ভারত ও বাংলাদেশ
–অজিত শাসমল
বাংলাদেশের বর্তমান ভাগ্য ভারতের সঙ্গে একসূত্রে জড়িয়ে গেছে, অস্বীকার করা যাবে না। এবং সম্ভবত ভারতের ভবিষ্যৎও খানিকটা বাংলাদেশ সমস্যার সঙ্গে জড়িত। শুধু এ কারণে নয় যে, পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলে ভারতের পক্ষে সুবিধা এবং অবিচ্ছিন্ন থাকলে অসুবিধে। বরং এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ নিয়ে ক্ষমতার যে লড়াই ও ভেলকি চলছে, বাংলাদেশের পরাজয়ে সেক্ষেত্রে ভারতের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তিও বিপন্ন হবে। অপর দিকে পাকিস্তান পরাজিত হলে ঘরে এবং বাইরে যথেষ্ট শক্তি ও মর্যাদা লাভ করা ভারতের পক্ষে খুবই সহজ হবে। বস্তুত স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারতের জাতীয় জীবনের এর থেকে বড় সুযােগ বােধ হয় আর আসেনি। ভারত কতখানি লাভবান হবে, সেটা নির্ভর করবে এই সুযােগকে ভারত কতখানি সুবিবেচনা ও সৎসাহসের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারবে, তার ওপর। এযাবৎ ভারত যথেষ্ট সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছে, সন্দেহ নেই। নানা দেশের কাছে ভারতের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সমস্যাটি তুলে ধরেছেন। ফলে যে-সব দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলাে না অথবা প্রতিকূল ধারণা ছিলাে, তখন দেশ ও এখন বাংলাদেশ সমস্যা বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলনে, প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পারলামেনটারি সম্মেলনে এবং পরিশেষে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ প্রশ্ন পাকিস্তানের ঘাের বিরােধিতা সত্ত্বেও উত্থাপিত হয়েছে। অনেক দেশই সত্য কথাটি বলতে চেয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়ার ভূমিকা আগের থেকে এখন অনেক বেশি স্পষ্ট। তবে পুরােপুরি স্পষ্ট নয়। ভারতসােভিয়েত সহযােগিতা চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার ভূমিকা আর একটু স্পষ্ট হবে, এমন আশা করা গিয়েছিলাে।
ইন্দিরাঞ্জীর মসকো সফরের শেষে যে ইস্তেহার প্রকাশ করা হয়েছে, সে পড়ে তাে অনেকের মনে রীতিমতাে সংশয় ও হতাশা দেখা দিয়েছে। বিরােধী দলীয় যারা বাংলাদেশ সমস্যাকে মূলধন করে লাভবান হতে চান, তারা তাে ইতিমধ্যেই সরকারী নীতির সমালােচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন, কিন্তু বর্তমান লেখক শুধু বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগের অংশীদার। ভারত-সােভিয়েত যুক্ত ইস্তাহারে পূর্ব বাংলার (নাকি পূর্ব-পাকিস্তানের?) বর্তমান সমস্যার আশু। রাজনৈতিক সমাধান চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে শরণার্থীরা যাতে সম্মানে এবং নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন, তেমন অনুকূল পরিবেশ গড়ে তােলার আহ্বান জানানাে হয়েছে। এসবই ভাগ্যবিড়ম্বিত বাঙালীদের পক্ষে ভালাে কথা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এসব কি সম্ভব? অর্থাৎ বাস্তববাচিত কথা। কেউ কখনাে মিষ্টি কথাতে লাভের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়?- ইতিহাস তাে তেমন প্রমাণ দেয় না। তা হলে ইয়াহিয়া সাহেব হঠাৎ ভালােমানুষের মতাে পূর্ব বাংলা থেকে সরে যাবেন, এটা কী করে আশা করি? অথচ পশ্চিমী সৈন্যরা পূর্ব বাংলা থেকে সরে না গেলে শরণার্থীরা নির্ভয়ে ফিরে যাবেন, তা-ই বা কী করে আশা করি! বরং আমার তাে। মনে হয়, শরণার্থীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকবে। সে কথায় পরে আসছি। আগে দেখা যাক, কোনাে রাজনৈতিক সমাধান আদৌ সম্ভব কিনা।
অন্তত সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে দেখলে বলতে হয়, রাজনৈতিক সমাধান অসম্ভব। বাংলাদেশ সরকার আলােচনার যে চারটি পূর্ব শর্ত দিয়েছেন- (১) শেখ সাহেবের মুক্তি, (২) পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের অপসারণ, (৩) বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং (৪) ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দান-সেগুলাে কি ইয়াহিয়া খানের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? সামরিক জান্টা না-হয় শেখ সাহেবকে ছেড়ে দিলাে কিন্তু সৈন্যদের সরাবে কোন্ মুখে- স্বাধীনতার দাবি স্বীকার করে নেওয়া দূরের কথা। জঙ্গী সরকার সর্বোচ্চ যা দিতে পারে বলে আমাদের ধারণা, তা হলাে (১) শেখ সাহেবের মুক্তি ও (২) দু-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র নিয়ে এখন বাংলাদেশের জনগণ খুশি হবেন, এমন মনে হয় না, কেননা এ দাবি তারা পাকিস্তানের সংবিধান সভাতে বসে বিনা রক্তপাতে আদায় করতে পারতেন। কমপক্ষে দশ লাখ লােকের মৃত্যুর পর এবং আপামর সকল মানুষের পাকিস্তান বিরােধী সংগ্রামের পর-কী করে এক পাকিস্তানের মধ্যে দু-দফা নিয়ে বাঙালীদের পক্ষে বাস করা সম্ভব, আমার জানা নেই। তদুপরি ইয়াহিয়া বা এখন দু-দফা মেনে নেবেন কোন্ মুখে তা হলে এই অভূতপূর্ব গণহত্যার কী কৈফিয়ত দেবেন তিনি অথবা তার দোসরগণ। প্রকৃত সতটি উচ্চারণ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান অসংখ্য লাশের নীচে সমাধিস্থ হয়েছে। ভারত নিশ্চয় সেই কবর খুঁড়ে সেই শায়িত পাকিস্তানকে উদ্ধার করতে চায় না। কিন্তু, সন্দেহ হয়, এখনাে রাশিয়া শ্যাম ও কূল দুই-ই রক্ষা করতে চায়। অন্তত পূর্বোক্ত যুক্ত বিবৃতি থেকে তাই মনে হয়। বাংলাদেশ সরকার রীতিমতাে গুরুত্বের সঙ্গে এই ইস্তাহারের পর্যালােচনা করেছেন এবং তারপরে ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়াকে মিত্র হিসাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, পূর্ণ স্বাধীনতা লাভই তাদের। উদ্দেশ্য। শরণার্থীরা নির্ভয়ে নিরাপদে সসম্মানে ফিরে যেতে পারবে কেবলমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশে। | বাস্তবিক পক্ষে মুক্তিসংগ্রাম বর্তমান এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, সেখান থেকে ফেরার কোন পথ নেই। ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিসেনাদের সংখ্যা ও তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা যথেষ্ট বুদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এখন তারা কয়েক হাজার ঘাটি নির্মাণ করেছেন। গ্রাম-এলাকা অনেকাংশে বস্তুত খান সেনমুক্ত। ব্যক্তিগতভাবে জানি, বর্ষাকালে খানসেনারা মুক্তিবাহিনীর হাতে বহুস্থানে প্রচণ্ড মার খেয়েছে।
পাল্টা আক্রমণ করে পুনর্বার মার খেয়েছে। আবার বহু জায়গায় অনুকূল অবস্থা পেয়ে পাক সেনারা আগের মত বর্বর অত্যাচার করেছে। বর্ষার শেষে পথঘাট শুকিয়ে গেলে পাকিস্তানীদের পক্ষে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করা এবং নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার করা অসম্ভব নয়। করতে গিয়ে তারা নিশ্চয় আমাদের বীর মুক্তিসেনাদের হাতে মার খাবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট কতটা কমবে, বলা শক্ত। এবং তেমন অবস্থায় প্রতিদিন নতুন করে শরণার্থীদের আগমন অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান খাদ্যাভাবেও শরণার্থীদের চাপ হয়তাে বৃদ্ধি পাবে। এখনই ভারতে নব্বই লাখের বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন। ডিসেম্বর নাগাদ যদি এ সংখ্যা সওয়া কোটিতে দাঁড়ায়, তবে বিস্মিত হবাে না। [ এ বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপে ভারতের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। এমন কি, ক্রমবর্ধমান। হতাশার মুখে এমন বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে, যা এখন পর্যন্ত ভাবা যাচ্ছে সেই দুঃসময়ের কথা ভেবে এখন থেকেই বাংলাদেশ সমস্যার এমন মীমাংসার কথা চিন্তা করা উচিত, যা সকলের পক্ষে গ্রহণযােগ্য হবে। তা না হলে ভিটে মাটি ছাড়া এতগুলাে মানুষ এবং ভারত উভয়কেই ভাগ্য হয়তাে বঞ্চনা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী বেঁচে যান, সাড়ে চুয়ান্নো কোটি ভারতীয়ও কম লাভবান হন না।
৪ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা