You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রসঙ্গে

–ইন্দ্রনীল

বাংলাদেশের নিরীহ নিরপরাধ অসামরিক জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীনায়ক ইয়াহিয়া খার সেনাদের বর্বর অভিযান শুরু হওয়ার পর চার মাসের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। একদিকে যেমন পাকিস্তানী সেনারা বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করার মতলব নিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করেছে, অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশহীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বর্বর হানাদের বিরুদ্ধে মুক্তি ফৌজের গেরিলা বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘােষণা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের কার্য পরিচালনার জন্য এক পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। এক সুসংগঠিত কমানডের অধীনে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানাে হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব ডাকটিকিট চালু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের অধীনে বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অসামরিক শাসন চালু হয়েছে। নিজস্ব বেতারে বাংলাদেশের ঘােষণাদি প্রচার করা হচ্ছে। একটি বিদেশী রাষ্ট্রে বাংলাদেশের এক পুর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক মিশন কাজ করছেন। পৃথিবীর প্রধান প্রধান কয়েকটি দেশে বহু সংখ্যক পাকিস্তানী কূটনীতিবিদ ইয়াহিয়া খাঁ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি লাভের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে আবেদন করেছেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে ভারতের সংসদ এবং কয়েকটি রাজ্য বিধানসভায় সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। বেশ কিছু সংখ্যক বৃটিশ এম পি বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার পক্ষপাতী। বাংলাদশ যে খুব শীঘ্রই একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে ইউরােপের বহু দেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করেছেন। যখন কেন দেশে বিদ্রোহ বা গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়, নতুন সরকার গঠিত হয় বা পুরাতন রাষ্ট্র ভেঙে নতুন। রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, তখন আন্তর্জাতিক আইনে তার স্বীকতির প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। কোন দেশে রাজনৈতিক বিদ্রোহ দেখা দিলে আন্তর্জাতিক আইনে বিদ্রোহীদের স্বীকার করে নেওয়ার। রীতি আছে। বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য অবশ্য মহান হওয়া প্রয়ােজন।

১৮৬৮ সালে স্পেনের বিরুদ্ধে কিউবার যখন বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, তখন তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। লাভ করেছিল। ইয়াহিয়া খাঁর বর্বর শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে গণবিদ্রোহ দেখা দিয়েছে, তার মূলে রয়েছে স্বাধীনতার দুর্বর আকাখা। এ সম্পর্কে কারও বােধহয় দ্বিমত নেই। | গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ নয়। কোন দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে, প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরােধী পক্ষ যদি দেশের একটা বৃহৎ অংশ দখল করে নিয়ে নিজেদের শাসন ব্যবস্থা চালু করে তাহলে বিদ্রোহীরা। যুদ্ধরত শক্তি হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের যােগ্যতা অর্জন করে। যুদ্ধরত শক্তি হিসাবে গণ্য হতে হলে বিদ্রোহীদের আরও কয়েকটি শর্ত পূর্ণ করতে হয়। দেশ জুড়ে একটা সশস্ত্র সংঘর্ষের অবস্থা, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের অধীনে যুদ্ধ পরিচালনা এবং এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে অন্যান্য রাষ্ট্র যুদ্ধরত শক্তিকে স্বীকার করে নেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করে। কোন দেশে এরকম অবস্থা দেখা দিলে অন্যান্য রাষ্ট্রের বিদ্রোহীদের যুদ্ধরত শক্তি হিসাবে স্বীকার করে নেওয়ার অধিকার জন্মায়। শুধু অধিকার নয় এটা তাদের কর্তব্যে পর্যবসিত। হয়। বাংলাদেশে যে গৃহযুদ্ধ চলছে তাতে বিদ্রোহীদের যুদ্ধরত শক্তি হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অন্যান্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকার ও নতুন। রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিতে পারে কিনা? বাংলাদেশের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব। অন্যান্য দেশে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের সাহায্যে রাষ্ট্রের একটা অংশের জনগণ মূল রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে নতুন রাষ্ট্র গড়েছেন এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়।  

কিন্তু পাকিস্তানের গরিষ্ঠ সংখ্যক নাগরিক মূল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এক নতুন রাষ্ট্র গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। অধিকাংশ নাগরিকের আনুগত্য যদি রাষ্ট্রের ভিত্তি বলে গণ্য করা হয় তাহলে, পাকিস্তান বলে কোন রাষ্ট্র এখনও আছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। বাংলাদেশের ঘটনার এটাই হল সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।  বিদ্রোহ বা বিপ্লবের সাহায্যে পুরাতন রাষ্ট্র কোন নতুন সরকার গঠিত হলে অন্যান্য রাষ্ট্র যদি দেখে, দেশের অধিকাংশ মানুষের নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য রয়েছে এবং নতুন সরকারের স্থায়িত্ব সম্পর্কেও সন্দেহের বিশেষ কোন কারণ নেই, তাহলে তারা পুরাতন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসাবে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। নতুন সরকারকে অবশ্য দেশের মধ্যে দৃঢ়ভাবে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়। | কোন নতুন সরকারের পিছনে যদি অবাধ ও স্বাধীনভাবে ব্যক্ত জনসমর্থন থাকে তাহলে সেই-তাহলে সেই সরকার অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দাবি করতে পারে। মারকিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরােপের বহু দেশ ওই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে আসছে। মারকিন রাষ্ট্রনায়ক জেফারসন এই পদ্ধতির উদ্ভাবক। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে বিসমারক, ফরাসী সরকার জাতীয় সভ্যর অনুমােদন না পাওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে অস্বীকৃত হন। ১৯১১ সালে পর্তুগালের রিপাবলিক্যান সরকার দেশের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর বৃটেন, জারমানি, অস্ট্রিয়া, স্পেন ও ইতালীর স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৪৯ সালে ইজরায়েলে সাধারণ নির্বাচনের পর মারকিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেন ইজরায়েল সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। উভয় ক্ষেত্রে একই সঙ্গে ইজরায়েল রাষ্ট্রকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে কোন বাধা নেই। গত ডিসেমবার সাধারণ নির্বাচনে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় সভার এবং প্রাদেশিক আইন। সভায় অধিকাংশ আসন দখল করে। আওয়ামী লীগ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পাকিস্তানে সরকার গঠনের যােগ্যতা অর্জন করে। জঙ্গীশাসক ইয়াহিয়া খার বিশ্বাসঘাতকতায় নির্বাচনের পরবর্তী অধ্যায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি।  ইয়াহিয়ার বর্বর অভিযান শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তারা সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে এই সরকারের প্রতি অনুগত, তা ডিসমবরের নির্বাচনেই তা প্রমাণিত হয়েছে। এই সরকার ও নবগঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব সম্পর্কে বিদেশের বহু বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক আইনের দিক দিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে এখন আর কোন বাধা নেই। ১৯০৩ সালে পানামা যখন কলমবিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নতুন রাষ্ট্র গঠন করেছিল, মারকিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কোন রাষ্ট্র যে এখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসেনি তার কারণ এই নয় যে, স্বীকৃতির জন্য প্রয়ােজনীয় সব শর্ত বাংলাদেশ সরকার পূর্ণ করতে পারেনি। জাতীয় স্বার্থ, গােষ্ঠী স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী দেশগুলির এখন আর পিছিয়ে থাকা উচিত নয়। তারা এগিয়ে এসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার যে অভূতপূর্ব সংগ্রাম চলেছে তা জয়যুক্ত করতে বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করুন। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে ভারত মানবতার ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারতকেই অগ্রণী হওয়া উচিত। বাংলাদেশের ৮০ লক্ষ দুর্গত। শরণার্থীর স্বার্থে ভারতের বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার । ভারত যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি। দিতে এগিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস।

৯ আগস্ট, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!