন্য অপরাধ সংগঠিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের জন্য কণামাত্র সহানুভুতি ও এদের মনােভাবে প্রকাশিত হয়নি। এদের কাছে বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং এদের কাছে পাকিস্তানের ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়ােজনই সর্বাধিক। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতবর্ষের পররাষ্ট্র সচিব যখন রাষ্ট্রসঙ্রে সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ সমস্যার সমস্যার উত্থাপন করেছিলেন, তখন পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগাশাহী বার বার বাধা দিয়েছেন এবং সৌদি আরবের প্রতিনিধি জামিল বারুদী তার সমর্থনে সােচ্চার হয়ে উঠেছিলেন।

আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত প্যারিসের ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের অধিবেশনে প্রাণপণ চেষ্টা করেও ভারতবর্ষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আনীত প্রস্তাবটির প্রয়ােজনীয় সমর্থন লাভ করতে পারেনি। এক কথায় বলা যেতে পারে, পাকিস্তান তার নির্লজ্জ ও নৃশংস ভূমিকার জন্য কোন তিরস্কার বা সমালােচনার সম্মুখীন হয়নি। উপরন্তু সে বেপরােয়াভাবে তার ধর্মান্ধ ভারতবিরােধী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী বা ভারতীয় এজেন্ট বলে অভিহিত করে চলেছে দিনের পর দিন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের চলতি অধিবেশনে বাংলাদেশ দল যদি তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপিত করবার সুযােগ পায় এবং রাষ্ট্রসঘ যদি সে বক্তব্য গ্রহণ করে তবে হয়ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত রাষ্ট্রসঙ্ কি পাকিস্তানকে সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং মুজিবর রহমানকে কারামুক্ত করে অবিলম্বে আলাপ-আলােচনা শুরু করবার জন্য প্রয়ােজনীয় চাপ সৃষ্টি করবে এবং পাকিস্তান সেই চাপ মেনে নেবে?  আমরা এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তির তিনটি পথ দেখতে পাচ্ছি। প্রথম রাষ্ট্রসঙ্রে সক্রিয় ও কার্যকরী হস্তক্ষেপ, দ্বিতীয়, শক্তিশালী বিদেশী রাষ্ট্রের যৌথ বা একক সশস্ত্র হস্তক্ষেপ। এবং তৃতীয় একটানা সুদীৰ্ণ স্বাধীনতা সংগ্রাম, যতদিন পর্যন্ত শেষ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত না হয়।  অপরপক্ষে যদি বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি নিস্ফল রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। এবং যদি পাকিস্তান সুদৃঢ়ভাবে পুনরায় তার ঔপনিবেশিক আধিপত্র বাংলাদেশের ওপর কায়েম করে নেয়, তবে তা হবে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসীর পক্ষে চরম সর্বনাশ, ভারতবর্ষের পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে অভাবনীয় বিপর্যয় এবং বিশ্বমানবতার পক্ষে দুরপনেয় কলঙ্ক।

৪ অক্টোবর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!