উপদেষ্টা কমিটি কি ফ্রন্ট গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ?
–শংকর ঘােষ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সমস্ত বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য পঞ্চদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ মাসের ইতিহাসে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মুজিবনগরে এই পাঁচটি দলের নেতাদের দুদিনের বৈঠকে এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুজিবনগর বৈঠকের আগের দিন ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের সচিব শ্ৰী টি এন কাউল বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলােচনার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন; তার কয়েকদিন আগেই একই উদ্দেশ্যে এসেছিলেন শ্রী ডি পি-ধরপররাষ্ট্র দফতরের যার স্থান এখন ঠিক মন্ত্রী শ্রীস্বর্ণ-সিং-এর নীচে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, শ্রীকাউল ও শ্রীধর-এর সঙ্গে আলােচনায় বাংলাদেশের নেতারা উপদেষ্টা কমিটি গঠনের সম্ভাবনার উল্লেখ করেছিলেন। কমিটি যখন শেষ পর্যন্ত গঠিত হয়েছে, তখন অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, প্রস্তাবটিতে পররাষ্ট্র দফতরের সম্মতি আছে। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে ৯ আগস্ট। তার ঠিক একমাস পরে এই উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হল। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ভারত-সােভিয়েত চুক্তির পেছনে সবচেয়ে জোরালাে তাগিদ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তার ফলশ্রুতি পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের আশঙ্কা। এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আলােচনা হওয়া উচিত। কাজেই সােভিয়েট ইউনিয়নের জ্ঞাতসারেই এই কমিটি গঠিত হয়েছে বলে মনে হয়। | শুধু তাই নয়, এই কমিটি গঠনের উদ্যোগে যদি সােভিয়েত ইউনিয়নের কোন হাত থাকে তা হলেও বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পারটি উপদেষ্টা কমিটির সভ্য পাঁচটি দলের অন্যতম। এবং শুধু বাংলাদেশের কমিউনিসট পারটিই নয়, ভারতীয় কমিউনিস্ট পারটিও গত কয়েক মাসে বারবার মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য একটি জাতীয় মুক্তিফ্রনট গঠনের প্রস্তাব করেছে। সােভিয়েট ইউনিয়নের আশীর্বাদপূত না হলে এই প্রস্তাবের দাবিতে বাংলাদেশের বা ভারতের কমিউনিস্ট পারটি সােচ্চার হত না। অবশ্য জাতীয় মুক্তি ফ্রনট ও উপদেষ্টা কমিটিতে প্রভেদ আছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পারটি ভিয়েতনামের অনুকরণে একটি ফ্রনট সৃষ্টির প্রয়াসী ছিল।
তাতে বাংলাদেশ সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব এই ফ্রনটের উপর বর্তাত । ফ্রনটের নেতারা যেমন যুক্তভাবে মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতেন, তেমনি ভবিষ্যতের শান্তি আলােচনাতেও তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ফ্রনট গঠিত হলে সম্ভবত অস্থায়ী সরকারেও রদবদল হত, আওয়ামী লীগের একক পরিবর্তে পাঁচ দলের কোয়ালিশন সরকার গঠিত হত। উপদেষ্টা কমিটির ক্ষমতা কখনই এত ব্যাপক হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব এখনও আওয়ামী লীগ সরকাররই হাতে। অস্থায়ী সরকার যে উপদেষ্টা কমিটির পরামর্শ অনুসারে সর্বদা চলবেন তার কোনও স্থিরতা নেই। তবে উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, সুতরাং উপদেষ্টা কমিটি ও অস্থায়ী সরকারের মধ্যে সহসা কোন মতদ্বৈধ না হওয়া স্বাভাবিক। কমিটি ও সরকার পারস্পরিক সহযােগীতায় কিছুকাল কাজ করার পর পাঁচ দলের সরকার গঠিত হওয়াও কিছু বিচিত্র নয়। সেদিক থেকে উপদেষ্টা কমিটি ফ্রনট গঠনের একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। সম্ভবত সেজন্যই ফ্রনট গঠনের দাবি না ছাড়লেও বাংলাদেশের কমিউনিসট পারটি এই উপদেষ্টা কমিটিতে যােগ দিতে সম্মত হয়েছে। জাতীয় ফ্রট গঠনে আওয়ামী লীগ নেতাদের আপত্তি আছে শােনা গেছে। খবরটি সত্য হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বরং সেইটি স্বাভাবিক। গত ডিসেম্বর নির্বাচনে পাঁচদলের কয়েকটি দল প্রতিযােগিতা করেছিল এবং তাদের সকলকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। বাংলাদেশের জনগণের একক প্রতিনিধিত্ব করার দাবি যদি আওয়ামী লীগ করে তাহলে সে দাবি গণতন্ত্রসম্মত এবং তাকে অগ্রাহ্য করবার কোন সঙ্গত কারণ নেই। বাংলাদেশের নির্বাচকমণ্ডলী যে দল গুলিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাদেরকেই কয়েকটি দলকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া নির্বাচনী রায়ের বিরােধী হত। অবশ্য ফ্রনট গঠনের প্রস্তাবও একেবারে অযৌক্তিক নয়। পাঁচ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে; নতুন রাজনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্ট হয়েছে। এতদিন বাংলাদেশ কমিউনিসট পারটি বেআইনি ছিল, দলের কাজ গোপনে চলত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কমিউনিসট পারটি স্বনামে কাজ আরম্ভ করেছে এবং ইতিমধ্যেই কয়েকটি এলাকায় নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। পাঁচদলের কমিটিতে কমিউনিস্ট পারটির অন্তর্ভূক্তির অর্থ হল স্বাধীন বাংলাদেশে যদি আওয়ামী লীগের একক সরকার গঠিত হয় তাহলেও কমিউনিসট পারটি আবার বে-আইনী ঘােষিত হবে না, অন্য বৈধ পারটির মতই নিজের অভিমত প্রচারের স্বাধীনতা কমিউনিসট পারটির থাকবে।
কমিউনিসট পারটি ও অন্য তিনটি দল অবশ্যই ক্ষমতার অংশীদার হতে চাইবে এবং সম্ভবত হবেও। তা না হলে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক কাজের অবাধ সুযােগের অগ্রিম প্রতিশ্রুতিও কম লাভ নয়। তাছাড়া উপদেষ্টা কমিটি যদি অস্থায়ী সরকারের নীতি কতকাংশও প্রভাবিত করতে পারে তাহলে এই চারটি দলের পক্ষে সেটি কম মর্যাদার কথা নয়। কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অন্তত পরিমিত ভাবে স্বীকৃত হয়েছে। এই দলগুলি এতদিন প্রায় বিনা প্রত্যাশাতেই মুক্তিযুদ্ধের সামিল ছিল। এখন। রাজনৈতিক প্রাপ্তির সম্ভাবনায় তাদের সংগ্রামী-মনোভাব তীব্রতম হবে; সংগ্রামের লক্ষ্যের সঙ্গে তারা একাত্ম হবে, কারণ তাদের সমিতি ছাড়া আর এই সংগ্রামের অবসান সম্ভব নয়।ঠিক এই মুহূর্তে কমিটি গঠনও বিনা কারণে নয়। যতদিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সংশয় ছিল। ততদিন আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বের অবসানের প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু আজ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের। জয় সংশয়াতীত। পাকিস্তানের শঙ্কিত শাসকরা এখন বিপর্যয় এড়ানাের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা নানা। রকম পরিবর্তনের কথা বলছেন এবং তাদের পরাজয় যত অনিবার্য হয়ে উঠবে ততই তারা বিরােধ মীমাংসায় ব্যর্থ হবেন। মুক্তিসংগ্রামীদের লক্ষ্য স্থির না থাকলে জঙ্গীশাসকদের এই ফাদে নেতারা পড়তে পারেন, তারাও। রণক্লান্ত, তারাও যুদ্ধবিরতির জন্য ব্যগ্র যাতে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজ যত শীঘ্র সম্ভব শুরু হতে পারে। কমিটির অস্তিত্ব এই সহসা-শান্তির অন্তরায় হবে। কমিটির সদস্য কয়েকটি দল আওয়ামী লীগের আগেই বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলেছিল। কমিটি গঠনের পর পূর্ণ স্বাধীনতার কমে-বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরতির সম্ভাবনা আর নেই মনে হয়। | উপদেষ্টা কমিটির কয়েকটি সদস্যদলের পশ্চিম পাকিস্তানেও কিছু প্রভাব আছে। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানে এদের দু-একটি দলের প্রভাব আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি, যেমন ওয়ালীখানের ন্যাশনাল। আওয়ামী পারটি। যদিও মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ওয়ালীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পারটি এই সংগ্রামের সরিক, তবু এতদিন পর্যন্ত এই দল সংগ্রাম পরিচালনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল না। ফলে পশ্চিম।
পাকিস্তানে এই দলের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন প্রায় মৌখিক ছিল। এখন সেই সমর্থন সক্রিয় হতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পশ্চিম পাকিস্তানে গণ-আন্দোলনের সম্ভাবনা আর সুদূরপরাহত নয় । শ্রীভুট্টোর সাম্প্রতিক উক্তি থেকে বােঝা যায় তিনি এই সম্ভাবনা সম্পর্কে সজাগ ও শঙ্কিত। বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া যদি মুক্তিযুদ্ধের অবসান না হয় তাহলে এই সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। মুজিবের গ্রেপ্তারের পর দীর্ঘস্থায়ী মুক্তিসংগ্রামের কার্যকরী নেতৃত্ব কোন দলের করায়ত্ত হত তা নিয়ে সংশয় দেখা গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক দেশগুলির পক্ষে এই সংশয় দীর্ঘমেয়াদী নীতি নির্ধারণের অন্তরায় হয়েছিল। কারণ সংগ্রামের পুরাে ভাগে বর্তমান যে দল সে দল স্থানচ্যুত হলে এই দেশগুলির নীতি পরিবর্তনের প্রয়ােজন হত। নতুন নেতৃত্ব যে এইসব দেশের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন হবে তার কোন স্থিরতা ছিল। বিশেষত ভারতের মত প্রতিবেশী দেশের পক্ষে এই সঙ্কট গভীরতর হত। নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রভাব। ভারতের অভ্যন্তরিক পরিস্থিতিতেও প্রতিফলিত হত। যে উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়েছে তাতে এই সংশয়ের নিরসন হবে। মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ও ভারতের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন সব রাজনৈতিক দলই এই কমিটিতে স্থান পেয়েছে; ভারতবিদ্বেষী দলগুলির। কমিটিতে স্থান হয়নি। এ সম্বন্ধেও কোন সন্দেহ নেই, এই যুক্ত নেতৃত্বকে হারিয়ে অন্য কোন দল বা গােষ্ঠীর। নেতৃত্ব দখল করার সম্ভাবনা নেই। | সােভিয়েট ইউনিয়ন অনুরূপভাবে আশ্বস্ত বােধ করতে পারে। এখন এশিয়ার সােভিয়েট প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মুখ্যত চীনের সঙ্গে। কমিটিতে বাংলাদেশ কমিউনিসট পারটির অন্তর্ভুক্তির ফলে বাংলাদেশে সােভিয়েট। উপস্থিতি সম্ভব হবে। বাংলাদেশের মাওপন্থীরা কমিটিতে স্থান না পাওয়ার জন্য ক্ষমতার ত্রিসীমানায় আসতে পারলেন না, কিন্তু সােভিয়েট সমর্থকরা ক্ষমতার আসনে না হলেও তার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। এর ফলে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে বাধা ভারত, সােভিয়েট ইউনিয়ন ও অন্য। সহানুভূতিশীল দেশের ছিল তা অনেকটা দূর হল। স্বীকৃতি দেওয়ার একটি অর্থ হবে যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া। কোন ভিত্তিতে মীমাংসার সমর্থন করা ভারত বা সােভিয়েট ইউনিয়নের পক্ষে সম্ভব হবে না। মুক্তিসংগ্রামীদের জয় সম্পর্কে যখন সংশয়ের বিশেষ কোন কারণ নেই এবং সংগ্রামের স্থায়ী নেতৃত্বেরও যখন প্রতিষ্ঠা হল তখন স্বীকৃতির সময়ও সমাগত মনে হয়। অবশ্য ভারত ও সােভিয়েট ইউনিয়নের পারস্পরিক আলােচনার মাধ্যমেই স্বীকৃতির লগ্ন চূড়ান্ত ভাবে স্থির হবে।
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা