পূর্ববঙ্গে প্রয়ােজন স্বাভাবিক অবস্থা, শরণার্থীদের ফেরার বিশ্বাস্য ব্যবস্থা
এদেশে রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রতিনিধি রাখা চলবে না – থান্টের প্রতি ভারত
বিশেষ সংবাদদাতা। নয়াদিল্লি, ২ আগস্ট-রাষ্ট্রপুঞ্জের সেকরেটারি জেনারেল উ থানট ভারত ও পাকিস্তানের কাছে গত ২০ জুলাই যে স্মারকলিপি পাঠিয়ে ছিলেন ভারত তার জবাবে একটি বার্তা পাঠিয়েছে এবং সেটি আজ নিউইয়কে যথাস্থানে পৌঁছেছে। ঘনভাবে টাইপ করা চার পৃষ্ঠায় ওই পত্রটির ভাষা বেশ একটু কড়া ।
পত্রে ভারত সেক্রেটারি জেনারেল মহােদয়কে সবিনয়ে কিন্তু সুস্পষ্টভাবে বলেছে যে, বাংলাদেশের মূল সমস্যাটি ধামাচাপা বা ঘুলিয়ে তােলার প্রয়াস ত্যাগ করে সেখানে রাজনৈতিক সমাধানের উপযােগী স্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করা দরকার। আর দরকার সত্তর লক্ষ শরণার্থী যাতে ফিরে যেতে পারেন তার উপযুক্ত একটা বিশ্বাস্য ব্যবস্থা করা। | ভারত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের পথে প্রতিবন্ধকতা করছে-এই ইঙ্গিতের বিরুদ্ধে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করা হয়েছে এবং প্রভূত তথ্য সহযােগে প্রমাণ করা হয়েছে যে, শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার বাধা ভারত নয়-পাক জঙ্গীশাহীর বর্বরতা। আর রাষ্ট্রপুঞ্জে শরণার্থী হাইকমিশনের কোন প্রতিনিধিকে ভারতে মােতায়েনের প্রস্তাব-সরাসরি অগ্রাহ্য করা হয়েছে। | ভারত বলেছে : বাংলাদেশ সমস্যার মূল কথাটা হল এই যে দুরবর্তী এক অঞ্চল থেকে এক সশস্ত্র বাহিনী এসে সেখানে সেরেফ গায়ের জোর এবং বর্বরতা দিয়ে গরিষ্ঠ জনসাধারণকে পায়ের তলায় রাখতে চাইছে। লঘিষ্ঠ জঙ্গীশাহী সেখানে অবাধ নির্বাচনের রায় অস্বীকার করতে চাইছে। বাংলাভাষী একটি জাতিকে গণহত্যা চালিয়ে লােপাট করতে চাইছে। | বিশ্বগােষ্ঠী যদি সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে বাংলাদেশে শান্তি চান তাহলে তার সেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা দানের ব্যবস্থা করেন। অবাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা সমস্যার সমাধান তাে হবেই
উপরন্তু সমস্যার মূলকথাটিকে (বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানী ফৌজের বীভৎস অত্যাচার ধামাচাপা এবং ঘােলা করে তােলা হবে। মূল সমস্যাটি থেকে বিশ্বমানবের দৃষ্টি যারা অন্যত্র সরিয়ে দিতে চায় তাতে তাদেরই সুবিধা করে দেওয়া হবে । | আর ভারত শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার বাধা সৃষ্টি করছে এই ইঙ্গিত সম্পর্কে ভারতের বক্তব্য : নিদারুণ আর্থিক বােঝা ঘাড়ে নিয়ে ভারত মানবিক কারণে শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয় ও ত্রাণের ব্যবস্থা করছে। সারা বিশ্বে বহু সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ভারতের এই ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জ শরণার্থী হাইকমিশানরকেও একথা বলা হয়েছে। শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার পথে আসল বাধা কোথায় তাও কারও অজানা থাকবার কথা নয়। নিছক সদিচ্ছা দিয়ে এবং এখানে-ওখানে গুটিকতক পর্যবেক্ষক রেখে বিশ্বগােষ্ঠী তাদের কর্তব্য পালন করবেন মনে করে আত্মসন্তুষ্ট অনুভব করতে চান করুন কিন্তু তার দ্বারা বাংলাদেশের জনগণের দুর্দাশা ঘুচবে না।
উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চেয়েছিলেন। এখন একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে উ থান্ট ভারত ও পাকিস্তানকে তুল্যমূল্য বিবেচনা করেছিলেন এবং তিনি এজন্য নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক চেয়েছিলেন। | নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে লেখা উ থান্টের চিঠির পূর্ণ বয়ান ভারত সরকারই আজ এখানকার সাংবাদিকদের দেন। তার মর্ম; ভারত-পাক উপমহাদেশে শরনার্থী সমাগমকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। এর দ্বারা শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। পরিস্থিতি মােকাবিলায় কী করা যায় নিরাপত্তা পরিষদ তা ঠিক করুন। এ নিয়ে পরিষদ সরকারীভাবে বা ঘরােয়াভাবে, প্রকাশ্যে বা গােপনে যেভাবে খুশী আলােচনা করুন। থান্টের চিঠির তারিখ ছিল ১৯ জুলাই। নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্যই এই সুপারিশ বাতিল করেন বলেই মনে হয়।
৩ আগস্ট ‘৭১
সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা