You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.14 | কূটনীতিকের কাজে যত চাকচিক্য, তত দায়িত্ব - শংকর ঘােষ | আনন্দবাজার পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

কূটনীতিকের কাজে যত চাকচিক্য, তত দায়িত্ব

— শংকর ঘােষ

কূটনীতিকের পেশা সম্বন্ধে সব দেশেই একটা মােহ আছে, বিশেষত আমাদের মতাে গরীব দেশে। চাকরির তালিকায় ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস-এর স্থান সবার উপরে। চাকরিকেই যারা জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করা মনস্থ করেছেন, তারা কূটনীতিকের চাকরি পেয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন এমন দৃষ্টান্ত বিরল। | একমাত্র ব্যতিক্রম কিছু মহিলা, কারণ আমাদের ফরেন সার্ভিস-এ বিবাহিতা মহিলার স্থান নেই। বিবাহের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিতে হয় বিবাহিত পুরুষ যেচাকরি করতে পারেন সে-চাকরি বিবাহিতা মহিলারা কেন করতে পারবেন না তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন এ-নিয়ম সংবিধান বিরােধী কেন না স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকারের প্রতিশ্রুতি এতে লজ্জিত হয়েছে।  তবে ভারত সরকার তাতে বিচলিত মনে হয় না। তাদের মতে কূটনীতিকের কাজের প্রকৃতি এমনই যে, কোনও বিবাহিতার পক্ষে তার পারিবারিক কর্তব্য পালনের পর চাকরির দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এর অর্থ কী, কোন বিশেষ কারণে বিবাহিত পুরুষ কুটনৈতিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম আর বিবাহিত মহিলা নন তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়নি। একজন ভারতীয় মহিলা অবশ্য পেশাদার কূটনীতিক না হলেও রাজনীতিক কূটনীতিক ছিলেন-শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত। তবে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন স্বামী মারা যাওয়ার পর । তেমনি হয়েছিলেন, বর্মার শ্রীমতী অংসান ও পাকিস্তানের বেগম লিয়াকত আলি খান। পশ্চিমী দেশের অবশ্য এই ধরণের কোন বিধিনিষেধ নেই যদিও সেখানেও মহিলা কূটনীতিকের সংখ্যা খুব কম।

এই ভারতেই এককালে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন শ্রীমতী আলভা মিরডাল, বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিক ডঃ গানার মিরডালের স্ত্রী। কূটনীতিকের চাকরির চাকচিক্য এতই বেশি যে, তার দায়িত্ব বা বিপদের কথা সাধারণত মনে থাকে । মােটা মাইনে তার উপর তােধিক মােটা ভাতা। এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত বারাে হাত কাকুড়ের তেরাে হাত বিচি হয়। নানা খাতে ভাতা তাে আছেই, মায় পােশাক খাতেও, তার উপর বিনা শুল্কে পানীয় ইত্যাদি। কাজের মধ্যে মােট দৃষ্টিগােচর সেটি নিয়মিত সান্ধ্য পার্টিতে সস্ত্রীক উপস্থিতি। | সব কূটনীতিকের উপার্জনই অবশ্য সমান নয়। তারতম্য পদ ও দেশ অনুসারে। তবে ভারতবর্ষের শ্রী কে পি এস মেনন যখন সােভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রদূত ছিলেন তখন বেতন ও ভাতায় তিনি প্রতি মাসে প্রায় দশ হাজার টাকা পেতেন আমাদের রাষ্ট্রপতির বেতনও তাই।  স্বভাবতই কূটনীতিকদের সম্বন্ধে সাধারণের একটা ঈর্ষাবােধ আছে। তার প্রকাশ তাদের পেশা ও আচরণ সম্পর্কে প্রচলিত নানা বক্রোক্তিতে। কূটনীতিক কে, এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়, যে সৎ লােকটিকে তার দেশের সরকার মিথ্যা কথা বলার জন্য বিদেশে পাঠান তিনিই কূটনীতিক। আবার অনেকে বলেন, কূটনীতিক মানে মােটা মাইনের গুপ্তচর। দুইটিই অতিশয়ােক্তি, কিন্তু দুয়ের মধ্যেই কিছু সত্য আছে। কূটনীতিকের কর্তব্যই হল যে-দেশে তিনি আছেন সে-দেশ সম্পর্কে নিজের সরকারকে ওয়াকিবহাল রাখা এবং সঙ্গে সঙ্গে সে-দেশের সরকারকে নিজের দেশের প্রকৃত অবস্থা জানানাে। তিনি একাধারে সংবাদ পরিবেশক ও সংগ্রাহক। এই কাজের জন্য প্রয়ােজন অমায়িক ও শিষ্ট ব্যবহার, বিশ্বাস অর্জনের স্বাভাবিক ক্ষমতা। সব 

কূটনীতিককেই এমন অবস্থায় পড়তে হয় যেখানে তার কঠোর হওয়া একান্ত প্রয়ােজন, অথচ রূঢ় হওয়া চলে হাসির মােড়কে কঠোরতা প্রকাশের এই আবশ্যক অথচ দুর্লভ ক্ষমতা নিয়েও ব্যাঙ্গোক্তি আছে। কূটনীতিক ও মহিলার মধ্যে প্রভেদ কী? এই প্রশ্নের উত্তর হল কূটনীতিক কখনও ‘না’ বলেন না, মহিলা কখনও ‘হ্যা’ তার অর্থ সম্ভবত’, আর তিনি যদি বলেন ‘সম্ভবত তার অর্থ না । মহিলা যদি বলেন ‘না’ তার অর্থ ‘সম্ভবত’ আর যদি বলেন ‘সম্ভবত তার অর্থ হঁ্যা। আমাদের সরকার বলতে পারেন কূটনীতিক ও মহিলার মধ্যে ভাষার ব্যবহারগত এই দুস্তর প্রভেদের জন্যই তাঁরা ফরেন সার্ভিসে মহিলা অনুপ্রবেশের বিরােধী।  কূটনীতিক হিসাবে বিবাহিতা মহিলা নিয়ােগের বাধা থাকলেও কূটনীতিতে বিবাহিতা মহিলার স্থান ভারত সরকার অস্বীকার করেন না। জওহরলাল নেহরু একবার বলেছিলেন, ভারতীয় কূটনীতিকদের নানা প্রয়ােজনীয় গুণের মধ্যে একটি হল সর্বগুণেন্বিতা স্ত্রী। কূটনীতিকের স্ত্রীর শুধু সহধর্মিণী হলেই হবে না, তাদের সহকর্মিণীও হতে হবে। সে-কাজটা যে শুধু পার্টিতে যােগদেওয়া বা পার্টির আয়ােজন করাই নয় তা গত চার মাস ধরে ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের অন্তরীণ কর্মীদের পরিবারবর্গের দৃষ্টান্ত থেকেই বােঝা যায় । বাংলাদেশে জঙ্গী তান্ডব শুধু হওয়ার ঠিক এক মাস পরে পাকিস্তান সরকার ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতাবাসটি বন্ধ করে দেন। দেওয়ার অবশ্য সঙ্গত কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তারা ভেবেছিলেন, কলকাতায় তাদের দূতাবাসের অধিকাংশ কর্মী এমনকি স্বয়ং ডেপুটি হাইকমিশনার পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করে ও জঙ্গী সরকারকে ধিক্কার দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর পাকিস্তান সরকারের মুখ রক্ষায় একমাত্র উপায় হল ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসটি বন্ধ করে দেওয়া। এর ফলে কীভাবে পাকিস্তানের মুখরক্ষা হতে পারে তা বুঝতে হলে অবশ্য পাকিস্তানের জঙ্গী ন্যায়শাস্ত্রে পারঙ্গম হওয়া দরকার। | দূতাবাস বন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার কর্মীদের ভারতে ফিরে আসার কোন বাধা ছিল না।

কিন্তু তাতে জঙ্গী শাসকদের সাদীয় (স্যাডিস্টিক) আনন্দ হত না। তাই নানা টালবাহানায় তারা এতদিন এই নির্দোষ কর্মীদের ও তাদের পরিবারবর্গকে প্রায় বন্দী রেখেছিলেন। তারা কীভাবে এতদিন ছিলেন তার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় পাকিস্তানে ভারতীয় হাইকমিশনের একটি খবরে, যাতে বলা হয়েছে যে, ঢাকার প্রাক্তন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চাল পর্যন্ত পাঠাতে হয়েছে না হলে তারা উপবাসে থাকতেন।  পশ্চিম পাকিস্তানে পা দিয়েই কলকাতার পাকিস্তানের প্রাক্তন ডেপুটি হাইকমিশনার মিঃ মেহদি মাসুদ অভিযােগ করেছেন, কলকাতায় তিনি অত্যন্ত কষ্টে ছিলেন; তার উপর নানা বিধিনিষেধ আরােপ করা হয়েছিল। অথচ ঢাকায় ভারতীয় প্রাক্তন ডেপুটি হাইকমিশনার শ্রীকৈলাসচন্দ্র সেনগুপ্ত তারা ঢাকায় কীভাবে ছিলেন সে-সম্বন্ধে একটি কথাও বলেননি। সরকারী চাকরিতে যােগ দেওয়ার আগে শ্রীসেনগুপ্ত সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর পক্ষে সামান্য কটি তথ্যের মাধ্যমে তাদের দুর্ভোগের কথা জানিয়ে দেওয়া কঠিন ছিল না। বাক সংযমও কূটনীতিকের একটি গুণ। ক্ষেত্রবিশেষে পান্ডিত্য ও তা জাহিরের প্রবণতা কুটনীতিকের সাফল্যের অন্তরায় হয়। আঁদ্রে মালরাে তারা আত্মজীবনীতে সর্দার পানিক্করের উল্লেখ করেছেন। শ্ৰীপানির চীনে কুওমিনটাঙ ও কমিউনিস্ট দুই আমলেই ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ফ্রান্সে, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হওয়ার পর দ্য গলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে তিনি চীন সম্পর্কে এমন বিরাট বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেন যে, ভারত সম্পর্কে কিছু বলার সময় তিনি পেলেন না আর দ্য গলেরও এ দেশ সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করার অবকাশ মিলল না। তবে কোন কোন ব্যাপারে সাধারণের অবগতির জন্য কিছু বলা দরকার। সাধারণভাবে কূটনীতিকের পক্ষে বাকবিলাস পরিহার্য সন্দেহ নেই। কিন্তু ঢাকায় প্রাক্তন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরা কীভাবে ছিলেন সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নির্বাক থাকা ভারতের পক্ষেই ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষত যখন মিঃ। মাসুদ ইতিমধ্যেই তাঁর কাল্পনিক দূরবস্থার বিবরণ সবিস্তারে বর্ণনা শুরু করেছেন।

১৪ আগস্ট, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা