You dont have javascript enabled! Please enable it!

খােদ আসামী প্রেসিডেন্ট নিক্সন

আমেরিকা আরও অস্ত্র পাঠাচ্ছে পাকিস্তানে। এগুলাে ব্যবহৃত হবে বাংলাদেশের মারণযজ্ঞে। বিবেক বলে। কোন পদার্থ নেই মার্কিন কর্তদের। মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ঢাকতে চেয়েছিলেন তারা নিজেদের অপরাধ। গত কদিন ধরে প্রচার চলছিল, যত নষ্টের গােড়া আমলাতন্ত্র। ওরাই অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী। মার্কিন নীতি নির্ধারকরা নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণের উপর। তার ফাক ফোকর দিয়ে অস্ত্র যাচ্ছে পাকিস্তানে। এই ছে’দো প্রলাপ একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আসল রহস্য বেরিয়ে পড়েছে। খােদ আসামী আমলাতন্ত্র নন, প্রেসিডেন্ট নিকসন নিজে। তিনি খারিজ করেছেন আমলাতন্ত্রের পরামর্শ। ব্যক্তিগত দায়িত্বে অস্ত্র জোগাচ্ছেন ইয়াহিয়া খানকে। অজুহাত পুরানাে পাকিস্তানকে অস্ত্র না দিলে দেশটা চলে যাবে চীনের খপ্পরে। চীনের খপ্পর থেকে পাক-জঙ্গীশাহীকে বাঁচাবার জন্য প্রেসিডেন্ট নিকসন ডেকে আনছেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সর্বনাশ। হাতে হাড়ি ভেঙ্গেছেন শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণ। ওয়াশিংটনে তিনি দেখা করেছিলেন মার্কিন কর্তাদের সঙ্গে। তারা বলেছিলেন, বাংলাদেশের সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসলামাবাদের একটা বােঝাপড়া দরকার। কাজের বেলায় দেখা যাচ্ছে অন্যরকম। বােঝাপড়ার বদলে বাংলাদেশকে সাবার করার মদৎ দিচ্ছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারের আমলে নিকসন ছিলেন ডাইস-প্রেসিডেন্ট। তিনি তখন রিপাের্ট দিয়েছিলেন, জোট নিরপেক্ষ ভারতকে বিশ্বাস নেই। পাকিস্তানই সত্যিকারের বন্ধু। তাকেই দেওয়া উচিত, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সাহায্য। তারপর দুনিয়ার চেহারা অনেক বদলিয়েছে। পদে পদে পড়েছে মার্কিন মূল্যায়নের ভুল ভ্রান্তি। প্রেসিডেন্ট নিকসন শিখেন নি কিছু। সাবেকী মন নিয়ে তিনি ধরে আছেন মার্কিন প্রশাসন তরীর হাল।
নয়াদিল্লী রাগে ফেটে পড়ছেন। ভারতীয় জনমত উত্তাল। কিসিঙ্গারের স্বস্তিবচনে জনতার উল্ম বাড়ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং দিশাহারা। বড় আশা নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকায়। অগাধ বিশ্বাস ছিল তার মার্কিন রাষ্ট্রনায়কদের উপর। শেষ পর্যন্ত তার কপালে জুটল বিশ্বাসঘাতকতা। যা বলছিল তা করল না আমেরিকা। ভারতে আগত শরণার্থীদের জন্য ওয়াশিংটন দেবেন টাকা। আর ইয়াহিয়ার শরণার্থী তৈরীর যন্ত্রে তারা ঢালবেন অঢেল তেল। এই মার্কিন দ্বৈতনীতি বর্তমান দুনিয়ার নিদারূণ অভিশাপ। ইসলামাবাদের নরপশুদের অকৃত্রিম দোস্ত প্রেসিডেন্ট নিকসনই নাকি স্বাধীন বিশ্বের জিম্মাদার এবং গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। দক্ষিণ ভিয়েনামের জন্য তিনি চান স্বায়ত্তশাসন এবং বাঁচার অধিকার। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর বিধানইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর ক্রীতদাসত্ব কিম্বা সর্বত্মক সংহার। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী হৈ-চৈ করে বেড়াচ্ছেন। তাতে লাভ নেই কিছু। পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন কর্তাদের গােপন আঁতাত দীর্ঘদিনের। ওরা কিছুতেই ছাড়বেন না আশ্রিত খুনীদের। এমন আশ্রিত বাৎসলের কাছে বিবেকের বিলাস প্রত্যাশা অর্থহীন।
এখন কি করবেন নয়াদিল্লীঃ ইয়াহিয়ার উপর পড়বে না সত্যিকারের কোন আন্তর্জাতিক চাপ। বেঁকে দাঁড়িয়েছেন আমেরিকা। মার্কিন জনমত তাকে সিধে করতে পারবে কিনা সন্দেহ। সােভিয়েট রাশিয়ার অবস্থা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। অন্য যারা চেচামেচী করছেন তাদের প্রভাব সীমিত। আরব দুনিয়ার ধর্মবােধ বড় বেশী জাগ্রত। তাদের দৃষ্টিতে ইয়াহিয়া ঐশ্লামিক ঐক্যের ধ্বজাধারী। বাংলাদেশের হিন্দুরা কাফের এবং মুসলমানরা ধর্মচ্যুত। পাইকারী হারে তাদের নিধন কিম্বা বিতাড়নে কোন দোষ নেই। ইয়াহিয়া যদি মুসলমান না হয়ে ইহুদী, খৃষ্টান কিম্বা হিন্দু হতেন তবে হয়ত আরব নেতাদের টনক নড়ত। আগুনে তাতান বালুর উপর ধান দিলে এগুলাে যেমন ফটফট করে ফুটে ঠিক তেমনি তারা ফুটতেন। নাসেরের মিশর ছিল প্রগতিবাদী বলে পরিচিত। এখন সেখানে কায়েম হয়েছেন প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত। তিনি দোস্তী করেছেন পাকসুহৃদ সৌদী আরবের সঙ্গে। ১৯৬৭ সালের খার্তুম চুক্তি অনুযায়ী মিশর পাচ্ছে সৌদীর খয়রাতি টাকা। এখন আরও এগিয়ে গিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সাদাত। নাসের বলতেন, আরব দুনিয়ার ঐক্যের ভিত্তি সাধারণতন্ত্র এবং সমাজবাদ। আর সাদাতের মতে, আরবের শক্তির উৎস ধর্ম। সৌদী আরবের বাদশা ফয়জল মহা খুশী। তিনি মিশরকে দেবেন ইস্রাইল বিরােধী মদৎ। বিনিময়ে সাদাত জোরদার করবেন ফয়জলের ঐশ্লামিক ঐক্য অভিযান। কিসের আশায় সময় কাটাচ্ছেন নয়াদিল্লী? দুনিয়ায় বিবেক বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। যা আছে তা শুধু সঙ্কীর্ণ আত্মস্বার্থ। ভাল কথার যুগ শেষ হয়েছে। বর্তমান যুগটা শক্তির যুগ। যার বাহুতে আছে বল এবং মনে আছে সঙ্কল্পের দৃঢ়তা তাকেই সেলাম জানাবে দুনিয়া। নিজের পায়ে দাঁড়ান নয়াদিল্লী। স্বীকৃতি দিন স্বাধীন বাংলাদেশকে। দুর্বার করে তুলুন মুক্তিফৌজের সংগ্রাম। এ পথেই আসবে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ জুলাই ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!