রাজধানী রাজনীতি পাকিস্তানের জন্য মার্কিনি চীনাবাদাম
–খগেন দে সরকার
আমেরিকার ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের এক প্রথম সারির নেতা সেনেটর পারসি। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের প্রতি তার সহানুভূতি অকৃত্রিম। তিনি বাংলাদেশ সমস্যার রাজনীতিক সমাধানের পক্ষপাতী; তিনি চান লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হােক। | সেই সেনেটর পারসি সুদূর আমেরিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরায় এসেছিলেন একটা “চিনাবাদামের খােজে। কিন্তু কত বড় সেই চিনাবাদাম? নেকড়ের মত? রক্ত খেকো বাঘের মত? নাকি তার চেয়েও বড় ইয়াহিয়া খানের মত? গতমাসে নয়দিল্লির মারকিন দূতাবাসে সেনেটর পারসি সাংবাদিকদের বলেছিলেনঃ আমেরিকা ভারতকে যতটা আর্থিক সাহায্য দিয়েছে তার তুলনায় পাকিস্তানকে প্রদত্ত সাহায্য একটা চিনাবাদাম মাত্র। তিনি এ বছরের ২৫ মারচে পরবর্তী সময়ের কথা মনে রেখেই কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু শুধু সংখ্যা দিয়ে সব কিছু বােঝা যায় না; কারণ তাতে পরিপ্রেক্ষিতটা ঠিকমত ধরা পড়ে না। আমেরিকা সরকারী ভাবেই স্বীকার করেছে ঃ এবছরের মারচ মাস থেকে সে দেশ পাকিস্তান ৩৬ লাখ ডলার মূল্যের অস্ত্রাদি কিনেছে। চিনাবাদামই বটে। এ হিসাবও কষা হয়েছে ঝড়তি-পড়তি সামরিক সম্ভারের মূল্যমানে, ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে অস্ত্রদির প্রকৃত মূল্য ৩০৬ লাখ ডলারের কম নয়। এর আগেও পাকিস্তান আমেরিকার কাছ থেকে ‘চিনাবাদাম পেয়েছে। সত্যি বলতে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে এ ধরনের চিনাবাদাম’ শেষ আর হয় না। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত সংঘর্ষের পর তা দেওয়া কিছু কালের জন্য বন্ধ হয়েছিল; কিন্তু মাত্র মাস ছয়েক পরেই প্রেসিডেন্ট নিকসন ঘােষণা করেন যে পাকিস্তানকে কম বিধ্বংসী (নন-লেথাল) অস্ত্র ক্রয়ের অনুমতি দেওয়া হবে। ১৯৬৭ সালের এপরিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই পুনরপি ঘােষিত হয় ও পাকিস্তানে মারণাস্ত্রও বিক্রয় করা হবে। | পাকিস্তান স্বভাবতই এর সুযােগ নেয়। ১৯৫৪ সাল থেকে সে আমেরিকার কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র পেয়েছে প্রচুর কিনেছে। সে সব পুরানাে অস্ত্রকে ব্যবহার যােগ্য করে তােলার জন্য পাকিস্তান নতুন করে আমেরিকার কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার ‘চিনেবাদাম কেনে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষা দফতরের প্রধান উপসহসচিব শ্ৰীটাউনডসেন্ড হুপস এক সাব-কমিটিতে এ কথা স্বীকার করেন।
ঐ সাব-কমিটিতে এ বিষয়ে আলােচনার সময়ে সেনেটর সিমিংটন এবং সেনেটর কুপার বলেছিলেন১৯৬২ সালের পর থেকে ভারত আমেরিকার কাছ থেকে যা কিছু সাহায্য পেয়েছে তা সামরিক দিক থেকে নিতান্তই তুচ্ছ; অন্ত্র বিক্রয় সংক্রান্ত নিয়মের রদবদলের ফলে পাকিস্তানই লাভবান হয়েছে। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান আমেরিকার কাছ থেকে সাতটি বি-৫৭ এবং আঠারটি এফ-১০৪ যুদ্ধ বিমান এবং ৩০০ টি সৈন্য বহনকারী গাড়ী পায়। খাতায় কলমে এগুলির দাম লেখা হয়েছিল মাত্র ১.৫ কোটি ডলার। অথচ তাদের বাজার দর প্রায় ১৫ কোটি ডলার। ইয়াহিয়া খান এ বছর ২৫ মারচ থেকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপর তার জল্লাদদের লেলিয়ে দেওয়ার পর আমেরিকা ঘােষণা করেছিল সে দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র দেবেনা । কিন্তু নিউইয়রক টাইমসের চমক জাগানাে খবরে জানাজানি হয়ে গেল ঃ তলে তলে আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে চলেছে। আমেরিকার মানুষও এ খবরে ক্ষেপে উঠলেন। প্রশাসকরা এ বিষয়ে বিশ্বাসযােগ্য কোন ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না? বলা হল ? ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে অস্ত্র বিক্রির লাইসেন্সগুলির নতুন করে পর্যালােচনা করা হবে। কিন্তু অন্য পরে দূর কথা, আমেরিকানরাই এসব কথার খাটিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছে না। পাকিস্তান-আমেরিকার সঙ্গে সামরিক চুক্তি হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। “চিনবাদাম দেওয়া সেই থেকেই শুরু। উদ্দেশ্য নাকি কমিউনিজম প্রতিরােধ। সােভিয়েত ইউনিয়নও তখন শত্রু পক্ষের তালিকায়। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকা সরকারী হিসাবে পাকিস্তানকে ৭৩ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্রাদি দিয়েছে। কিন্তু অনেকের হিসাবে ওই সব সময় সম্ভারের প্রকৃত মূল্য ১.৫ বিলিয়ন ডলার। ১৯৬৫ সালের মধ্যেই পাকিস্তান ছয়টি পদাতিক ডিভিসন, এবং দুটি বর্মাচ্ছাদিত ডিভিশন গড়ে তােলে। পাকিস্তানের মােট আটটি ডিভিশনের মধ্যে আমেরিকা ৫২, ১/২টি ডিভিসন গড়তে করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেনেটর স্যাকসবি গত বছর সেনেটে এক ভাষণে বলেছিলেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকা পাকিস্তানকে যত অস্ত্র দিয়েছে। রাস্তাঘাট, বিমান অবতরণ ক্ষেত্র, সামরিক সম্ভার রক্ষণ-বেক্ষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদির জন্য পাকিস্তান যত মারকিন সাহায্য পেয়েছে এবং সেনেটের মাধ্যমে পাকিস্তানের হাতে যে পরিমাণ মারকিনী সাহায্য পরােক্ষভাবে পৌছেছে সে সবের মােট মূল্য দু বিলিয়ন ডলারের কম নয়। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারত আমেরিকার কাছ থেকে ৭২৫ কোটি ডলার পরিমাণ ঋণ এবং মঞ্জুরি পেয়েছে। ঐ সময়ে পাকিস্তান ঋণ ও মঞ্জুরি বাবদ পেয়েছে ৩৩০.৪ কোটি ডলার আয়তনে লােকসংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তান ভারতের মাত্র এক-চতুর্থাংশ।
১৯৬৫ সালের পর থেকে পাকিস্তান হন্যে হয়ে আমেরিকা ছাড়া, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান, বেলজিয়াম, ইতালি প্রভৃতি দেশের কাছ থেকেও সমর সম্ভার কিনতে শুরু করে। সে চীনের কাছ থেকে ৯০ টি মিগ, ১৯টি বিমান, ১০টি আই এল-২৮ বােমারু বিমান, ২০০টি ট্যাঙ্ক এবং কয়েকটি জাহাজ পায়; সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে পায় ২৫০ টি ট্যাংক, ৪০টি হেলিকপ্টার, বহু সংখ্যক ১৩০ এস, এস, বন্দুক রাডার ও বিমানের যন্ত্রাংশ। ফ্রানসের কাছ থেকে পাকিস্তান কিনেছে বহু হেলিকপটার, ২৫টি মিরেজ-১১১ যুদ্ধ বিমান এবং চারটে সাবমেরিন। সম্প্রতি সে ফ্রানসের কাছে কিছু মিরেজ-৫ বিমানের জন্য অর্ডার দিয়েছে। ইরানের মাধ্যমে পাকিস্তান পশ্চিম জারমানির ৯০টি এফ-৮৬ স্যাবার জেটও পেয়েছে। চীন এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে অস্ত্রাদি পেলেও পাকিস্তান সমর সম্ভারের জন্য অনবরত আমেরিকার উপর চাপ দিয়ে চলেছে। সে দেখতে চায় ? আসলে সে দেশ আমেরিকার উপরেই নির্ভরশীল। সুতরাং আমেরিকা যে তাকে তুষ্ট করবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ মােহাম্মদ আয়ুবের মতে “১৯৬৫ সালের আগে আমেরিকা পাকিস্তানকে যত অস্ত্র দিয়েছে’ চীন বা সােভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্র পরিমাণের দিক থেকে তার কাছেও যেতে পারবে না। কমিউনিজম রােধ করার নাম করে আমেরিকা পকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে এসেছে; কিন্তু সে অস্ত্রের একখানাও ঐ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়নি, হয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে। চীন এবং সসাভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ের সঙ্গেই পাকিস্তান বন্ধুত্ব পাতাতে পেরেছে। ১৯৬৭ সালে সেনেট সাব কমিটির আলােচনায় ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে আক্রমণ করার।
সম্ভাবনা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে শ্ৰীটাউনসেন্ড হপস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন ‘আমি মনে করি উত্তরটা হল পরিষ্কার না।’ তাহলে প্রশ্ন ঃ এই উপমহাদেশে কে যুদ্ধ বাধাবার মতলব ফঁাদছে? তাহলে প্রশ্নঃ কোন চুক্তিতে আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে চলেছে। আমেরিকার ব্যাখ্যা হল ঃ পাকিস্তানকে আগে প্রদত্ত অস্ত্রগুলি ব্যবহারােপযােগী করে তােলার জন্যই নতুন করে অস্ত্র দেন। শ্রী-হুপসের মতে অস্ত্র না দিলে পাকিস্তান অন্যের দ্বারস্থ হত এবং তার ফল ভালাে হত না। আসলে আমেরিকার লক্ষটা কী? শ্রী হুপস বলেছেন পাকিস্তান এবং ভারতের উপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ রাখা ‘ভারতের সঙ্গে শক্তির একটা যুক্তিসঙ্গত অনুপাত বজায় রাখা …।’ এ সব পবিত্র ইচ্ছা সত্ত্বেও আমেরিকার কোন কল্পিত অনুপাত বজায় রাখতে পারেনি। ১৯৬৫ সালের। পর থেকে ভর পাকিস্তানর দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। আমেরিকার বিশেষজ্ঞদের মতে অস্ত্রের উৎকর্ষতার দিক থেকেও পাকিস্তান ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। সে জন্যই বােধহয় ইয়াহিয়ার কণ্ঠে এত যুদ্ধের হুমকি । কিন্তু ভারত ওর হুমকিতে কম্পমান নয়। ২ সেপ্টেম্বর শ্রী রী-লেককাংসে গারডিয়ান পত্রিকায় লিখেছেন ও ইসলামাবাদের অনেক অফিসারই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য বলে মনে করছেন। দেরি না করে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেই প্রথম আঘাত হানা উচিত- এই থিওরি অনুযায়ী তারা তৈরি হচ্ছেন। আমেরিকার নীতির ফলে পাকিস্তানের সামরিক ব্যয় কি সঙ্কুচিত হয়েছে? বিন্দুমাত্র না। পাকিস্তানের সরকারী হিসাবেই ১৯৫৪-৫৫ সাল থেকে শুরু করে ১৬ বছরের তার কেন্দ্রীয় বাজেটের মােট ৩৭৬৯ কোটি টাকার শতকরা ৫৬ ভাগই ব্যয়িত হয়েছে সামরিক খাতে। ১৯৫৪-৫৫ সালে পাকিস্তানের সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬৩.৫১ কোটি টাকা; ১৯৬৮-৬৯ সালে। ২৪৫ কোটি টাকা; চলতি বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। কোথায় নিয়ন্ত্রণ? সামরিক ব্যয় হ্রাস কিংবা প্রতিরক্ষা বাহিনীর যুক্তিসঙ্গত অনুপাতই বা কোথায়? আর সে জন্যই দরকার মত একটা “চিনাবাদাম ও অনেক বড় হতে পারে আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা হতে পারে ভয়ংকর রকমের বড়।
৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা