You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | পূর্বাঞ্চলে সামরিক পরাজয়ের কারণসমূহ | লে. জেনারেল কামাল মতিনউদ্দিন - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্বাঞ্চলে সামরিক পরাজয়ের কারণসমূহ
লে. জেনারেল কামাল মতিনউদ্দিন

কামাল মতিনউদ্দিন ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান। তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে তিনি গবেষক হিসেবে স্বীকৃত। কামাল মতিনউদ্দিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৯৯৪ সালে ট্র্যাজেডি অব এরােরইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস (ওয়াজিদালিজ প্রাইভেট লিমিটেড, লাহাের) নামে একটি বই লেখেন। এ বই লিখতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শতাধিক সংশ্লিষ্ট ও পণ্ডিত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এসব সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করেই তিনি তাঁর এই গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের যে কারণসমূহ উল্লেখ করেছেন, তার অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলাে।
১৯৭১ সালের শীতকালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের ফলাফল একপ্রকার পূর্বনির্ধারিত ছিল। স্থলসেনার সংখ্যা ভারতেরই বেশি ছিল, আকাশপথের কর্তৃত্বও কয়েক দিন যুদ্ধের পর তাদের হাতে চলে যায়, স্থানীয় অধিবাসীদের প্রায় সবাই তাদের পক্ষাবলম্বন করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখ ফিরিয়ে নেয়—এমতাবস্থায় যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর বিচলিত হওয়ার কোনাে কারণ ছিল না। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে পৃথিবীর কোনাে সেনাবাহিনীর পক্ষেই ভারতের বাড়া ভাতে, অর্থাৎ পাকিস্তান ভাঙার কাজে ছাই দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ প্রসঙ্গে জেনারেল অরােরা মন্তব্য করেছিলেন, এমনকি নেপােলিয়নের পক্ষেও হার এড়ানাে সম্ভব ছিল না।
তবে এটাও সত্য, সামরিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে আরেকটু মুনশিয়ানার পরিচয় দিলে জাতিকে হয়তাে ১৬ ডিসেম্বরের এই বিয়ােগান্ত পরিণতি বরণ করতে হতাে না। কথা হচ্ছে, ভারতীয় আক্রমণের পর এত দ্রুত এই সামরিক ব্যর্থতার কারণ কী?
পৃষ্ঠা: ১৩১

অভিযানের পরিবেশন
ভারত বিস্তারিত পরিকল্পনা করে তার সব জাতীয় উপাদানকে কাজে লাগিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জয়ের ভিত রচনা করে। অন্যদিকে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর লেলিয়ে দিয়ে বহির্বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তির কারণে লাভবান হয়, তারা সােভিয়েত বন্ধুদের কাছ থেকে ট্যাংক, বিমান ও আরও নানা সরঞ্জাম পায়। এতে তাদের স্থানীয় পর্যায়ের অস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সামরিক পর্যায়ে ভারত এমনিতেই এক কদম এগিয়ে ছিল, ১৯৭১-এর শেষের দিকে এ অবস্থা আরও সংহত হয়। তারা মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করে, প্রশিক্ষণ দেয়। মুক্তিবাহিনীকে রণসাজে সাজিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে গুঁড়িয়ে দেয় তারা। ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা তখন পুরাে জাতিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছিলেন, একই সঙ্গে তাঁরা বিদেশে নিজেদের মিত্র ও সমব্যথী খুঁজছিলেন। ওদিকে ওদের সৈন্যরা তখন পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য গোঁফে তা দিচ্ছিল। তখন ছিল শীতকাল, পর্বতের উপত্যকাগুলাে আর কিছুদিনের মধ্যে শ্বেতশুভ্র তুষারে ভরে যাবে। নভেম্বরের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী পুরাে অপারেশনের ছক কষে ফেলেন।
কৌশলী প্রচারণার ফলে তিনি পুরাে ভারতবাসীর সমর্থন লাভ করেন, চীন ও হােয়াইট হাউসকে কোণঠাসা করে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলাের সমর্থনও তিনি আদায় করেন। (কংগ্রেস ও মিডিয়া তাঁর পক্ষে অবস্থান নেয়)। তাঁর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ফলে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সেনারা তাদের মনােবল হারিয়ে ফেলে।
অন্যদিকে ভুল পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে পাকিস্তান ক্রমশ একা হয়ে যায়। পশ্চিম থেকে অস্ত্র আসা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ এবং অনিয়ন্ত্রিত ও অবাধ যৌনাচারের কারণে আমাদের সেনারা ভেতর থেকে ক্ষয়ে যায়।
বাঙালিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তথাকথিত গণহত্যা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রচার পায়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসসহ আইন। প্রয়ােগকারী সংস্থাগুলাের বিদ্রোহ তাদের দুর্বল করে ফেলে। যে শক্তি নিয়ে আমাদের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল, তাতে তাদের কাছে কোনাে ভারী অস্ত্র ছিল না। কেউ কেউ এই বৈরিতা শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে
পৃষ্ঠা: ১৩২

এখানে আসেন। কমান্ডাররা ভারতীয় আগ্রাসনের কিছুদিন আগে হ্রাসকৃত শক্তির বাহিনীগুলাের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সৈন্যদের বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাসের কারণে অনেকেই যুদ্ধ শুরুর সময় খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। সৈন্যরাও ধন্দে পড়ে যায়—কার বিরুদ্ধে কী কারণে এই যুদ্ধ। যে মানুষদের রক্ষা করতে তারা এখানে আসে, তারাই শত্রুদের সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে হাত মেলায়। ফলে জাতীয় সেনাবাহিনী থেকে তারা রাতারাতি দখলদার বাহিনীতে পরিণত হয়।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার মতাে সৈন্য আমাদের হাতে। ছিল না, বিশেষত যখন পূর্ব পাকিস্তান চারদিক থেকে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। দুই হাজার কিলােমিটারের সীমান্তকে কয়েক গুণ শক্তিধর শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে বিপুলসংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করা প্রয়ােজন। ছিল। ফরমেশন, ইউনিট ও উপ-ইউনিটগুলাে তাদের ক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি এলাকা পাহারা দিচ্ছিল। শত্রুরা শুধু কোনাে একটা ফাঁক গলে ঢুকে পড়ার অপেক্ষায় ছিল। তিনটি আলাদা দিক থেকে পাঁচটি প্রধান পথ ভাইটাল গ্রাউন্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু] দিকে চলে গেছে, সেখানে তিনটি পদাতিক ডিভিশনের সমপরিমাণ সৈন্য প্রতিরক্ষায় ছিল। অথচ প্রতিটি প্রধান পথ ধরে একটি করে পূর্ণ শক্তির পদাতিক ডিভিশন থাকা উচিত ছিল। এতে সংরক্ষিত সৈন্যও রাখা যেত, প্রতিরক্ষায় আরও গভীরতা আসত। এ ছাড়া রণাঙ্গন কমান্ডারের হাতে একটি সংরক্ষিত ডিভিশনও রাখতে হতাে। শেষ মুহূর্তে দুটি অ্যাডহক (অস্থায়ী] ডিভিশনকে ময়দানে নামানাে হয়, এর সঙ্গে কিছু যুদ্ধরত ইউনিট জুড়ে দেওয়া হয়। এর জন্য বিদ্যমান বিন্যাসকে কাটাছেড়াও করা হয়। কিন্তু তাতে কোনােভাবেই পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রতিরক্ষার শক্তিবৃদ্ধি ঘটেনি। কোনাে প্রকার সংরক্ষিত বাহিনীর অভাবে আসলে আমরা আরও দুর্বল হয়ে পড়ি। কারণ, এটা নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে একটি মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি করে।
যথাযথ ফিল্ড ও মিডিয়াম কামান না থাকায় পদাতিক ডিভিশনগুলাে সামরিক শক্তিতে দুর্বল ছিল। মাত্র এক রেজিমেন্ট ট্যাংক পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানাে হয়েছিল, অথচ প্রয়ােজন ছিল কমপক্ষে তিন রেজিমেন্টের। বিমানবাহিনীর সহায়তার অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। ভারতের ছােট ছােট জাহাজের দলগুলােকে চ্যালেঞ্জ জানানাের মতাে কোনাে পাকিস্তানি জাহাজও বঙ্গোপসাগরে ছিল না। আসলে সব আবহাওয়ায় চলার মতাে রাস্তা না থাকা আর অপ্রতুল অভ্যন্তরীণ নৌযানের কারণে আমাদের চলাচলই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
পৃষ্ঠা: ১৩৩

জাতীয় কৌশল
১৯৭১ সালে সামরিক নেতৃত্ব এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হয়, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরাজয় বরণ করা আর সামরিকভাবে নিগৃহীত হওয়া ছাড়া কোনাে উপায়ান্তর ছিল না। ভৌগােলিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এর পূর্বাংশের কী কী পার্থক্য ছিল, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা খুব একটা মাথা ঘামাননি। তদুপরি যুদ্ধে ভারতের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সম্পর্কেও খুব একটা চিন্তাভাবনা তারা করেননি। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলাের মনােভাব সম্পর্কে ভুল ধারণা করা হয়েছিল বা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
সামরিক আমলাতন্ত্র লুকানাে শত্রুদের বিষয়ে তেমন একটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না, তাঁরা যে আমাদের একদল দুষ্কৃতকারী হিসেবে গণ্য করছিলেন, সেটা বুঝতেও অনেক সময় লেগে যায়। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড, জিএইচকিউ, সিএমএলএ সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে সব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখার সম্ভাবনা সম্পর্কেও অতিরঞ্জিত মূল্যায়ন করেছে। পাকিস্তানের কোনাে উধ্বর্তন সেনা কর্মকর্তার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এই সত্যটা উচ্চারণ করেননি যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘১০ ফুট লম্বা ছিল না। অন্য সব সেনাবাহিনীর মতােই জাতীয় স্বার্থ অক্ষুন্ন, অর্থাৎ এর ভূখণ্ডকে রক্ষা করতে যথাযথ পরিবেশ প্রয়ােজন, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকেই—বিশেষত জাতীয় ক্ষমতাকাঠামাের সব উপাদানই যখন ব্যর্থ হয়েছে।

রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা
এসব দুর্বলতা সত্ত্বেও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে যেন বাংলাদেশ সরকার গঠন করতে দেওয়া না হয়। বিরাজমান ভূকৌশলগত পরিবেশে এ নির্দেশনা ছিল হঠকারী। তা বাস্তবায়ন করাও সম্ভব ছিল না, ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। [ হঠকারী ছিল এই অর্থে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে সামরিক নীতি গ্রহণ করতে হয়, তা শত্রুর অপকার না করে উপকারই করেছিল। ভারত চেয়েছিল, সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ছত্রখান করতে। মুক্তিবাহিনী ও বিএসএফের প্রতিটি ঢিলে যেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাল্টা ঢিল ছােড়ে। আমাদের সৈন্যরা মারা
পৃষ্ঠা: ১৩৪

পড়ছিল, এতে ভারতের সেনাপ্রধানের সুবিধাই হয়। সৈন্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে, ফলে বিশাল এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক নির্দেশনা বাস্তবায়নের কারণে নিয়াজি তার দুই পাশ ও পেছন উদোম করে দিতে বাধ্য হন, আর অরােরা এর পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করেন।
সামরিকতন্ত্র একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েছিল, তারা ভেবেছিল ভারত শুধু মুক্তিবাহিনীকে সহযােগিতা করার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে। এতে হয়তাে সীমান্তসংলগ্ন কিছু এলাকা স্বাধীন হবে, যেখানে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘােষণা দেবে। জেনারেল ইয়াহিয়া হামুদুর রহমান কমিশনের (এইচআরসি) কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেন, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা কস্মিনকালেও ভাবেননি যে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ করবে। অথচ ১৯৭১ সালের আগস্টে আমাদের সেনা গােয়েন্দারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের নকশা গােপনে বাগাতে সক্ষম হয়েছিল, তারপরও ভারতের আক্রমণসম্পর্কিত কোনাে ভাবনাই তাদের মাথায় আসেনি।
শত্রুসেনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে রাজনৈতিক নির্দেশনার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা সম্পর্কে কোনাে আভাসই ছিল না।

সামরিক নীতি
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেই সামরিক নীতি গৃহীত হয়। সে কারণেই বাইরের আক্রমণ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষায় নিরাপত্তা জোরদার না করে বিদ্রোহ দমনে অগ্রাধিকার দেওয়ায় নিয়াজিকে দোষ দেওয়া যায় না। এই দুটো চাহিদা ছিল পরস্পরবিরােধী। প্রথমােক্তটির জন্য প্রয়ােজন ছিল সব সম্ভাব্য পথে সৈন্য সমাবেশ ঘটানাে, সৈন্যদের জড়াে করে কৌশলগত গভীরতা অর্জন সাপেক্ষে প্রাথমিক অনুপ্রবেশ ঠেকানাে, পাল্টা আক্রমণ চালানাের জন্য সংরক্ষিত সৈন্য রাখা, গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােতে পূর্ব থেকেই সৈন্য সমাবেশ ও সর্বোপরি নিজেদের জনগণের সার্বিক সহযােগিতা। কিন্তু এই জনগণই আমাদের ছত্রখান করে দিয়েছে। ঝােপঝাড় থেকে আচমকা গুলিবর্ষণ করে তারা আমাদের দৌড়ের ওপর রাখে। এতে সারা দেশটাই কার্যত একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফরমেশন, ইউনিট ও উপ-ইউনিটকে ভেঙে ফেলা হয় (কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে বিওপি রক্ষার জন্য প্লাটুন ও সেকশনকেও ভাঙা হয়)। সাধারণ নাগরিকদের ওপর বলপ্রয়ােগ করায় তারাও তিক্ত হয়ে ওঠে।
ভারতীয় নেতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ সময়ের ব্যাপার হয়ে ওঠার পরও
পৃষ্ঠা: ১৩৫

পাকিস্তানের সেনা কর্তৃপক্ষ মূল পরিকল্পনা আঁকড়ে থেকে সেই বৃহৎ ভুলের একই বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। হামুদুর রহমান কমিশনে যেসব বিবৃতি ধারণ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী জিএইচকিউ থেকে পরিষ্কার ধারণা (পরিষ্কার আদেশ নয়) দেওয়া হয়, ভূখণ্ড এখন আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, চিফ অব জেনারেল স্টাফ ও ভাইস চিফ অব। জেনারেল স্টাফ পূর্বাঞ্চলে তাদের শেষ সফরের সময় সৈন্য পুনর্বিন্যাসের পরামর্শ দেয় (নির্দেশ নয়)।
সত্য যা-ই হােক, সামরিক নীতির দ্রুত পরিবর্তন সাপেক্ষে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জেনারেল নিয়াজির উচিত ছিল সব সৈন্যকে একত্র করে আসন্ন ভারতীয় হামলার বিরুদ্ধে নিজেদের প্রস্তুত করা।
অপারেশনের কৌশল একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে আগে থেকেই একটা যুদ্ধংদেহী ভাব নিতে হয়, কিন্তু তা সামরিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে নয়। শক্তিশালী প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে বেশির ভাগ সৈন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অর্থাৎ ঢাকার নিরাপত্তায় মােতায়েন করা উচিত ছিল। ঢাকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্রের সম্মুখসারির সেনাদের শত্রুপক্ষকে দুর্বল করার কাজে ব্যবহার করা যেত। নিজেদের সুবিধামতাে স্থান, যেমন নির্ধারিত দুর্গ ও শক্তিশালী অবস্থানগুলােতে পেছনমুখী অভিযানের (সংগঠিত পশ্চাদপসরণ)অনুমােদন দেওয়া উচিত ছিল।
অনেক বেশি অতিরঞ্জিত যুদ্ধংদেহী নেওয়ার কারণে যুদ্ধ শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে নিয়াজির কৌশলগত ভরকেন্দ্র বিনষ্ট হয়। শত্রুপক্ষ অগ্রসরমাণ সৈন্যদের পাশ কাটাতে সক্ষম হয়, তারা প্রতিরক্ষাবলয়ের পেছন থেকে ঢুকে পড়ে। এতে আমাদের সেনারা উল্টোমুখে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়। ফলে পরাজয় ত্বরান্বিত হয়।

অপারেশনের ধারণা
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তর থেকে জিএইচকিউতে ১৯৭১-এর জুলাইয়ে যে যুদ্ধংদেহী অভিযানের পরিকল্পনা পেশ করা হয়, তা শুধু গৃহীতই হয় না, এর সঙ্গে আরও কিছু আক্রমণাত্মক পরিকল্পনার ছক জুড়ে দেওয়া হয়। ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাব্যবস্থা থেকে কতটা দূরে অবস্থান করছিলেন, তা এই অবস্থা থেকেই বােঝা যায়।
পৃষ্ঠা: ১৩৬

দুর্গ ও শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখার পরিকল্পনা স্বতন্ত্রভাবে ভুল ছিল। তবে বিষয়টা হচ্ছে যে এই কৌশলের ওপর ভিত্তি করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেসব পূর্বশর্ত দরকার, তার অভাব ছিল। একটি আদর্শ দুর্গ বা দুর্গশহর প্রতিরক্ষা নির্ভর করে নিরাপত্তামূলক অবস্থানের নিম্নোক্ত বিষয়গুলাের ওপর :১. এটা প্রাথমিকভাবে শক্তিশালী হবে, ২. মাইন পুঁতে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ও শক্তিশালী বাংকার খুঁড়ে এর সুরক্ষা শক্তিশালী করা হবে, ৩. এগুলাে হবে পারস্পরিক সহযােগিতামূলক, ৪. খালি জায়গাগুলােতে নিয়মিত টহল দেওয়া হবে, ৫. বেসামরিক জনগণ শত্রুভাবাপন্ন হবে না, যাতে এসব টহলরত অগ্রগামী সেনা অ্যামবুশ ছাড়াই ফেরত আসতে পারে।
এসব কোনাে কিছুই না থাকায় প্রাথমিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিশ্চিতভাবে মুখ থুবড়ে পড়ারই কথা। এটাই বিশেষ ডি ব্রিফিং কমিটির চেয়ারম্যান। হিসেবে লে. কর্নেল আফতাব আহমেদ খান উল্লেখ করেছেন, “পুরাে অপারেশনের পরিবেশটাই বেসুরাে হয়ে গিয়েছিল। যখনই পরিষ্কার হয়ে যায় যে ভারত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ (নভেম্বরের শেষ দিকে তা প্রায় পরিষ্কার হয়ে যায়) শুরু করতে যাচ্ছে; তখনই মূল পরিকল্পনাটি সংশােধন করা উচিত ছিল এবং আরও নিবিড় প্রতিরক্ষা গড়ে তােলা উচিত ছিল, বিশেষ করে ঢাকাকে ঘিরে, যেহেতু এটি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ছিল। অরক্ষণীয় ভূখণ্ড আর কৌশলগত গুরুত্বহীন জায়গাগুলােতে শক্তিশালী প্রতিরক্ষার প্রয়ােজন ছিল না।

অরক্ষিত ঢাকা
পরিস্থিতি যা-ই হােক, সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ঢাকাকে অরক্ষিত রাখা। ঢাকা ছিল সবকিছুর কেন্দ্র, রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। পূর্ব পাকিস্তানের। সামরিকতন্ত্রের রাজধানী। ঘরের ভেতরের বা বাইরের যেকোনাে শত্রুরও প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ঢাকা। একজন কমান্ডার কীভাবে ঢাকাকে অরক্ষিত অবস্থায় রাখতে পারেন? এই বিষয়ে তাঁকে স্পষ্ট নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল, যেকোনাে মূল্যে ঢাকাকে রক্ষা করতে হবে। জিএইচকিউ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে এ মর্মে অপারেশন নির্দেশনা দিয়েছিল।’
নিয়াজির অজুহাত ছিল, তাঁকে নাকি বলা হয়েছিল যে আটটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন সরবরাহ করা হবে, যাদের তিনি ঢাকার সুরক্ষায় আলাদা করে রাখবেন। এ কথা ধােপে টেকে না। এইচআরসিতে ধারণকৃত সব সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ‘জিএইচকিউ থেকে এ মর্মে কোনাে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের
পৃষ্ঠা: ১৩৭

সিদ্দিকি ১৯৭১-এর নভেম্বর মাসে রাওয়ালপিন্ডিতে অপারেশনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা পেশ করতে এসেছিলেন। তিনিও সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে জিএইচকিউ থেকে আটটি অতিরিক্ত ইউনিটের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তারা যা-ই বলুন না কেন, ভারতীয় আক্রমণ নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর নিয়াজির উচিত ছিল কৌশলগতভাবে অগুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে তাদের ঢাকা ও এর আশপাশে মােতায়েন করা।
শত্রুর অভিলাষ সম্পর্কে ভুল ধারণা দুর্ভাগ্যজনকভাবে জিএইচকিউ বা পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কেউই ভারতীয়দের অভিসন্ধি সম্পর্কে সঠিক আন্দাজ করতে পারেননি। তারা ক্রমাগত একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েছিলেন, নয়াদিল্লি হয়তাে মুক্তিবাহিনীকে কিছু সহায়তা করবে, খুব বেশি হলে, তারা হয়তাে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় কিছু জায়গা দখল করে আওয়ামী লীগের নেতাদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠনে সহায়তা দেবে। এমনকি ২১ নভেম্বরের পরও জিএইচকিউ ভেবেছিল, ভারতীয় বাহিনী এখনাে আক্রমণে যায়নি, মুক্তিবাহিনী সীমান্ত এলাকায় কিছু যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, ভারতীয়রা হয়তাে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। এ-ও ভাবা হয়েছিল যে তারা ভেতরের কোনাে বড় শহরের দিকে এগােবে না, ঢাকার দিকে তাে অসম্ভব।
নিঃসন্দেহে ভারতীয়দের লক্ষ্য ছিল নদীগুলাের তীর পর্যন্ত পৌঁছানাে। ঢাকা দখল তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না, এটা তাদের মনের গহিনে ছিল।
নিয়াজি ভেবেছিলেন, পশ্চিমে যশাের ও পূর্বে সিলেট ও কুমিল্লায় তাঁর যে ফরমেশন ছিল, এগুলাে প্রয়ােজনবােধে ঢাকার সঙ্গে মিলিত হবে—তার এ ধারণা ছিল একেবারেই অবাস্তব। এ অঞ্চলগুলাে থেকে ঢাকায় আসার পথে অনেকগুলাে নদী ছিল, অন্যদিকে আকাশপথে শত্রুরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। মুক্তিবাহিনী আরও ভেতরের দিকে একপ্রকার স্বাধীনভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ধ্বংসপ্রায় একটি ব্যাটালিয়ন ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়, তা-ও যখন খেলা প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
ঢাকা পতনের আগে যে ২৬ হাজার ২৫০ জন সৈন্য নিয়াজির কমান্ডে ছিল, তারা কেউই যােদ্ধা ছিল না। এদের মধ্যে ছিল সিগন্যালম্যান, রক্ষণাবেক্ষণকারী, গাড়িচালক, সরবরাহকারী সেনা, ডাক্তার ও দাপ্তরিক আরদালি। এরূপ বিক্ষিপ্ত সেনাদলের পক্ষে মুক্তিবাহিনীকেই ঠেকানাে সম্ভব ছিল না; ভারতীয় বাহিনী, যারা ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার দরজায় কড়া নাড়ছিল, তাে অনেক দূরের বিষয়।
পৃষ্ঠা: ১৩৮

জেনারেল নিয়াজিকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ না করায় জিএইচকিউকে অবশ্যই আংশিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। তবে নিয়াজিকেই তাঁর ভুলে ভরা পরিকল্পনার দায়ভার নিতে হবে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলাে অরক্ষিত থেকে গিয়েছিল। যাতে তার প্যান্ট খুলে না যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য, প্রয়ােজনের সময় মূল পরিকল্পনা তাঁর পক্ষে সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি।

সৈন্য মােতায়েন
শত্রুপক্ষের অভিসন্ধি সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সেক্টরকে একপ্রকার অরক্ষিত রাখা হয়, যদিও সেখানে যেতে শত্রুপক্ষের কোনাে বড় বাধা পেরােনাের প্রয়ােজন ছিল না। ভারতীয়রাও এটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। যদিও শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে এই পথ অনুসরণকারী সৈন্যরাই প্রথমে ঢাকার বাইরে মিরপুর সেতুতে পৌছে গেছে।
ঢাকা যাওয়ার সংক্ষিপ্ততম পথ ছিল পূর্ব দিক থেকে। ভারতীয় শহর আগরতলা থেকে রাজধানী ঢাকা ছিল মাত্র ৪৮ কিলােমিটারের পথ। ভারতীয় চতুর্থ কোর ছিল আক্রমণাত্মক বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। প্রতিপক্ষের দুটি ডিভিশনের বিপরীতে এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল তিনটি ডিভিশন। শত্রুর বড় ধাক্কা আসার সম্ভাবনা ছিল পূর্ব দিক থেকেই। জিএইচকিউর তৎকালীন সামরিক গােয়েন্দা পরিচালক দাবি করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান পরিকল্পনা তারা হস্তগত করেছিলেন। নিশ্চয়ই তা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দপ্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। এটিকে বিবেচনায় রেখে নিয়াজির উচিত ছিল তার মূল প্রতিরক্ষা উদ্যোগ কুমিল্লা সেক্টরে নিয়ােগ করা। দুর্ভাগ্যবশত ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা আর প্রতিপক্ষের সবচেয়ে। শক্তিশালী কোরের মাঝখানে একটিমাত্র অস্থায়ী ডিভিশন নিযুক্ত করা হয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১৪ ডিভিশন বা ৩৯ (অস্থায়ী) ডিভিশন কারােরই প্রাথমিক আক্রমণ ঠেকানাে বা তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার কৌশলকে প্রতিহত করার শক্তি ছিল না। শত্রু যদি প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে সম্মুখ থেকে শক্তি দিয়ে হটিয়ে দেয় বা তা পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তবে বিশেষ কোনাে প্রতিরােধ ছাড়াই তারা চাঁদপুর, দাউদকান্দি ও ভৈরববাজার পৌছে যাবে। এর ফলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই শত্রুসৈন্যরা ঢাকার কাছাকাছি চলে আসবে।
পৃষ্ঠা: ১৩৯

সংরক্ষিত সৈন্য
একজন অধিনায়ক তখনই লড়াইয়ের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারেন, যখন তাঁর হাতে পর্যাপ্ত রিজার্ভ সৈন্য থাকে এবং তা ব্যুহভেদ ঠেকাতে বা গুরুত্বপূর্ণ কোনাে স্থান পুনর্দখল করতে ব্যবহার করতে পারে। স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি জমি দখলে রাখার নীতির কারণে, না কোর অধিনায়ক, না তার ডিভিশন বা ব্রিগেডের অধিনায়কেরা কেউ রিজার্ভ সৈন্য বহাল রাখতে পেরেছিল। অস্থায়ী ডিভিশন তৈরি করে মূল যুদ্ধে যােগ দেওয়ার আগেই জেনারেল নিয়াজি তার যা কিছু রিজার্ভ সৈন্য ছিল, তা ব্যবহার করে ফেলেছিলেন। ডিভিশনাল বা বাহিনী পর্যায়ে রিজার্ভ সৈন্য না থাকার ফলে নরসিংদীতে কোনাে প্রতিরােধ ছাড়াই অবাধে ১৮ ঘণ্টা ধরে হেলিকপ্টার থেকে শত্রুসৈন্য নামানাে সম্ভব হয়। ঢাকার আশপাশে যদি পর্যাপ্ত রিজার্ভ সৈন্য থাকত, তাহলে টাঙ্গাইলে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেওয়া প্যারা ট্রুপকে সফলভাবে ঠেকানাে যেত।

বিদ্রোহ দমন
যেহেতু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতায়। আসতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং আন্দোলন থামাতে নির্বিচারে শক্তি প্রয়ােগ করছিল, ফলে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান গােপন বিদ্রোহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উন্মুক্ত বিদ্রোহের রূপ নেয়। যদিও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড জুনের মাঝামাঝিতে সরকারের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় এবং সব সীমান্তচৌকি আবারও নিজেদের হাতে চলে আসে। তবু আট মাস ধরে বিদ্রোহ দমন অভিযানে ব্যাপক শক্তিক্ষয় হয়। উপর্যুপরিভাবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে সৈনিকদের নিযুক্ত করার কারণে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারা লড়াইয়ের প্রবৃত্তি হারিয়ে ফেলছিল। কারণ, এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে এটা একটা নিষ্ফলা যুদ্ধ, যা নিজের দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন দূরবর্তী এক ভূমিতে নিজেদের নাগরিকদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছে।

পরাজয়
শত্রুকে সহায়তাকারী বাহিনী যদি পশ্চাভাগে ব্যাপক আকারে ধ্বংসাত্মক কাজ চালায়, তবে সবচেয়ে সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীও পরাজয়
পৃষ্ঠা: ১৪০

বরণ করে। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গেরিলা বাহিনী মােকাবিলা করা ছাড়াও বেশ বড় আকারের প্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীকে মােকাবিলা করতে হয়েছিল, যাদের নখদর্পণে ছিল এলাকার সব পথঘাট। কারণ, তারা তাদের নিজেদের এলাকায় থেকেই অভিযান চালাচ্ছিল। সমগ্র জনগণ সেনাবাহিনীর বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। বস্তুত তারা শত্রুবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায়। এক লাখের ওপর মুক্তিবাহিনী ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবাই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা করতে ব্যাকুল ছিল। তারা মাইনের মধ্যকার ফাঁকফোকরের তথ্য খুঁজে বের করে শত্রুকে জানিয়ে দিত, পানির প্রতিবন্ধকতাগুলাে পার হতে সহায়তা করত এবং জলাশয় পার হওয়ার সময় সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও ভারী যান ঠেলে নিতে সাহায্য করত। তারা অস্ত্রশস্ত্রের ভান্ডার উড়িয়ে দিত, ব্রিজ ধ্বংস করে দিত, স্থানীয় নৌকাগুলাে জ্বালিয়ে দিত, সেনাবহরে গুপ্ত হামলা চালাত, সামরিক তথ্যাদি পাচার করত, পাকিস্তানপন্থীদের হত্যা করত, নিরপেক্ষদের হুমকি দিত এবং শত্রু’সীমারেখার পেছনে ভারতীয় প্যারা ট্রুপারদের নামতে সাহায্য করত।

যুদ্ধ পরিচালনায়
যুদ্ধ পরিচালনার কৌশলে নিয়াজি আনাড়ি ছিলেন না। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে বার্মা ও আফ্রিকায় যুদ্ধে জয়-পরাজয় দেখেছেন। ১৯৪৮ সালে কাশ্মীর যুদ্ধে ইউনিট এবং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ফরমেশনের অধিনায়কত্ব করেছেন। তবে তাঁর দূরদর্শিতা পদাতিক ইউনিটের অধিনায়কের মতােই রয়ে গিয়েছিল, যার কাজ হচ্ছে যুদ্ধ করা এবং জীবন দেওয়া—কোনাে প্রশ্ন করা নয়। এটা ছাড়া ২৭ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সৈন্যদের দেওয়া নির্দেশকে অন্য কোনােভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, আর তা ছিল যে উপরস্থ দুই সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত সৈন্যরা পিছু হটতে পারবে না। এর ফলে তারা ৭৫ শতাংশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
সীমান্ত থেকে পিছু না হটার ধারণা নিয়ে নিয়াজি আচ্ছন্ন ছিলেন। চৌকি ও প্রতিরক্ষা এলাকায় নিয়ােজিত কোম্পানি ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের এই ধরনের সাহসিকতা দেখাতে হয়। এর ওপরে সে উঠতে পারেনি। বড় সেনাদল পরিচালনার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত লক্ষ্যকে মাথায় রেখে অভিযানকৌশল পরিচালনা করতে হয়। স্থান-কাল, পশ্চাৎমুখী চলাচলে ব্যাপক পানিসংক্রান্ত বাধার প্রভাব, নভেম্বরের পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা বিদ্রোহ, আকাশে প্রতিকূল অবস্থা ইত্যাদি বিষয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড বিবেচনায় নেয়নি।
পৃষ্ঠা: ১৪১

খুব বেশি দেরি হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা সেনাদলকে পিছু না হটতে পীড়াপীড়ি করেছিল।
শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষে একটা ফরমেশন বা ইউনিটের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য হারানাে গেলে সে আর কর্মক্ষম থাকে না। সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাকে শত্রু থেকে বিচ্ছিন্ন করে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য নতুনভাবে সরবরাহ ও জনবল দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু নিয়াজি তার ডিভিশনের অধিনায়কদের আদেশ দিয়েছিলেন যে তারা সম্মুখের অবস্থান থেকে এক কদমও পেছনে ফিরে আসবে না, এমনকি কোম্পানিগুলােও তাদের অবস্থানে অনড় থাকবে।

উচ্চপদস্থ সদর দপ্তরের ভূমিকা
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনার ওপর জিএইচকিউ কোনাে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি। মনে হয়েছে, যুদ্ধ শুরুর দিনেই তারা হাল ছেড়ে দিয়েছিল অথবা আসন্ন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বন্ধুদেশগুলাের হস্তক্ষেপের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছিল। বস্তুত পূর্ব কমান্ড ছিল একটি স্বাধীন যুদ্ধক্ষেত্র। স্থানীয় অধিনায়কের ওপর বিস্তারিত অভিযানের ভার ছেড়ে দেওয়ারই কথা। পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানাে যাচ্ছিল না। বস্তুগত কোনাে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, যদিও এটা পাকিস্তানেরই অংশ ছিল। তাই বলে এই অংশ এমনি এমনি শত্রুদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। নিয়াজির লাগাম টেনে ধরে তার সৈন্যদের ঢাকার আশপাশে একত্র করার নির্দেশ দেওয়ার তখনাে সুযােগ ছিল।

আদেশ ও নিয়ন্ত্রণ
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিএইচকিউর মিলিটারি অপারেশনস কক্ষে বসে হাজার মাইল দূরে ঘটে যাওয়া যুদ্ধের খবরাখবর নিচ্ছিলেন, যার ওপর তার। কোনাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আবার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ও সিএমএলএর সদর দপ্তরের মধ্যে যােগাযােগ ভেঙে পড়েছিল। কারণ, সংকটময় মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট, তিন বাহিনীপ্রধান ও প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারকে প্রায়ই পাওয়া যেত না। সেনাপ্রধান ও তার চিফ অব জেনারেল স্টাফের (সিজিএস] মধ্যে কথাবার্তা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। আবার সিজিএসের সঙ্গে জিএইচকিউর অন্য পিএসওদের সম্পর্কও যে খুব একটা ভালাে ছিল, তা নয়। দেশের
পৃষ্ঠা: ১৪২

অখণ্ডতা যখন হুমকির মুখে, তখন সর্বোচ্চ সামরিক সদর দপ্তরে এমন পরিবেশ বজায় থাকা অমার্জনীয়।
পূর্ব পাকিস্তানে ফ্রন্টের বিস্তৃতি এত বেশি ছিল যে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে, উপরন্তু বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ড ও উচ্চপর্যায়ে নেতৃত্বের দুর্বলতার ফলে প্রথম দিনেই যুদ্ধ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমাদের ইউনিটগুলাে কোম্পানি ও প্লাটুনে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মতাে করে যুদ্ধ করার ফলে তাদের কাছ থেকে খুব বেশি প্রতিরােধ আশা করা সম্ভব ছিল না। ফ্রন্টের ব্যাপক বিস্ততির কারণে অনেক ফরমেশন ও ইউনিট অধিনায়ক যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। জেনারেল নিয়াজি ডিসেম্বরের ৪ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে অধীন সদর দপ্তরগুলাে সফর করতেও সমর্থ হননি।
পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বিপর্যয় বিষয়ে গঠিত বিশেষ ডি-ব্রিফিং কমিটি রিপাের্টের সভাপতি এই সিদ্ধান্তে পৌছান যে জেনারেল নিয়াজি পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করতে পারেননি, বরং তিনি মুখ থুবড়ে পড়েন এবং মানসিকভাবে বিহ্বল হয়ে যান।

সমন্বয়ের অভাব
জেনারেল ইয়াহিয়া একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধানের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার ফলে তিনি ও তাঁর অনুচরেরা রাজনৈতিক এবং নিত্যকার সামরিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গলদঘর্ম হতে থাকেন।
তিনটি ভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাছে সিদ্ধান্ত পৌঁছাত : প্রেসিডেন্টের সচিবালয়, সিএমএলএ সদর দপ্তর ও জিএইচকিউ। প্রায়ই এমন হতাে যে সদর দপ্তরসমূহ পরস্পরের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অবগত থাকত না। চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল গুল হাসান জানতেন না। যে সিএমএলএ সদর দপ্তর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে ১৪ ডিসেম্বর অস্ত্রসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলাে, অস্ত্রসমর্পণের সব বার্তা খােলাখুলি পাঠানাে হয়েছিল, যা সহজেই ভারতীয়রা মাঝপথে ইন্টারসেপ্ট করে ফেলে।
হামুদুর রহমান কমিশনের প্রদত্ত অভিযােগের সঙ্গে আমি একমত যে সন্দেহাতীতভাবেই এই ব্যর্থতাগুলাের দায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাঁধে বর্তালেও জিএইচকিউও এই দায় এড়াতে পারে না; কারণ, এ পরিকল্পনার অনুমােদন তারাই দিয়েছিল।
পৃষ্ঠা: ১৪৩

মনােবল
জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের সভা স্থগিত ঘােষণা করার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সেনাদের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ২৬ মার্চ তাদের লেলিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত, পূর্বাঞ্চলের সেনারা ঘেরাও, সড়ক অবরােধ, অপমান ও বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে ব্যারাকে আটকা পড়ে থাকে। এরপর পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে নিরন্তর লড়াই চলেছে। যদিও সেনাবাহিনী এ সময় প্রাধান্য বিস্তার করেছিল কিন্তু এর বিনিময়ে তাদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাদের সরঞ্জামাদি ধ্বংস হয়েছে, আর দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের মানুষকে হত্যার কারণে তাদের মনােবলও ভেঙে পড়েছে।
নভেম্বর মাসে মূল লড়াই শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আট মাস ধরে পাকিস্তানি সেনারা এক পলায়নপর শত্রুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গেছে। তত দিনে তারা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তারা যখন বুঝল যে স্থানীয় জনতা তাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে, তখন তাদের মনােবল আরও ভেঙে যায়। দিনের পর দিন গত হয়েছে অথচ তারা কোনাে বিশ্রাম পায়নি, আবার নতুন করে সেনাও আসেনি। গেরিলাদের তৎপরতার কারণে বিভিন্ন ইউনিট ও ফরমেশনের মধ্যে যখন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে, তখন তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও কৌশলগতভাবে ঘেরাও হওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। বিচারপতি হামুদুর রহমানের ভাষায়, ৭ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মনােবল হারিয়ে ফেলেন।

বিমান সহযােগিতার অভাব
আধুনিক সময়ে বিমানশক্তিই মূলত যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে দেয়। এমনকি যে পক্ষ স্থানীয় পর্যায়ে বিমানশক্তিতে এগিয়ে থাকে, তারা স্থলসেনা, রসদ ও সরবরাহব্যবস্থা এবং নেতৃত্ব প্রদানের সদর দপ্তরের এমনই ক্ষতি করতে পারে যে পরবর্তী সামরিক অভিযান পরিচালনা কঠিন হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে বিমানশক্তির পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। ভারতের সঙ্গে পশ্চিম প্রান্তে যুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন দিনের মাথায় ভারত পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একমাত্র স্কোয়াড্রনটিকে অকার্যকর। করে ফেলে।
পৃষ্ঠা: ১৪৪

নৌ অবরোধ
লাহােরে ‘গঙ্গা’ [ভারতীয় বেসামরিক বিমান যা কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হাইজ্যাক করে লাহাের নিয়ে যায়] কাণ্ডের পর ইন্দিরা গান্ধী যখন ভারতীয় ভূমির ওপর দিয়ে আকাশপথ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানে রসদ সরবরাহের একমাত্র পথ ছিল ঘােরানাে পথে শ্রীলঙ্কা হয়ে (বিমানে যাওয়া অথবা সমুদ্রপথে যাওয়া। অন্যদিকে চূড়ান্ত দিবস ঘনিয়ে আসার আগে দিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নৌ অবরােধ দেয়, ফলে পশ্চিমের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যােগাযােগের একমাত্র পথও বন্ধ হয়ে যায়।
এতে যে শুধু সামরিক রসদ ও অস্ত্র-গােলাবারুদের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তা নয়, সৈনিকদের মনােবলেও ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে। কারণ, তারা। বুঝতে শুরু করে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগবিচ্ছিন্ন হয়ে তারা কার্যত পূর্ব পাকিস্তানে আটকা পড়ে গেছে। সব দিক থেকে ভারতের দ্বারা আবদ্ধ। থাকায়, বার্মা ছাড়া তাদের সহায়তাপ্রাপ্তির একমাত্র জায়গা ছিল সমুদ্র, কিন্তু সেটাও নৌ অবরােধের কারণে বন্ধ হয়ে গেল।

যুদ্ধক্ষেত্রে কৃতিত্ব
বিশেষ ডি-ব্রিফিং কমিটি তাদের উপসংহারে উল্লেখ করে যে একটি ডিভিশন ছাড়া বাকিরা খুব খারাপ যুদ্ধ করেছে। ১০টি ব্রিগেডের মধ্যে ছয়টি দুর্বল নৈপুণ্যের প্রমাণ দেয়। ২৮টি ব্যাটালিয়ন যুদ্ধে সরাসরি যােগ দেয়, যার মধ্যে ১৫টির মান ছিল বাজে।
পূর্ব পাকিস্তানে সেনারা যে পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল, তাতে ইউনিট ও উপ-ইউনিট পর্যায়ে তাদের কৃতিত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশংসনীয় ছিল। যেসব ইউনিট সাহসী অধিনায়কের অধীনে ছিল, তারা। ভালােই করেছিল। আর যেখানে অদেশ ও নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়েছিল, সেখানে তাদের কৃতিত্ব প্রশংসনীয় ছিল না। তারা শত্রুপক্ষের সামনে যথেষ্ট বাধা। হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তার মূল কারণ হলাে যে ভারতীয়রা মুক্তিবাহিনীর সহযােগিতায় পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান এড়িয়ে যেতে পেরেছিল। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের কিছু ইউনিটকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, আর কিছু ইউনিটকে পূর্বনির্ধারিত শক্ত ঘাঁটিতে যেতে দেয়নি।
যশাের ছাড়া আর কোনাে শহর সহজে হাতছাড়া হয়নি। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড যখন আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়, তখন পূর্ব পাকিস্তানের বাকি সব
পৃষ্ঠা: ১৪৫

শহর পাকিস্তানি সেনাদের অধীনে। ঢাকায় যদি আরও সেনা পাঠানাে যেত, তাহলে এই যুদ্ধ আরও কিছুদিন চালানাে সম্ভব হতাে। এতে জাতিসংঘে যারা পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন, তাঁরা যুদ্ধবিরতি বা আরও কম অসম্মানজনক কিছু করার সুযােগ পেতেন।
অনুবাদ : প্রতীক বর্ধন

Reference:

১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান