রাজধানী রাজনীতি বাংলাদেশ সমস্যা এবং আমেরিকার পাক-নীতি
–রণজিৎ রায়
দুমাস আগে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের অবস্থা সরেজমিন তদন্তের জন্য এসেছিলেন। শ্ৰীকারগিলের নেতৃত্বে পরিচালিত ঐ দলটি বাংলাদেশ সম্পর্কে এক হৃদয়বিদারক প্রতিবেদন পেশ করেছেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে ব্যাপক ধ্বংস ও অত্যাচার চালিয়েছে তা ঐ দলের মতে, ১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বােমায় বিধ্বস্ত হিরােশিমা শহর এবং ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে রক্তলােলুপ মারকিন সৈন্যদের গণ-হত্যার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বিগত কয়েক সপ্তাহে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের অনেক সংসদ সদস্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা। সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের বিপুলতা এবং সামরিক নিয়ম কানুন লংঘনের নগ্ন দৃষ্টান্তে স্তম্ভিত । ওঁদের কেউ কেউ ইসলামাবাদে জেনারেল ইয়াহিয়া এবং ঢাকায় টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে বাড়ি ফেরার পথে নয়াদিল্লী হয়ে গিয়েছেন। কৃত কর্মের জন্য পাকিস্তানী জেনারেলরা মােটেই অনুতপ্ত নয়, বরং বাংলাদেশে ওরা যা করেছে তার জন্য ওরা বেশ খুশী। পাকিস্তান দেখে ফেরা বিদেশীদের মতে জেনারেল ইয়াহিয়া এবং তার দোসর টিক্কা খানের তুলনায় পূর্ববর্তী সামরিক শাসক আয়ুব খান ছিলেন নেহাৎই কবুতর-তুল্য।
গত তিন মাস ধরে অনেকেই ভেবে আসছেন যে, বিশ্বজনমত ইয়াহিয়া খানাকে রানীতিক সমাধানে আসতে নিশ্চয় বাধ্য করবে। গত এপরিল মাসেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশের ব্যাপারে “রাজনীতিক ব্যবস্থাপনায় কথা বলতে শুরু করেছিলেন। নয়াদিল্লীও আমেরিকার উপর খুব আস্থা স্থাপন করেছিল; ভেবেছিল আমেরিকা পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসকদের উপর নিশ্চয় চাপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু ওরা “রাজনীতিক ব্যবস্থাপনা,” বলতে ঠিক কী বােঝাতে চান তা শ্রী স্বর্ণ সিং-এর আমেরিকা সফরের সময় কিংবা তারপরেও আমেরিকার নেতারা খােলাসা করে বলেননি। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট নিকসনের উপদেষ্টা ডঃ কিসিংগার নয়াদিল্লী এসেছিলেন। তাঁর কাছ থেকেও শ্রীমতী গান্ধী এ ব্যাপারে কোন তথ্য আদায় করতে পারেননি। বাংলাদেশে কোন ক্রীড়নক সরকার গড়া হলে ওয়াশিংটন সেটাকেই রাজনীতিক ব্যবস্থা বলে মেনে নিতে অনিচ্ছুক নাও হতে পারে। নয়াদিল্লী অবশ্য স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে যে, এ ধরনের সমাধান আলী। সমাধান বলে গণ্য হবে না; বাংলাদেশের জনগণও তা মেনে নেবেন না। শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে বােঝাপড়ার যেটুকু সম্ভাবনা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া তার ২৮ জুনের বেতার ভাষণে তা ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। আসলে নয়াদিল্লী যে কথাটা জানতাে না, জেনারেল ইয়াহিয়া তা জানতেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সংবাদ আমাদের বিশ্ব পরিব্রাজকদের বড়ই বিপাকে ফেলে দিয়েছিল। আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান এই সব অস্ত্র বাংলাদেশে এবং অবস্থা সেরকম হলে ভারতের বিরুদ্ধেই প্রয়ােগ করবে। ডঃ কিসিংগারকে এ কথাটা বুঝিয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি এখানে কিছু বুঝতে আসেননি। এসেছিলেন ভারত যেন সমঝে চলে- এ কথাটা। বলতে।।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের হাতে অস্ত্র সম্ভার তুলে দেওয়ার সময় ওয়াশিংটন ভারতের তীব্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছিল। আইসনহাওয়ারের প্রশাসকেরা সে সময় ভারতকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিলেন যে, ঐ সব অস্ত্র ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। বলা হয়েছিল- কমিউনিসট সম্প্রসারণবাদকে রােধ করার অঙ্গ হিসাবেই আমেরিকা পাকিস্তানকে ঐ সব অস্ত্র দিচ্ছে। ভারত অবশ্য এ যুক্তিতে ভােলেনি। ১৯৬৫ সালে দেখা গেল ভারতের আশংকাই ঠিক। ৬৫ সালে পাকিস্তান আমেরিকার অস্ত্র দিয়েই ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। ঐ বছর পর্যন্ত আমেরিকা পাকিস্তানকে দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্রাদি দিয়েছিল। ১৯৬৫ সালের পর আমেরিকা আবার পাকিস্তানকে অস্ত্র দিতে শুরু করে। ওয়াশিংটন নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বলে-পাকিস্তানকে এখন থেকে খুব মারাত্মক নয় এমন অস্ত্র এবং যন্ত্রাংশই শুধু দেওয়া হবে। | স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানকে তােষামােদ করার ব্যাপারে আমেরিকানরা চীনাদের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিতে চাচ্ছেন। ডঃ কিসিংগার বলেছেন- আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করলে, ইসলামাবাদ পুরােপরি পিকিং-এর খপ্পরে চলে যাবে। সেটা মােটেই ভারতের পক্ষে অনুকূল হবে না- ইত্যাদি ইত্যাদি । এ যুক্তি যে কত ঠুনকো তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। ভাবখানা যেন এই যে ভারতকে সাহায্য করার জন্যই আমেরিকা জাহাজ জাহাজ অস্ত্র ইসলামাবাদে পাঠাচ্ছে। ওঁর মতে ওঁর দেশের প্রশাসনিক দফতরের কাচা কাজের ফলেই বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার পরও ইয়াহিয়াকে অস্ত্র পাঠানাে হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের। তালিমারা বক্তব্য পেশ করাটাও যে দারুণ কার্টা কাজ। অবশ্য এত কথা বললেও অস্ত্র প্রেরণ বন্ধ করতে ডঃ কিসিংগার রাজী নন। মারাত্মক অস্ত্র পাঠানাে হচ্ছে না- এ সব বলে তিনি এবার আর নয়দিল্লীকে বােকা । বানাতে পারেননি।
ডঃ কিসিংগার আমেরিকার লাইনটা চালিয়ে দেবার জন্য ভারতের চীন-ভীতিকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছেন। ১৯৬৭ সালে ইসলামাবাদের সঙ্গে অস্ত্র সংক্রান্ত চুক্তি করার সময় সােভিয়েত ইউনিয়নও ঠিক। একই যুক্তি উপস্থাপিত করেছিল। অবশ্য সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে কত অস্ত্র দিয়েছে তা আমরা জানিনা। তবে এটুকু জানি যে সে দেশ পাকিস্তানকে যা দিয়েছে, ভারতকে তার তুলনায় বেশি অস্ত্র দিয়েছে। ইসলামাবাদের ব্যাপারে সােভিয়েত আগের চেয়ে সতর্ক হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় । মসূকো সম্প্রতি ঘােষণা করেছে যে ১৯৭০ সালের এপরিল মাস থেকে সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করেছে। তার কাছে বােধহয় ভেঙে পড়া পাকিস্তানের চেয়ে দৃঢ়বদ্ধ ভারতই অধিকতর নির্ভরযােগ্য। অন্য দিকে আমেরিকা আগের মতই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের আবহাওয়া বজায় রেখে চলেছে। আমেরিকার শাসককুল। ডেমােক্রাটিকই হােক আর রিপাবলিকই হােক, ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ব্যাপারেও আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতরের মনােভাবে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। | যাই হােক ডঃ কিসিংগার চীন জুজুর ভয় দেখিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। তিনি যে যুক্তি জাল বিস্তার করতে চেয়েছিলেন তা হল ঃ ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সংঘর্ষ শুরু হলে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেবে। তার ফলে সােভিয়েত ইউনিয়নও মাঠে নেমে পড়তে পারে। তিনি বােধহহয় এই ইঙ্গিতই নিতে। চেয়েছেন যে, এই ভূখণ্ডের কোন যুদ্ধে চীন এবং রাশিয়া জড়িয়ে পড়ুক, আমেরিকা তা চায় না। ডঃ কিসিংগারকে বলে দেওয়া হয়েছে যে চীন যদি ও রকম কোন ব্যবস্থা নেয় তাহলে আমেরিকানরাই সর্বপ্রথম ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসবে বলে বিশ্বজন আশা করবে। সত্যি বলতে কী গত এপরিল মাসে। পিকিং এর হাবেভাবে নয়াদিল্লী কিছুটা শংকিত হয়েই উঠেছিল। পরবর্তী হিসাবে নিকাশে স্থির হয়েছে| পিকিং ভারতের বিরুদ্ধে মৌখিক বিসংবাদ শুরু করলেও পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবে বলে মনে হয় না। ভারত ও চীনের শত্রুতা গড়িয়ে তােলার মত কোন কিছু করতে চাইবে। পাকিস্তানের দুই অংশ যে একত্রে থাকতে পারবে না।
এমনি একটা বােধ ধীরে ধীরে দুনিয়ার নানা দেশে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে কী ঘটছে এবং কেন তা ঘটছে সে কথাটা তলিয়ে বােঝার জন্য ডঃ কিসিংগারকে ভারতীয় নেতারা অনুরােধ করেছেন। শুধু অস্ত্রের জোরে জোড়াতালি দিয়ে এবং পূর্বাংশকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বানিয়ে রেখে যে দুই পাকিস্তানের একতাবদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়- সে কথাটাও তাকে বুঝে দেখতে অনুরােধ করা হয়েছে। আমেরিকা তার পাকিস্তান নীতি ভেঙে পড়তে দিতে নিশ্চয়ই চাইবে না; তাই সে দেশ ভাঙা টুকরাকে কোন রকম জোড়া লাগানাের চালিয়ে যাবে। ডঃ কিসিংগার আমাদের নেতাদের বলে গিয়েছেন যে, তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাজনীতিক সমাধান সম্পর্কে কথা বলবেন—এবং জেনারেল ইয়াহিয়া যদি তা মানতে রাজী না হন তাহলে তিনি শ্রী নিকসনকে তার পাকিস্তান নীতি নতুন করে সাজাতে বলবেন। কিন্তু ডঃ কিসিংগার শেষ পর্যন্ত তেমন কোন সুপারিশ করলেই যে শ্রী নিকসন তা মেনে নেবেন, তেমন কোন নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশ সমস্যা বিষয়ে কানাডার সংবাদপত্র গ্লোব এবং মেইলে গত জুলাই এ একখানা কৌতূহলােদ্দীপক চিঠি বেরিয়েছে। লেখক? লেখক কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী মিচেল শার্প স্বয়ং। ঐ চিঠিতে শ্রী শার্প লিখেছেনঃ “পাকিস্তানে যথাযথভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই সর্বোত্তম সমাধান হত।” কিন্তু তা অতি দূরের ব্যাপার বলে মনে হয়। তিনি লিখেছেনঃ “পাকিস্তান বিভাজনের সুপারিশ করাটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় হবে।” কিন্তু “সম্ভবত সেটাই সমাধানের একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়াবে।”
১৫ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা