You dont have javascript enabled! Please enable it! 1948.06.01 | পাকিস্তানী গোয়েন্দা নথিতে বঙ্গবন্ধু | পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের থেকে প্রায় ৮ কোটি টাকার রাজস্ব চলে যায় পশ্চিম বাংলার জমিদারদের কাছে – শেখ মুজিব - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের থেকে প্রায় ৮ কোটি টাকার রাজস্ব চলে যায় পশ্চিম বাংলার জমিদারদের কাছে – শেখ মুজিব

১ জুন ১৯৪৮ সালের গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা যায় মুসলিম লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দল ১-৬-১৯৪৮ তারিখে নরসিংদীর ঈদগাহ ময়দানে সাম্প্রতিককালে দেশের অবস্থা নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ শেখ মুজিবুর রহমান , মওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য নেতারা সভায় ভাষন প্রদান করেন৷ শেখ মুজিবুর রহমান জমিদার প্রথা বাতিল, দরিদ্র জনগনের কর, শিক্ষা, দুর্নীতি, অধস্তন অফিসারদের নিম্ন বেতন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বক্তৃতা দেন৷ কোন ধরনের ক্ষতিপূরন ছাড়া জমিদারী প্রথা বাতিলের উপর শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে জোর দেন৷ তার বর্ননায় হিন্দু কিংবা মুসলিমসহ সকল জমিদার যারা কলকাতা বা অন্যান্য বড় শহরে বসবাস করে যেখানে পূর্বপাকিস্তানের কৃষকদের থেকে প্রায় ৮কোটি টাকার রাজস্ব চলে যায় পশ্চিম বাংলার জমিদারদের কাছে যারা এই অর্থ ব্যয় করে থাকে৷ তার দাবি, তাহলে কারা এই রাষ্ট্রের শত্রু? এই জমিদাররা না যারা এই রাজস্ব প্রদান করেছে? তিনি আরো যোগ করলেন যে ট্যাক্স, বিক্রয় কর এবং অন্যান্য কর আদায় করা হয় গরীবদের কাছ থেকে অপরদিকে ধনীরা তা কখনোই আদায় করেনা৷ তার জিজ্ঞাসা ছিল, কোথায় পাওয়া যাবে এসবের ন্যায়বিচার? জনগন সকল ধরনের কর আদায় করতে প্রস্তুত কিন্তু তাদের খাদ্য, বস্ত্র এবং শিক্ষাসহ জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুও দরকার৷ কোন প্রকার বিলম্ব ছাড়াই সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের বিলোপ সাধন করা করা উচিত কারন এটি সকল প্রকার ক্ষতিই বয়ে নিয়ে আসছে৷ আর যারা নিম্নবেতনভূক্ত পুলিশ বাহিনী রয়েছে তারা বাধ্য হন ঘুষ নিতে৷ আর তাই উচ্চ বেতনভূক্ত কর্মকর্তাদের বেতন কমিয়ে এসব নিম্ন বেতনভূক্ত অফিসারদের বেতন বাড়ানো উচিত৷ এই নীতিই দূর্নীতি রোধ করতে পারে৷ বর্তমানকালের নেতৃবৃন্দ চায় না যে অধিকাংশ লোক শিক্ষিত হোক যাতে তাদের নেতৃত্ব সংকটাপন্ন হয়ে পড়ুক৷ কারনটা সুস্পষ্ট৷ উদাহরনস্বরুপ তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঘটনা উদ্ধৃত করলেন যারা গত সাতমাস ধরে বেতন পাচ্ছে না৷ যেখানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ যথাসময়ে বেতন গ্রহনে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে না৷ তিনি দাবি করেন যে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত৷ এবং জনগনকে মুসলিম লীগের সদস্য হতে আহ্বান করলেন৷

এর আগে আনুষ্ঠানিক সভার শুরুতে নারায়নগঞ্জ মুসলিম লীগের সেক্রেটারী আলমাস আলী উপস্থিত সকলকে মওলানা আব্দুল হামিদ খান MLA এবং শেখ মুজিবুর রহমান এর পরিচয় প্রদান করেন এবং বলেন যে মওলানা সাহেব তাদের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান অর্জন পরবর্তী দেশ যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করবেন৷ জমিদার প্রথা বাতিল সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন:

“এটা মুসলিম লীগের গত সাধারন সভার অন্যতম অঙ্গীকার যে কোন ধরনের ক্ষতিপূরন ছাড়াই জমিদারী প্রথা বাতিল হতে হবে৷ আমাদের নেতৃবৃন্দ এবং আমরা এটা সাধারন গ্রামীবাসীর কাছে প্রচার করেছি কিন্তু এটা কার্যে পরিণত হওয়া অনেক দূর৷ আমাদের কৃষকরা ভিটাহারা এবং খাবার এবং পোশাকহীন জীবন যাপন করছে৷ তারা না খেয়ে মারা যাচ্ছে৷ তাদের জন্য খাবার এবং চিকিৎসার কোনই ব্যবস্থা নাই৷ শুধুমাত্র জমিদার প্রথাই তাদের এত দু:খ দুর্দশার জন্য দায়ী৷ যদিনা এটা বাতিল হয় তাহলে দেশে কোন শান্তি কিংবা শান্তিপূর্ন অবস্থা এবং উন্নতিই হবে না৷ যখন কৃষকরা অত্যধিক ট্যাক্স এর ভারে ন্যূব্জ , তখন সরকার জমিদারদের ৬০ কোটি রুপী ক্ষতিপূরন দিতে যাচ্ছে৷ যা মারাত্মক প্রভাব বয়ে আনবে গরীব জনগনের জীবন ধারনে৷ জনগন তাদের জীবন উৎসর্গ করলো এবং আমরা তাদের মৃত্যু মেনে নিতে পারিনা৷ আমরা জমিদারী প্রথা বাতিলের জন্য ফাসিকাষ্ঠে যেতে প্রস্তুত হচ্ছি৷ আমরা এটার বাতিলের জন্য খুব শীঘ্রই এক আন্দোলন শুরু করবো৷

মুসলিম লীগের পূন:সংগঠনকে সমালোচনা করে তিনি বলেন কথিত নেতৃবৃন্দ দ্বারা এডহক কমিটি গঠিত হচ্ছে৷ মুসলিম লীগকে কিছু লোকের একটি পকেট সংগঠন তৈরির পায়তারা চলছে৷ আমাদের “জেহাদ” এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করতে ছাত্রসহ সকল মুসলমানকে মুসলিম লীগের সদস্য হতে হবে যারা একাই পাকিস্তানকে শক্তিশালী ও সম্পদশালী এবং জনগনের উন্নতি নিয়ে আসতে পারে৷ সবশেষে তিনি বললেন সামনে আরেকটি দূর্ভিক্ষ দেখা যাচ্ছে এবং তিনি উপস্থিতবৃন্দের কাছে আহ্বান জানালেন তারা যেনো না খেয়ে মরার চেয়ে গুলি খেয়ে মরতে প্রতিজ্ঞা করে৷ তিনি আবারো বললেন যে তারা জনগনকে শিয়াল কুকুরের মত মরতে দিবে না৷ তিনি আরো যোগ করেন, আমরা জেহাদ করবো, গুলির মুখোমুখি হবো এবং প্রয়োজন হলে মরবো৷

আনুষ্ঠানিক ভাবে মওলানা আব্দুল বারীর কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সভা শুরু হয় বিকেল ৫:০৭ এ৷
তারপর সামসুর রহমান একটি গান গেয়ে ওঠেন:
“সব মুসলিম দেশের লাগী মোদের নিশান ওঠাও
জনগনের হাতে হাত মিলায়ে আপনা দাবি জানাও৷”

এরপর নরসিংদীর মুসলিম লীগের সেক্রেটারী মতিউর রহমান বক্তব্য দিলেন যাতে তিনি বললেন মওলানা আকরাম খানের মাধ্যমে যে কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে তাতে সেসব লোকেরাই আছে যারা মুসলিম লীগের প্রকাশ্যে বিরোধী ছিল এবং ত্যাগী লোকজন যারা পাকিস্তান অর্জনে ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের কমিটিগুলোতে কোন স্থান দেয়া হয়নি৷ প্রত্যেক ইউনিয়নে কমপক্ষে পাচ হাজার জনবল ছিল কিন্ত প্রতি ইউনিয়নে শুধুমাত্র একশো সদস্যকে তালিকাভূক্ত করে স্বীকৃতির জন্য প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছে৷ [1, pp. 24–34]

নোট
এডভোকেট মৌলভি আব্দুল বারী

এডভোকেট মৌলভি আব্দুল বারী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে ৫৮ সাল পর্যন্ত ৪ টার্ম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন সাথে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন প্রথম কয়েক টার্ম। তিনি ভাষা সংগ্রামের সময় আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। ৪৮ থেকে ৫১ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার বরাত দিয়ে লেখা হয় “জনৈক আবদুল বারী বাংলার জন্য আরবি হরফ গ্রহণের সুপারিশ করে সেই সঙ্গে বলেন: ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।” তার নবীনগর থানায় আরও ২ জন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন আলী আহম্মদ এবং আব্দুর রহমান। ৫৪ সালের নির্বাচনে এই তিন কেন্দ্রীয় নেতার কেউ নমিনেশন পাননি। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন আইউব আমলে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হলে আব্দুল বারী আওয়ামী লীগে ছিলেন না। তিনি এবং রফিকুল হোসেন এনডিএফ এ থেকে যান। ৭০ এর নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নীতির ও দলের বাইরেই শুধু নয় তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন এবং নির্বাচনে হেরে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। রফিকুল হোসেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। বয়োবৃদ্ধ বারী এ সময় রাজনীতি বা মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে ছিলেন। যতটুকু জানা যায় তিনি ৫৮ সালের পরে কোন ভাবেই আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত ছিলেন না। ৫৮ এর পর আওয়ামী লীগ করেছে এমন প্রমান নাই। প্রতিষ্ঠাকালে আওয়ামী লীগে ৫ কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন এই মহকুমায়। পরে ৬ জন হন। সাচ্চু ছাড়া কেউ আওয়ামী লিগার হিসাবে ফিনিশিং টাচ করতে পারেননি। রাজাকার শীর্ষ নেতা হিসেবে এই থানায় ৪ জন কেন্দ্রিয় নেতা ছিল। ৭০ সালে এ এলাকা থেকে নবাগত প্রার্থী ছিল। তার এক ছেলে (রফিকুল বারী) পাকিস্তান আর্মি অফিসার (তৎকালীন মেজর) ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পশ্চিম পাকিস্তান আর্মির কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানেই থেকে যান। যুদ্ধ শেষ হলেও তারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকেন এবং ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাকিস্তানেই চাকরী করেন। পরে ৭৩ সালের শেষ দিকে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দেশে ফেরত এসে পুনরায় চাকরী পেয়ে যান এবং এরশাদ আমলে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতিসহ তার চাকরীজীবন শেষ হয়।

সূত্র – মাসিক মোহাম্মদী, ১৩৫৬, ২১, ৬
ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য; আবদুল মতিন, আহমদ রফিক, p. 71 , ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক
আটচল্লিশ থেকে একান্ন ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব
National Assembly Elections in Pakistan 1970-2008
Bangladesh Documents 1971, A.S.M Shamsul Arefin, Part IV, p. 238 Bengali officers who all served Pakistan Army and joined Bangladesh Army after liberation (26 March to 16 December 1971)

References:
[1] S. Hasina, Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol I 1948-1950. Hakkany Publisher’s, 2018.