বাংলাদেশের মুক্তি
খসরু ফারমােরজ রুস্তমজি
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) প্রধান ছিলেন। তিনি ১৯১৬ সালের ২২ মে নাগপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যােগ দেন। ১৯৬৫ সালে ভারত সরকার রুস্তমজিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী গঠনের দায়িত্ব দেয়। ১৯৭৪ সালে তিনি বিএসএফ থেকে অবসরে যান। ১৯৯১ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ উপাধি পান। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৬ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি লেখালেখি শুরু করেন। পি ভি রাজগােপাল রুস্তমজির নিবন্ধ ও ডায়েরি সম্পাদনা করে দ্য ব্রিটিশ দ্য ব্যান্ডিটস অ্যান্ড দ্য বর্ডারমেন নামের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন (উইজডম ট্রি, নিউ দিল্লি, ২০০৯)। এ গ্রন্থের একটি অংশজুড়ে রুস্তমজি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতির বর্ণনা করেছেন। নিচে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর লগ্নে রুস্তমজির নিজের ও বিএসএফের ভূমিকার কিছু অংশ তুলে ধরা হলাে।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ আওয়ামী লীগ অসহযােগ আন্দোলন শুরু করে। তারা সামরিক সরকারের সমান্তরালে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা চালু করে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণও এতে ব্যাপকভাবে অংশ নেন। এই অংশগ্রহণের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে প্রধান বিচারপতি নতুন গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান [৯ এপ্রিল শপথ পাঠ করানাে। হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে মুজিব ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন এবং প্রথমবারের মতাে স্বাধীনতার স্লোগান উত্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় যান
পৃষ্ঠা: ১৬১
এবং পরে ভুট্টোও যান। মুজিবের সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনা চলতে থাকে, এর পেছনের উদ্দেশ্য ছিল কালক্ষেপণ করে জাহাজ [চট্টগ্রামে অবস্থিত এমভি সােয়াত] থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ নামানাে এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানে আসার [পশ্চিম পাকিস্তান থেকে] সুযােগ সৃষ্টি করা।
ঢাকার আলােচনা যখন পরিষ্কারভাবে অচলাবস্থার দিকে এগােচ্ছিল, তখন বিএসএফ হেডকোয়ার্টার থেকে ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ডাইরেক্টর (প্রশাসন) গােলক মজুমদারকে কলকাতায় বিএসএফের পূর্বাঞ্চল কমান্ডের আইজি হিসেবে প্রেরণ করা হয়। তাঁকে লাগসই কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়, যথা (ক) জাতীয় স্বার্থে যা কিছু করণীয় তা করবে, (খ) নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করবে এবং (গ) নিজের সীমারেখা নির্ধারণ করবে। কোনাে প্রকার লিখিত আদেশ তাঁকে দেওয়া হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের পুলিশ বিভাগে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তৈরি করা তাঁর গােয়েন্দা সূত্রগুলােকে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে চাঙা করে তােলেন।
ঠিক একই সময় ভারতে সংসদীয় নির্বাচন চলছিল এবং এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে প্রয়ােজনবােধে কী ধরনের সাহায্য করতে হবে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার কোনাে দিকনির্দেশনা ছিল না। ভারত খুব ভালােভাবেই এই সত্য জানত যে পাকিস্তান ৫০-এর দশক থেকেই নাগাল্যান্ডের বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ব্যবহার করছিল এবং পরবর্তী সময়ে মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য, যারা ১৯৬৬ সালে বিদ্রোহ ঘােষণা করে আসছিল।
১৯৭১ সালের ১০ মার্চ এবং পরবর্তী সময়ে আমরা নতুন দিল্লিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বহু আলাপ-আলােচনা করি। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের চিন্তায় পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রাধান্য পাচ্ছে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে আমরা কী করব, সে বিষয়ে আমাদের কোনাে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। আমি তিনটি সম্ভাবনা চিহ্নিত করেছিলাম। কিন্তু আমরা কী করতে পারি, আলােচনায় সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনাে ফলাফল আসেনি। যদিও সবাই স্বীকার করেন যে কিছু একটা করার মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেছে। আমি যে যুক্তি দেখাই তা ছিল, অনুগ্রহ করে আমাদের কিছু করার অনুমতি দেওয়া হােক। কী করতে হবে, তা আমরা নিজেরাই বের করে নেব। এসব ক্ষেত্রে কোনাে আগাম পরিকল্পনা করা যায় না। প্রথমে যা করতে হয় তা হলাে, পরিস্থিতি বােঝা।’
খবর আসছিল পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকসংখ্যক সেনাসদস্য জড়াে করা হচ্ছে। সেখানে সবসুদ্ধ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ইবিআর) আটটি ব্যাটালিয়ন ছিল [প্রকৃতপক্ষে ছিল পাঁচটি ব্যাটালিয়ন]। এসব রেজিমেন্ট পরিচালিত হতাে
পৃষ্ঠা: ১৬২
পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার দ্বারা। যদিও সেনাসদস্যরা ছিলেন বাঙালি। তিনটি ব্যাটালিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানে রাখা হয়। সামরিক জান্তা ইবিআরে যেকোনাে সশস্ত্র অভ্যুত্থান দমন করার জন্য সমন্বিত ও বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা করেছিল। পাকিস্তানের পরিকল্পনা ছিল এই ইউনিটগুলােকে নিরস্ত্র করা। সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম, যশাের, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও জয়দেবপুরে ইবিআর ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার ক্ষেত্রে প্রায় সফল হতে চলেছিল। কিছু বাঙালি কর্মকর্তা আসন্ন বিপদ বুঝতে পারেন এবং পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অশুভ পরিকল্পনাকে মােকাবিলা করার জন্য পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
২৫ মার্চে আলােচনা ব্যর্থ হয়। ইয়াহিয়া খান দম্ভপূর্ণ ভাষণ দিলেন, তিনি বেয়নেটের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে শাসনের হুমকি দেন এবং দ্রুতই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন (ভাষণের আগেই ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলেন)। মধ্যরাতে ধানমন্ডিতে মুজিবের বাসভবনে কমান্ডাে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই রাতে এ এলাকার গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান সামরিক আইন চাপিয়ে দেন এবং বিধ্বংসী আক্রমণ চালিয়ে সন্ত্রাস ও সহিংসতাপূর্ণ রাজ্য কায়েম করেন।
নতুন দিল্লিতে আমরা পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের খবরাখবর সংগ্রহ করছিলাম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কিছু করার বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন। আমাকে ২৭ মার্চ শনিবার বলা হয় সােমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে।
আমরা ২৮ মার্চ রােববার স্বরাষ্ট্রসচিবের বাসায় মিলিত হই। খবরের কাগজের প্রতিবেদনগুলাে দেখা হয়। আমরা কাওয়ের (Kao) [আরএডব্লিউএর প্রধান আর এন কাও] কাছ থেকে সারসংক্ষেপ শুনি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সশস্ত্র অভিযানের ভয়াবহ খবর আসছিল। আমাদের নিষ্ক্রিয়তায় আমি বিষাদগ্রস্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়ি। আমি দেখতে পাচ্ছি যে একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটে চলেছে আর আমরা রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছি, এটি নাট্যদলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমি দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপারিশ প্রদান করি। কাও ছিলেন সংশয়ী। তিনি হুঁশিয়ার থাকার উপদেশ দিলেন—বেসামরিক প্রশাসনের সংকেতবাণী। তাকে বােঝানাের প্রয়ােজন ছিল এবং শেষে তিনি মেনে নিলেন। আমার অধীন ব্যাটালিয়নগুলাের খবর নেওয়া হলাে, তারপর সীমান্তকে বিভিন্ন সেক্টরে বিভক্ত করে প্রশিক্ষণকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আর স্টাফদের দায়িত্বে অতিরিক্ত ইউনিটগুলাে সীমান্তে মােতায়েন করতে বলা হলাে। আমরা কালক্ষেপণ না করে অতি দ্রুততার সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় চলে যাই এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করি। ব্রিগেডিয়ার বি সি পান্ডে আগরতলা, কর্নেল রামপাল সিং
পৃষ্ঠা: ১৬৩
কোচবিহার, ব্রিগেডিয়ার এম এস চ্যার্টাজি বালুরঘাট, কর্নেল মেঘা সিং বনগাঁওয়ে অবস্থান নেন। তাদের আমাদের সীমান্ত রক্ষা এবং বেসামরিক নাগরিক ও মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কার্যক্রম প্রতিরােধ করাসহ বেসামরিক জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য রেশন ভাতা এবং পােশাক সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২৯ মার্চ তারিখে সিওএএস [চিফ অব আর্মি স্টাফ] থেকে সীমিত। সহযােগিতা দেবার আদেশ জারি হয়। যে বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়েছিল তা হলাে, যদি পাকিস্তান চীন-ভারত সীমান্তে ভারতের ওপর চাপ প্রয়ােগের জন্য চীনের কাছে আবেদন জানায়, তখন চীনের প্রতিক্রিয়া কী হবে।
শেষ পর্যন্ত ৩০ মার্চ লড়াইয়ের জন্য ক্ষেত্র তৈরি হলাে। এতে সাহায্য করে ৩১ মার্চ ১৯৭১ তারিখে গৃহীত পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতি বিরােধীদলীয় নেতাদের সমর্থন দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সিওএএসের সার্বক্ষণিক সহায়তা দেবার নিশ্চয়তা। প্রধানমন্ত্রী আমাকে স্বল্প ভাষায় নির্দেশ দেন, তুমি যা করতে চাও করাে, কিন্তু ধরা পােড়াে না। আর কিছুই স্পষ্ট করা হলাে না। কেননা, সামনে কী হবে তা দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির মধ্যে অনুমান করা সম্ভব ছিল না। আমার প্রতি নির্দেশ ছিল যে স্ববিবেচনায় আমি এমন পদক্ষেপ নিতে পারব, যা চূড়ান্তভাবে ফলপ্রসূ হতে পারে। অতি জটিল পরিস্থিতি আর ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে এভাবেই বিএসএফ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়। কমান্ডাে আক্রমণ ও বিস্ফোরণ ইত্যাদিতে পারদর্শী কতিপয় কর্মকর্তাসহ প্রায় ১০০ সদস্য নিয়ে বাহিনী গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির জন্য যুদ্ধরত জনগণকে সহায়তা করতে এ বাহিনীকে সংগঠিত করা হয়। এ বাহিনীর লক্ষ্য ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে সাহায্য করা।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের তিন দিন পর গােলক তাঁর পরিচিতদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে কিছু জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা, সম্ভবত মুজিবসহ [শেখ মুজিবুর রহমান] দরিদ্র কৃষকের বেশে কুষ্টিয়ার দিকে আসছেন।
৩০ মার্চ একজন ইপিআর কর্মকর্তা একটি চিরকুট পাঠান, সম্ভবত এটি ছিল তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম চিরকুট; এতে আমাদের কাছে তাঁরা সাহায্যের আবেদন জানান। ৭৬ ব্যাটালিয়নের কর্নেল চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে গােলক কৃষ্ণনগর যান। বানপুর-গেদে সীমান্তে তারা মেহেরপুরের সাবডিভিশনাল কর্মকর্তা তৌফিক [তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম, পরে বাংলাদেশ সরকারের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা] এবং সাব-ডিভিশনাল পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবের [মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, বীর
পৃষ্ঠা: ১৬৪
বিক্রম, পরে ঢাকার এসপি] সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের কর্মকর্তারা জানান, টেলিফোন ব্যবস্থা তখনাে সচল থাকায় তারা নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে পেরেছিলেন। যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে তাদের কী। ধরনের সাহায্য-সহযােগিতা প্রয়ােজন এবং আমরাই বা তাদের জন্য কী করতে পারি, তারা তখন পেট্রল, তেল, কেরােসিন, টাকাপয়সা, গােলাবারুদসহ সব ধরনের সাহায্যের আবেদন জানান।
গােলক তাঁদের জিজ্ঞেস করেন যে তিনি আন্দোলনের কয়েকজন স্বীকৃত নেতার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন কি না। কিছুক্ষণ পরই তাজউদ্দীন আহমদ, যাকে শেখ মুজিব তাঁর উত্তরাধিকারী করে গিয়েছিলেন, অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন আমীর-উল ইসলাম (ব্যারিস্টার), যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের চিপ হুইপ। তাঁরা উভয়েই ছিলেন খালি পায়ে, দুশ্চিন্তায় চোখ-মুখ বসে যাওয়া, তাঁদের পরনে ছিল লুঙ্গি ও গেঞ্জি। তাঁরা সুদূর ঢাকা থেকে হেঁটে এসেছিলেন।
‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি হলাম গােলক মজুমদার’।
‘অবশ্যই আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। তাজউদ্দীন বলেন, আমাদের নেতা, মুজিব ভাই আমাদের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে গিয়ে প্রতিরােধ আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। মুজিব নিজে গ্রেপ্তার এড়াতে পারেননি। তিনি আমাদের বারবার সতর্ক করে দেন, আমরা যেন এমন কিছু না করি, যার দরুন ভারত বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, চীনকে ক্ষুব্ধ করে, অথবা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের অবস্থানে আঘাত হানে।’
গােলক তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি আমাদের কাছ থেকে কী চান এবং আমরাই বা আপনাদের জন্য কী করতে পারি? আপনি কি আমার সঙ্গে কলকাতায় আসতে পারেন?
তাজউদ্দীন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, তিনি তাঁর লােকজনসহ আড়ালে থাকতে চান। গােলক তাকে বলেন যে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হতে পারে। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে খুঁজছে এবং তাঁকে একসময় খুঁজে বের করবে। এরপর তিনি তাঁর লােকজনের সঙ্গে পরামর্শ করতে যান এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলেন যে তিনি যেতে রাজি আছেন।
গােলক আমাকে এসব খবর দিলে আমি নিজেও কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করি। যখন আমি সেখানে অবতরণ করি, তখন ৩০-৩১ মার্চের রাত ১২টার বেশি হয়ে গেছে। গােলক যথারীতি তার হাসিমুখসহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা আমাকে কলকাতায় স্বাগত জানালেন। তিনি আমাকে একটু
পৃষ্ঠা: ১৬৫
ফাঁকে ডেকে নিয়ে বলেন, আন্দোলনের দুই নম্বর ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে এসেছেন। আপনি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান?
‘অবশ্যই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই এবং এক্ষুনি।’
আমরা জিপের কাছ হেঁটে গেলাম, যেখানে তিনি বসে ছিলেন, দুজন লােক তাঁর পাহারায় ছিলেন। আমরা আমীর-উল ইসলামসহ তাঁকে আসাম হাউসে নিয়ে গেলাম। স্নানপর্ব সেরে পরিধান করার জন্য তাঁদের আমি কোর্তা ও পাজামা দিলাম। গােলক তাঁদের জন্য ওমলেট তৈরি করলেন। আমাদের গােয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাজগােপাল [ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা ও রুস্তমজির বইয়ের লেখক] নিশ্চিত করলেন যে তিনিই আন্দোলনের দুই নম্বর ব্যক্তি এবং আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন।
পরবর্তী দুই দিন ধরে আমরা তাঁর কাছ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমঝােতামূলক আলােচনার পূর্ণাঙ্গ গল্প শুনলাম। তাজউদ্দীন সমস্ত কিছু ভেস্তে যাওয়ার জন্য ভুট্টোকে দুষলেন। ইয়াহিয়া রাজি হতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু তিনি ভীত ছিলেন সামরিক জান্তা ও ভুট্টোর জন্য। ফলে ইয়াহিয়া সমঝােতামূলক আলােচনা ভেঙে দিয়ে ফিরে চলে যান, সম্ভবত সঠিক হবে না জেনেও। আমি তার কাছে আওয়ামী লীগ নেতাদের ইচ্ছা ও মনােভাব সম্পর্কে জানতে চাইলাম। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম আওয়ামী লীগ নেতাদের ইচ্ছা ও মনােভাব কীরূপ ছিল। তিনি ছিলেন পরিষ্কার। তারা স্বাধীনতা চান। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যাবতীয় পরিকল্পনা তিনি ব্যাখ্যা করলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত বাঙালি জনগণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত আছে।
তাজউদ্দীন সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। ১ এপ্রিল তিনি রাজগােপাল এবং গােলকের সঙ্গে কৃষ্ণনগরের কাছে বর্ডার আউট পােস্টে (বিওপি) যান। পূর্ব আয়ােজনের মাধ্যমে মেজর ওসমান, যিনি ছিলেন যশাের সেক্টরের (উইং কমান্ডার হিসেবে) দায়িত্বে, তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করেন এবং বলেন, যদি তিনি অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করতে না পারেন, তাহলে তিনি ও তার সহযােদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা রােধ করতে পারবেন না। তাজউদ্দীন আমাদের কর্মকর্তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন; তাঁর দৃষ্টি যেন বলতে চাচ্ছিল যে আমাদের আন্তরিকতা কার্যত মেজর ওসমানের চাহিদার প্রতি আপনাদের সাড়া দেওয়ার ওপর নির্ভর করছে। দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মেজর ওসমানকে কিছু অস্ত্র এবং চাহিদা মােতাবেক গােলাবারুদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যখন ওসমান ও তার সহযােদ্ধারা চলে গেলেন, তখন তাজউদ্দীন বললেন, তারা সেখানে [যুদ্ধক্ষেত্রে] ফিরে গেলেন। আর সঙ্গে নিয়ে গেলেন আমাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষাগুলাে।’
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে তাজউদ্দীন ও অন্য নেতাদের দিল্লি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গােলক তাঁদের সঙ্গে যাবেন। গােলক ও আমি নিউ মার্কেটে গিয়ে তাঁদের জন্য যাবতীয় পরিধেয় বস্ত্র (অন্তর্বাসসহ) এবং অন্যান্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রী, যেমন বাক্সপেটরা ও প্রসাধন ক্রয় করি। গােলক বলেন, স্যার, আমরা তাঁদের যেভাবে তৈরি করছি, মনে হচ্ছে যেন আমরা আমাদের কন্যাকে বরের বাড়ি পাঠাচ্ছি।’
আমি সরস মন্তব্যসহ বললাম, “গােলক, তেইশ বছর ধরে নয়াদিল্লির বাসিন্দারা মুক্তিযােদ্ধার দর্শন পায়নি। সেখানকার বর্তমান প্রজন্মের নেতারা জাঁকজমকপূর্ণ পােশাক-পরিচ্ছদবিহীন ব্যক্তিকে বড় কেউ বলে ভাবতে পারে না।
১ এপ্রিল রাতের বেলায় গােলক তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলামকে নয়াদিল্লি নিয়ে যান। সেখানে তাঁদের বিএসএফের সহকারী পরিচালক এস চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। গােলক দ্রুত কলকাতায় ফিরে আসেন অন্য নেতাদের খুঁজে বের করতে।
৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তারা সেখানে ভারতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেই যে কেবল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলােচনা করেন তা-ই নয়, সেই সঙ্গে পূর্ববঙ্গের অনেক বুদ্ধিজীবী, যারা ঘটনাক্রমে সে সময় দিল্লিতে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও আলােচনা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এম আর সিদ্দিকী (রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতার পর মন্ত্রী, প্রফেসর ইউসুফ আলী [রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতার পর মন্ত্রী], সােবহান [রেহমান সােবহান], অর্থনীতিবিদ এবং কিছু নির্বাচিত সাংবাদিক। প্রায় ১ সপ্তাহ দিল্লিতে কাটিয়ে তাঁরা ৯ এপ্রিল কলকাতা ফিরে আসেন তাদের দৃঢ় প্রত্যয় ও উদ্যমকে পাকাপােক্ত করে। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের জন্য একটি হােটেল ঠিক করি। মেহমানের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং একসময় তা পঞ্চাশজনে এসে দাঁড়ায়।
দিল্লিতে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এক সভায় পূর্ব পাকিস্তানের আধভেঁড়া একটি মানচিত্রের ওপর অনুমান করার চেষ্টা করি যে কীভাবে আমরা প্রতিরােধযুদ্ধকে সর্বোত্তমভাবে সমর্থন জানাতে পারি এবং মুক্তিফৌজকে প্রেরণা জোগাতে পারি। (স্বাধীনতালাভের পর থেকে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সব মনােযােগ নিবিষ্ট ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর। পূর্ব পাকিস্তান আমাদের কাছে এতই অপরিচিত ছিল যে বাঙালির প্রতিরােধসংগ্রামে সহযােগিতা দেওয়ার জন্য যখন আমাদের নির্দেশ দেওয়া হলাে, তখন একটি মানচিত্রও সংগ্রহ করতে পারিনি।) মানচিত্র থেকে এটি পরিষ্কারভাবে বােঝা গিয়েছিল যে শুভপুর
পৃষ্ঠা: ১৬৭
এলাকায় ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু রয়েছে। ভারত যেহেতু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতর বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল, তাই শক্তি বৃদ্ধি ও রসদ সরবরাহের কাজটি একমাত্র সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যমে করা সম্ভব ছিল এবং তারপর তা সড়কপথে ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে প্রেরণ করা সম্ভব ছিল। ‘সেতুটি বন্ধ করে দাও’—এমন একটি পরামর্শ সরকারের একজন আইসিএস কৌশলবিদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। তিনি ভেবেছিলেন যে সেতুটি বন্ধ করে দেওয়া হলে পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির কাছে অতিরিক্ত সেনা ও মজুত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে।
ইতিমধ্যে রাজগােপাল পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে একটি চমক্কার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে, মুক্তিবাহিনী অন্য কোনাে দেশ থেকে এ পর্যন্ত সামান্যই বাস্তব সহায়তা পেয়েছে, আর সে কারণে তারা আমাদের কাছ থেকে খুব বেশি সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশী। তাদের সব প্রত্যাশাই পূরণ করার মতাে, আর যদি তা করা হয়, অর্থাৎ তাতে যদি আমরা সাড়া দিই, তবে কোনাে কিছু পাওয়ার, অর্থাৎ ভবিষ্যতে তাদের আনুগত্য ও সদাচরণের প্রত্যাশা ব্যতিরেকেই করতে হবে। আমাদের ভাবনার দিক থেকে খুবই পরিষ্কার থাকতে হবে যে তারা আমাদের শরণাপন্ন হয়েছে এ জন্য নয় যে তাদের অন্তরে আমাদের প্রতি ভালােবাসা রয়েছে, অথবা আমাদের প্রতি তাদের নিশ্চিত আনুগত্যবােধ থেকেও নয়। তারা এসেছে শুধু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, জরুরি প্রয়ােজনে, যার কারণ শুধু একটি—তাঁদের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ঘৃণাবােধ।
৬ ও ৭ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে তাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার আলােচনায় মনে হয়েছিল, তিনি একটি আনুষ্ঠানিক প্রবাসী সরকার গঠন ও তার কার্যক্রম যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে আরম্ভ করার বিষয়ে চিন্তিত আছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর থেকে নির্বাচিত কিছু জনপ্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আমাদের সাহায্য চান। তিনি ধারণা করেন যে সম্প্রতি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রবাসী সরকার অধিক গ্রহণযােগ্যতা ও বৈধতা অর্জন করবে। তার এই চাহিদা যথাসময়ে পূরণ করা হয়।
আমরা অন্য নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করি এবং তাঁদের চলে আসার অনুরােধ জানাই। তাদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ময়মনসিংহ), কর্নেল এম এ জি ওসমানী (সিলেট), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (পাবনা), খন্দকার মােশতাক (কুমিল্লা) এবং কামারুজ্জামান (নােয়াখালী) [প্রকৃতপক্ষে রাজশাহী]। পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানী ধুবরি এলাকার কাছে তাঁর নৌকাঘর থেকে (বােট হাউস) যােগ দেন।
রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি-সংবলিত একটি সংক্ষিপ্ত সংবিধানের
পৃষ্ঠা: ১৬৮
খসড়া প্রস্তুত করেন কর্নেল এন এস বেইনস। এ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী এবং একটি কেবিনেটের ব্যবস্থা রাখা হয়। কর্নেল এন এস বেইনস ছিলেন। বিএসএফের আইন বিষয়ের কর্মকর্তা। সংবিধানটি যথারীতি কলকাতার ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরীকে দিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখিয়ে নেওয়া হয়। তারপর এটি তাজউদ্দীন ও তাঁর সহকর্মীদের দেওয়া হয়। তারা আলােচনা করে সামান্য কিছু সংশােধনীসহ এটির অনুমােদন দেন।
প্রথমেই যে বিষয়টি উত্থাপিত হয় তা হলাে, যুদ্ধজয়ের পর পূর্ব পাকিস্তানের নাম কী হবে। কেউ কেউ প্রস্তাব করেন পূর্ববঙ্গ’, কেউ কেউ বলেন, ‘বঙ্গভূমি’, অন্য কেউ কেউ বলেন নাম হবে কেবল বঙ্গ’, কেউ কেউ বলেন ‘স্বাধীন বাংলা’। পূর্ববঙ্গ নামটি প্রত্যাখ্যান করা হয় এ জন্য যে স্বাধীন দেশ হিসেবে এটি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জট পাকিয়ে ফেলতে পারে। বঙ্গভূমি’ নামটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, কারণ, বিদেশিদের পক্ষে এ নাম মনে রাখা কঠিন। বঙ্গ’ নামটি বাতিল করা হয় এ জন্য যে এটির উচ্চারণে বিকৃতির আশঙ্কা আছে। স্বাধীন বাংলা নামটি নেওয়া হয়নি এ কারণে যে স্বাধীন শব্দটি সময়ের আবর্তে এর প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে। তাজউদ্দীন প্রস্তাব করেন বাংলা দেশ’, কারণ, এ নামটি একদা মুজিব বলেছিলেন। এটা বলা হয় যে দেশটি হলাে ভাষাভিত্তিক—যে ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কিছু যুবক প্রাণ দিয়ে শহীদের মর্যাদা অর্জন করেছেন। অন্য সব নেতা এ নামটি গ্রহণে তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হন।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশা প্রণয়নের জন্য নেতারা অধিবেশনে বসেন, প্রথমে নিজেদের মধ্যে আর পরবর্তী সময়ে আমি ও গােলক তাঁদের সঙ্গে যােগ দিই। অনেক ধরনের পরিবর্তনের পর চূড়ান্ত আকার ঠিক হয়। একটি খসড়া নকশা তৈরি করা হয়, যেখানে পূর্ববঙ্গের চিরসবুজের প্রতীক হিসেবে সবুজ পটভূমি আর স্বাধীনতার উন্মেষ হিসেবে লাল সূর্য ব্যবহার করা হয়। তাঁদের মধ্যে অনেক আলােচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে গােলাকার লাল অংশে পূর্ব বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত হবে, যাতে জাপানের পতাকা থেকে এটি পৃথক করা যায় এবং যেকোনাে রকম বিভ্রান্তি বা অনিয়ম এড়ানাে যায়।
একই সভায় রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত বাছাই করা হয়। দুটি কবিতা বিবেচনা করা হয়। একটি হলাে দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা এবং অন্যটি হলাে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সােনার বাংলা’। সােনার বাংলা শব্দটিতে সােনালি পাট ও ধানের ছবি স্মৃতিতে চলে আসে—যা বাংলার অর্থনীতির প্রধান অংশ। প্রথম কবিতাটি জাতীয় সংগীত হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পক্ষে প্রবল যুক্তি থাকার পরও অনেক আলাপ-আলােচনার পর
পৃষ্ঠা: ১৬৯
সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে যেহেতু দ্বিতীয় গানটি মুজিব ভাইয়ের খুব প্রিয়, সেহেতু নতুন জাতির জন্য এটিই হবে জাতীয় সংগীত।
তাজউদ্দীন খুব করে চাইছিলেন যে আমি যাতে ব্যক্তিগতভাবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ভার নিই। আমি তাঁকে বােঝাতে সক্ষম হই যে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও। বাংলাদেশের মাটিতে এবং বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ও টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়া খুব জরুরি।
অনুষ্ঠানের জন্য আমি বাংলাদেশের দুটি স্থানের কথা ভেবেছিলাম। এর একটি ছিল রাজশাহীতে, অন্যটি চুয়াডাঙ্গার কাছে। যেহেতু দ্রুত ঘটনার পরিবর্তন হচ্ছিল এবং পাকিস্তানিরা বেসামরিক এলাকায় বােমাবর্ষণ ও আক্রমণ শুরু করেছিল, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলাের আশপাশের এলাকাও ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে যে রাজশাহীর কাছাকাছি অনুষ্ঠান করা হবে না।
স্থান বাছাইয়ের বিষয়ে আমি চিন্তায় ছিলাম। কারণ, বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলাে অনুষ্ঠানটিতে চোখ রাখবে। তাই দেশের ব্যাপকসংখ্যক মানুষ যেন দর্শক হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। আরও একটি বিষয় বিবেচনায় ছিল, পাকিস্তান বিমানবাহিনী নির্দয়ভাবে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের ওপর বিমান হামলা করত; সুতরাং স্থান বাছাইয়ের বেলায় সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হয়েছিল। এসব বিবেচনা করে ত্রিভুজ আকৃতির একটি ভূমি, যা ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী; চমৎকারভাবে আমবাগান দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি গ্রাম—যার আদি নাম হলাে বৈদ্যনাথতলা, নির্বাচন করা হয় (এ নামটি বদলিয়ে পরে মুজিবনগর করা হয়েছে)। নতুন জন্ম নিতে যাওয়া একটি জাতির প্রথম সরকার মানুষের তৈরি কার্পেট-মােড়ানাে সুসজ্জিত ও আলােকিত এবং ঝাড়বাতি লাগানাে ঘরের ছাদবিশিষ্ট দালানে অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এমন একটি জায়গায়, যেখানে আকাশ মাথার ওপর শামিয়ানার কাজ করেছে এবং এর সাজসজ্জায় ছিল গাছ। অনেক দশক বা শতাব্দী পর বাংলাদেশের নাগরিকেরা যখন তাদের দেশের জন্মলগ্নের দিকে তাকাবে, বিয়ােগান্ত পরিস্থিতির মধ্যে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা ভাববে, তখন তারা ন্যায়সংগতভাবেই এটা ভেবে গর্ববােধ করতে পারবে যে তাদের প্রথম সরকার যেখানে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের শপথ নিয়েছিল, সেখানে প্রকৃতি অকৃপণ হাতে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই অনুষ্ঠানটি শুধু অনবদ্যই ছিল না, বরং এর পরিকল্পনাই ছিল দুঃসাহসী এবং অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা ছিল সাহসী কাজ।
আমাদের জনসংযােগ কর্মকর্তা এস সি বসু যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলােকে আমন্ত্রণ জানান। এদের প্রায় সবাই পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরের ঘটনাবলি কাভার করার অভিপ্রায়ে কলকাতায় জড়াে
পৃষ্ঠা: ১৭০
হয়েছিল। ১৬ এপ্রিল, অর্থাৎ অনুষ্ঠানের আগের দিন রাতের শেষ প্রহরে তাদের নিমন্ত্রণ জানানাে হয়, যাতে করে খবরটি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে না পৌছায়। অনুষ্ঠান কোথায় হবে, সে খবর বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। বসু নিজে তাদের সেখানে নিয়ে যান।
কলকাতা শহরের নকশালদের দৃষ্টি এড়াতে বাংলাদেশ ও বিএসএফ কর্মকর্তারা ভাের চারটার আগেই কলকাতা ত্যাগ করেন। সেসময় নকশালদের কর্মকাণ্ড ছিল তুঙ্গে এবং রাস্তায় জনসাধারণ তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বােধ করতেন না। যাত্রা শুরুর সিগন্যাল দেবার আগমুহুর্তে মােটরযানগুলাে এক সারিতে দাঁড় করানাে হয়। আমি এক সেকেন্ডের জন্য শিহরিত হই—পুরাে সংকটের মধ্যে ওটাই ছিল একমাত্র সময়, যখন আমি নিজের সম্পর্কে একটু অনিশ্চিত ছিলাম। এই ধরনের শিহরণ জাগে যখন কেউ সত্যের মুখােমুখি এসে দাঁড়ায়—এ সত্যটি হলাে একটি জাতির জন্ম। উত্তেজনার জন্য শিহরণ হচ্ছিল, যার কারণ ছিল আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব, যার প্রভাব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বিশেষভাবে উপমহাদেশের জাতিগুলাের ওপর সুদূরপ্রসারী হবে।
নিজেকে সংশয়মুক্ত করার অভিপ্রায়ে আমি রাজগােপাল ও গােলককে নিয়ে আয়ােজনটি অবলােকন করলাম। সেখানে একটি মঞ্চ ছিল (ডায়াস), যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণ বসবেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের ব্যবস্থা হলাে। শপথ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য বিএসএফ কৃষ্ণনগর থেকে কিছু ভালাে গায়ক জোগাড় করে। মুক্তিফৌজের একটি বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করে, যদিও তারা খুব ভালাে ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল না, তবু তা ছিল চলনসই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ মােকাবিলা করার উদ্দেশ্যে শপথ অনুষ্ঠানের চারপাশে মুক্তিফৌজ অবস্থান গ্রহণ করে।
মূল অনুষ্ঠান আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়, প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে এ সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সদস্য ও টিভির চিত্রগ্রাহকেরা উপস্থিত থাকবেন। আমি সকাল সাড়ে আটটায় ঘটনাস্থল ত্যাগ করি এবং কলকাতায় ফিরে আসি। সেখানে রেখে এসেছিলাম গােলক ও রাজগােপালকে। আমি উদগ্রীব ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় অনুষ্ঠানের খবর জানার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমি জানতে পারি যে ৮২ জন ভারতীয় ও বিদেশি সাংবাদিক, ছবি সংগ্রাহক ও টিভি চিত্রগ্রাহক ১৮টি জিপ ও কার এবং দুটি বাসে করে ওই এলাকায় বেলা ১১টায় প্রবেশ করেন। অনুষ্ঠানের স্থানে প্রায় ১৫ হাজার লােক সমবেত হয়েছিল।
বাংলাদেশের পতাকা উন্মােচিত করা হয় এবং নতুন জাতীয় সংগীত প্রথমবারের মতাে গাওয়া হয়। গােলকের ভাষ্যমতে, এটি উপস্থিত সমগ্র
পৃষ্ঠা: ১৭১
জনতাকে বিদ্যুতায়িত করে ফেলে এবং তখন কারও চোখই শুষ্ক ছিল না। একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়। নেতৃবৃন্দ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কলকাতায় ফিরে আসেন।
আমার মতে, সফলভাবে শপথ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পেছনে ছিল সপ্তাহব্যাপী উদ্বেগপূর্ণ উদ্যোগ। এর চূড়ান্ত পরিণতি কী দাঁড়াবে, তা আমি কোনাে পর্যায়েই আগাম ধারণা করতে বা বলতে পারছিলাম না; কারণ, এর সঙ্গে জড়িত ছিল অনেক অজানা নিয়ামক আর কর্মকাণ্ড। আমি নিজ থেকেই বিষয়গুলাের প্রতি নজরদারি করছিলাম এবং যৌক্তিকভাবেই। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, যদি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী আক্রমণ করে, তাহলে প্রবাসে অবস্থিত সামনের সারির রাজনীতিবিদদের পুরাে দলই নিঃশেষ হয়ে যেত এবং এ জন্য সারা বিশ্ব এমনকি বাংলাদেশও আমাকে ক্ষমা করত না। কেননা, এই মানুষগুলােই ভারতের মাটি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়ােজনীয় ও কাক্ষিত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছিল।
প্রবাসী সরকার গঠন চূড়ান্ত হওয়ার পরও আমি অনুভব করলাম, পাকিস্তানের জন্য একটি প্রচণ্ড আঘাত হতে পারে, যদি কলকাতায় কর্মরত তাদের ডেপুটি হাইকমিশনারকে বাংলাদেশের পক্ষে আনা যায়। গােলক ও আমি হাঁটতে বের হলাম। ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা এটি করেই ছাড়ব। গােলক ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলীর সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা চালালেন, তিনি তাজউদ্দীনের দিক থেকে নিশ্চয়তা চাইলেন। তাঁকে তা দেওয়া হলাে। তাজউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর একটি সাক্ষাতেরও ব্যবস্থা করা হলাে। তারপর আমরা নিকটবর্তী এলাকার প্রতিটি বাসার ওপর নজর রাখছিলাম। অন্যদিকে কর্নেল মেঘা সিংয়ের বাহিনী সাক্ষাঙ্কার মিটিং এলাকার আশপাশে অবস্থান নিল। জাঁকালাে গেলর্ড রেস্টুরেন্টে আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে [হােসেন আলীর] দুটি সভা অনুষ্ঠিত হলাে। ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে তদস্থলে বাংলাদেশের পতাকা তােলা হলাে। ডেপুটি হাইকমিশনার নীরবে ও বিনা প্রতিরােধে পক্ষত্যাগ করলেন। এ ঘটনা অপরাপর দেশে বাঙালি কূটনীতিকদের পাকিস্তানের পক্ষত্যাগে অনুপ্রেরণা জোগাল এবং মুক্তির সংগ্রাম জোরদার হলাে।
ডেপুটি হাইকমিশনারের পক্ষত্যাগ সম্পর্কে গােলক মজুমদার যা বলেন তা হলাে [গােলক মজুমদারের সঙ্গে রাজগােপালের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে]:
কেবিনেটের [মুজিবনগর] শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা তৈরির সময়, বিএসএফের ডিজি আমাকে জানান যে কূটনৈতিক ফ্রন্টেও কিছু একটা করতে হবে এবং কলকাতাই হবে এ কাজটি আরম্ভ করার জন্য উপযুক্ত
পৃষ্ঠা: ১৭২
জায়গা। মি. রুস্তমজি যেকোনাে সময় প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করতে পারতেন। সত্যিকারভাবে সে সময় তিনি প্রতিদিনই তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। এ বিষয়ে তিনি যখন তাকে ফোন করলেন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বেশ ক্ষুব্ধ হলেন এবং উচ্চ স্বরে বললেন, যা আমি শুনতে পেলাম, এ ধরনের কাজ করার চেষ্টা করবেন না। সেখানে যদি বিন্দুমাত্র ভুলভ্রান্তি হয়, তাহলে আমার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া মুশকিল হবে।
আমি আমার কর্মকর্তাদের কাজে লাগিয়ে দিলাম। তারা হােসেন আলীর সঙ্গে কয়েকটি সভা করলেন। আমরা তাঁর মন নিয়ে খেলতে লাগলাম। তিনি তাজউদ্দীনের সঙ্গে বসতে চাইলেন এবং এটি নদীর তীরে গেলর্ড রেস্টুরেন্টে আয়ােজন করা হলাে। আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হয়েছিল যেন পাকিস্তানি গােয়েন্দারা এর গন্ধ না পায়। আমরা তাকে এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের জন্য শক্তিশালী কমান্ডাে নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলাম। তাঁর সব ধরনের অসুবিধা ও সন্দেহ উতরানাে গেল। আমরা বাংলাদেশের একটি পতাকা তৈরি করালাম এবং তা প্রস্তুত রাখলাম। আমরা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ লেখা একটি সাইনবাের্ডও তৈরি করলাম।
দিন হিসেবে রােববার ১৮ এপ্রিল ১৯৭১-কে নির্ধারণ করা হলাে। আমি সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে ডেপুটি হাইকমিশনার অফিসের সামনে কোর্তা ও পাজামা পরে রাস্তার পাশে মুচির দোকানে এমনভাবে বসে। ছিলাম যে মনে হচ্ছিল আমি জুতা ঠিক করছি। বিএসএফের ডিজি, রাজগােপাল ও মেজর জেনারেল নারিন্দার সিং তিনবার সেই রাস্তা অতিক্রম করলেন কিন্তু আমাকে চিনতে পারলেন না। পরে আমাকে বলা হয় যে ডিজি পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনাস্থলে আমাকে না দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। একজন আমার কাছে এসে বললেন যে আমি যেন এক্ষুনি তাঁর সঙ্গে কথা বলি। আমি তাকে ফিরে যেতে বললাম ও তাঁকে (ডিজিকে) জানাতে বললাম যে আমি তাকে ও অন্যদের তিনবার এ পথ ধরে যেতে দেখেছি, যদিও তারা আমাকে লক্ষ করেননি।
এর মধ্যে আমার অফিসাররা ফিরে এসে জানালেন, ডেপুটি হাইকমিশনারকে বিচলিত দেখাচ্ছে এবং তিনি ইতস্তত করছেন। আমাদের এত আয়ােজন এবং তাজউদ্দীন ও আমাদের নিশ্চয়তা দেওয়ার পরও শেষ মুহুর্তে যদি তিনি পিছিয়ে যান, তবে চরম বিপর্যয় ঘটবে। আমি আমার কর্মকর্তাকে গিয়ে বললাম, তাঁকে জানান যে যদি আরও
পৃষ্ঠা: ১৭৩
কালক্ষেপণ করা হয়, তবে তার ফলাফল হবে বিপর্যয়কারী। সময় যত পেরােচ্ছিল আইএসআইয়ের এজেন্ট অথবা ইউএস কনস্যুলেটের গন্ধ পেয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছিল।
সৌভাগ্যক্রমে, রােববারের ওই সকালে, ১০টায়, ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলা হলাে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ডেপুটি হাইকমিশন অফিসের একজন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিলেন। আমাদের লােকেরা সাইনবাের্ড নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন এবং দ্রুত পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের অফিস’-সংবলিত সাইনবাের্ড সরিয়ে, ডেপুটি হাইকমিশন অফিস, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সাইনবাের্ড লাগিয়ে দিল। অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে প্রচুর লােকের সমাগম হলাে; আর সবাই আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়তে লাগল। খবরের কাগজের লােকেরা দলে দলে আসা শুরু করলেন। আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা খবরটি প্রবলভাবে ছড়িয়ে দিলেন আর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেন। প্রধানমন্ত্রীকে জানানাের পর, আমরা কাজটি করতে পেরেছি দেখে তিনি আশ্চর্যান্বিত হন—তাঁর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ লক্ষ করা যায়।
এ ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানের চ্যান্সেরি পরিত্যাগ করায় উৎসাহিত করে এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারকে মর্যাদা ও নীরব স্বীকৃতি এনে দেয়। জলস্রোতের মতাে কূটনীতিক ও কর্মকর্তারা কলকাতায় আসতে থাকেন আর বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়কে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসেন।
ভারতীয় নাগরিক না হওয়ার কারণে তাজউদ্দীনকে স্টেটব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় (এসবিআই) হিসাব খােলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমি নতুন দিল্লি গিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের সচিব অর্ধেনু বকশীর সঙ্গে দেখা করি। পরে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নরের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলােচনার পর যাবতীয় অসুবিধা দূর হয়। ডেপুটি হাইকমিশনারের তহবিল থেকে তিন কোটি টাকা, যা কিনা কলকাতার একটি আমেরিকান ব্যাংকে ছিল, তা শনিবার ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ উত্তোলন করা হয়; এই দিনটি ছিল পক্ষত্যাগের আগের দিন। শনিবার বলে আমেরিকার এজেন্ট আগেই ব্যাংক থেকে চলে গিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর এসবিআই ব্যাংকের চৌরঙ্গী শাখায় ‘ডেপুটি হাইকমিশনার বাংলাদেশ’-এর নামে হিসাব খুলে এ টাকা জমা দেওয়া হয়। মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশের ট্রেজারি ও সাব ট্রেজারি থেকে যে অর্থ নিয়ে এসেছিলেন, তা-ও ওই হিসাবে জমা রাখা হতাে। সিলেট, চট্টগ্রাম, নােয়াখালী ও অন্যান্য জেলার বাঙালি, যারা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভালাে অবস্থায় ছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায়
পৃষ্ঠা: ১৭৪
অর্থ প্রেরণের আগ্রহ দেখাতেন। এই ব্যাংক হিসাব খােলার দরুন তাঁদের রেমিট্যান্স পাঠানােতে সুবিধা হয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ আমার ও বিএসএফ তখন যে ভূমিকা পালন করছিল, তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘খসরু, আপনি কি অনুভব করতে পারছেন, বিএসএফ যে কাজ করছে, তা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে? আপনি যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, তাতে করে আমরা সহজেই কিছুদিনের মধ্যে অনেক বড় ঘটনার মধ্যে পড়ে যাব এবং এটা এমন ঘটনা হবে, যা আমাদের জন্য ভালাে কিছু হবে না।’
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যান্টনমেন্টগুলাে দখলে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা অতিরিক্ত বাহিনী সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ইপিআরের ছেড়ে যাওয়া কিছু সীমান্তচৌকি দখল করে নেয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মােকাবিলার জন্য বিএসএফের সামর্থ্য ও সম্পদ ছিল সীমিত। এ অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে এবং ৩০ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকার অপারেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর ১৬ দিন পর আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত এলাকার ভার সেনাবাহিনী নেয়। বিএসএফ সেনাবাহিনীর অপারেশনের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। শুরু হয় ‘অপারেশন জ্যাকপট’।
অনুবাদ : মােহাম্মদ আবদুর রশীদ।
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান