খণ্ড অখণ্ড পাকিস্তান
— রেজা আলি
পাকিস্তানের অখণ্ডতা নিয়ে পৃথিবীর মহাশক্তিবর্গের উৎসাহ ক্রমশ প্রকট। চীন তার রায় প্রথমেই জোরশােরে জাহির করেছে। তেইশ বছর পূর্বে এই উপমহাদেশকে নিয়ে একটা সমস্যা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষ খণ্ড না অখণ্ড থাকবে? সেই সমস্যার সমাধান-রূপেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। ইতিহাসের এই কাসুন্দি ঘাটতে হচ্ছে। কারণ, বর্তমান সমস্যার স্বরূপ উপলব্ধির জন্যে অতীতের জের। টানা ছাড়া উপায় নেই। তখন ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিতরূপেই জন্মলাভ করে। তার দুই অঙ্গের মধ্যিখানে বারাে শ’ মাইলের ব্যবধান। দুই অঞ্চলের ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সামাজিক কাঠামাে প্রভৃতি এমনকী আবহাওয়া পর্যন্ত আলাদা। এমন ভাবে বিচ্ছিন্ন যুগল এলাকা কী এক রাষ্ট্রে পরিণত হােতে পারে? সেদিন কেউ কোন যুক্তিযুক্ত জবাবের জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। | পৃথিবীর মহাশক্তিবর্গ পাকিস্তানের বর্তমান উপদ্রুত অবস্থার জন্য রাজনৈতিক সমাধানের খুবই জোর দিয়েছে। অবিশ্যি সমাধানের কী রূপ হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু অখন্ডতা সম্পর্কে সকলে এক রৰ । মনে হয়, তাদের চিন্তার পেছনে আর যাই থাকুক, কোন যুক্তিবিচারের বালাই অন্ত্যত নেই।
রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, দুই বিচ্ছিন্ন অঙ্গ দেশ এক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। ভৌগােলিক সমাবস্থান রাষ্ট্র গঠনের একটি বাধ্যতামূলক শর্ত। কিন্তু দেশবিভাগের সময় মুসলীম লীগ নেতৃবৃন্দ ধর্মান্ধতা পরবশ এই কিম্ভূতকিমাকার চিজটি শুধু স্বীকার করে নিলেন না, বরং আরাে গলা ফাটিয়ে জাহির করলেন, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সূত্র মুসলমানের ক্ষেত্রে অচল কারণ ইসলাম এমন ধর্ম-যেখানে প্রত্যেক মুসলমান ভাই-ভাই, সেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য উপাদান সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় । তেইশ বছর পরে আজ দিনের আলাের মত স্পষ্ট- রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সূত্র ঠিকই আছে। ভুল করেছিলেন। মুসলীম লীগের মধ্যযুগীয় মানসিকতা আচ্ছন্ন, অর্ধশিক্ষিত পরিচালক বর্গ। অতীতের ব্যবচ্ছেদ ওইটুকু প্রয়ােজন ছিলাে। যেহেতু মহাশক্তিবর্গ পাকিস্তানের অখণ্ডতা সম্পর্কে বর্তমানে খুব উৎসাহী।। এখন দেখা যাক, পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায়ের জন্য কী কী শর্ত দরকার।
ঐদেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র যােগসূত্র (পাকিস্তান এয়ার লাইন বাদে) ইসলাম যা থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব। সুতরাং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ইসলামের উপর জোর দিতে হয়। ইসলামী মানসিকতায় যেন দুই অঞ্চল হাবুডুবু খায়। পাকিস্তানের সাবেক শাসক গােষ্ঠী ঐ প্রচেষ্টার কসুর করেননি। ইসলামী একাডেমি, ইসলামী উপদেষ্টা বাের্ড-এমন মােল্লাতােষ ডজন ডজন প্রতিষ্ঠান সব খান বিশেষত আইয়ুব খন, পয়দা করেছিলেন। দেখা গেল, দুই অঙ্গের মধ্যে ফাটল ক্রমশ বাড়তেই লাগল। বর্তমানে। চৌচির হওয়ার অবস্থা। বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গ নিশ্চয় এই কায়দার উপর জোর দেবেন না। দেশ বিভাগের সময় রাশিয়া থেকে কে যে মন্তব্য করেছিলেন, বােধ হয় স্ট্যালিন, কুড়ি বছরের গৃহযুদ্ধ এর চেয়ে ঢের ভাল। কাজেই আশা করা যায়, ফাটল বােধকারী ইসলামী প্রলেপ সম্পর্কে নিশ্চয় মহাশক্তিবর্গের কোন মােহ নাই। ইসলাম ধর্ম যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার কোন উপাদান হতে পারে না, বর্তমানে উপদ্রুত পরিস্থিতি তার চাক্ষুস প্রমাণ। তেমন সম্ভাবনা থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের এক ভাষা এবং ধর্মবিশিষ্ট রাষ্ট্রসমূহ কবেই অখণ্ড দেশে পরিণত হােত। এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই যে পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ এক অঞ্চল কর্তৃক অপর অঞ্চলের উপর শােষণের নাগ বেষ্টন। এক কথায়, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র এই দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্যই বাংলাদেশের বর্তমান সংগ্রাম। সুতরাং পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায়ের বিশেষ এবং প্রধান শর্ত হতে পারে ?
দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ। মহাশক্তিবর্গের প্রচেষ্টা একদিকে অতি সাধু বলে গণ্য হবে। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু সম্ভব, পরীক্ষা করে দেখা যাক। তেমন সম্ভাবনা থাকলে, বাংলাদেশে এত প্রাণের বলি দিতে হােত না। সকলেরই জানা আছে, বৈদেশিক ঋণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রশ্নেই আলােচনা শেষ পর্যন্ত সামরিক ষড়যন্ত্রে এবং পরে সামরিক তৎপরতায় পর্যবসিত হয়। বৃহৎ শক্তিবর্গ কী কূটনৈতিক চাপ দ্বারা ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া সরকারকে ন্যায়ের পথ দেখাবেন বা বাঘকে তৃণভােজী জীবে পরিণত করবেন? তার সম্ভাবনা নেই। একটি হেতু প্রদর্শনই যথেষ্ট অদূরদর্শিতা, বর্ণবৈষম্য, পক্ষপাত বা যে কোন কারণেই হােক পশ্চিম পাকিস্তান যন্ত্রশিল্পে শুধু অগ্রসর নয়, সর্বেসর্বা, আর পূর্ব পাকিস্তান কৃষি প্রধান এবং ঐসব শিল্পের উৎপাদন- জাত দ্রব্যের ব্রিয়কেন্দ্র মাত্র। অখণ্ডতা বজায়ের জন্য বর্তমান ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হয়। সুতরাং সমাধানের পথ আর এগােচ্ছে না। অন্য আর একটি বিকল্প থাকে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখা সম্ভব যদি দুই অঞ্চলের সমস্ত সম্পদের উৎপাদন, বণ্টন ইত্যাদি রাষ্ট্র করায়ত্ত থাকে এবং তা ন্যায্যমত দুই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিলি-বাটোয়ারা করা হয়। মহাশক্তিবর্গের দায়িত্ব এখানে লক্ষণীয়। একটা ফ্যাসিস্ট সরকারকে তাদের সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। জানােয়ার হবে যােগী বেশ গুরুদায়িত্ব। জানােয়ারের যদি যােগী বনার সম্ভাবনা থাকত তাহলে বাংলাদেশের গণহত্যার কি প্রয়ােজন ছিল? এখানেও সমস্যা আছে। চীন এবং রাশিয়া সমাজতন্ত্রী দেশ। তারা হয়ত অমন ব্যবস্থায় ইয়াহিয়া। সরকারকে বাধ্য করাতে পারে। বৃটেন, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ নিশ্চয় পাকিস্তানের সমাজতন্ত্রী বেশ পচ্ছন্দ করবে না। এমন ক্ষেত্রে কোন সুষ্ঠু সমাধানে আসার সম্ভাবনা খুবই কমই থাকে। শেষে হয়ত রাজায় রাজায়। যুদ্ধে বাংলাদেশ উলুখড়ে পরিণত হবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা শেষ পর্যন্ত বাৎ-কা-বাৎ যা আন্তর্জাতিক রাজনীতি খেল্ মাত্র। ইয়াহিয়া সরকার তা প্রহরে প্রহরে সােচ্চার ও পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিপন্ন অথবা ইসলাম বিপন্ন। বাংলাদেশে বর্তমান যে লুটতরাজ বর্বরতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা সবই ঐ মহান পবিত্র দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে। অখণ্ডতার মধ্যেই পাকিস্তানের মঙ্গল নিহিত। এখানে মহাশক্তিবর্গ এবং ইয়াহিয়া খান আত্মিক সহােদর। অথচ সকলেই জানে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার শ্লোগান জঙ্গীশাহীর ভাওতা মাত্র। এই প্রবঞ্চনার রীতি নতুন কিছু নয়। জিন্না সাহেব থেকে ইয়াহিয়া খান একই চীৎকারে গলা ফাটিয়েছেন। এমন দাগাবাজির আখড়ায় জুলফিকার আলি ভুট্টো নবাগত; তবে বিষে বাচ্চা সাপ। আশ্চর্য, পৃথিবীর মহান দেশগুলাে কীভাবে পাকিস্তানের ধুয়ায় গলা ছেড়ে দিলে? আরাে অবাক লাগে, সমাজতন্ত্রী দেশ নামে খ্যাত শক্তিবর্গও ‘অখণ্ডতা’ মরীচিকার পশ্চাদগামী? সমাজতন্ত্রীরা বলেন যে, শাসকশ্রেণী নিজেদের স্বার্থ অব্যাহত রাখতে প্রায়ই শ্বাশ্বত, চিরন্তন, নানা আদর্শের আড়ালে আত্মগােপন করে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা, বিপন্ন ইসলাম, জাতিয় সংহতি ইত্যাদি জিগীর কি তেমন অসাধু প্রচেষ্টা নয়? অথচ সমাজতন্ত্রীরা পর্যন্ত এখানে প্রতারিত। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রীরা মনে করেন যে, সমাজবিজ্ঞানের শেষ কথা এবং যুক্তি তাদের করায়ত্ত । ভাববাদী দাশনিকদের মত তারা কল্পনা রাজে ছােটাছুটি করেন না। যে-আদর্শ রূপায়ণ সম্ভব, শুধু তেমন আদর্শের কথাই তাদের মুখে উচ্চারিত হয়। অথচ আজ চীনের মত দেশও “পাকিস্তানী অখণ্ডতা” নামক অসম্ভবের পিছনে ধাবমান। বাংলাদেশের সমস্যা জাতীয়তার সমস্যা। ধর্ম জাতীয়তার উৎস নয়। একথা সমাজতন্ত্রীদের চেয়ে কে আর ভাল করে বােঝে? এখন হাঁক-ফুকার বলা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্র ইতিহাসের স্রাব মাত্র । দুই দশকে আপন স্ববিরােধিতার চাপে তা ভেঙে যাচ্ছে। চীন ও অন্যান্য সমাজতন্ত্রীদেশ মুক্তিকামী জনসাধারণের পাশে এসে দাঁড়াবে এই ছিল সকলের স্বাভাবিক আশা। কিন্তু বাস্তবে তার বিপরীত ঘটছে । সােজা অভিযােগ করা যায় ? হয় সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলাে নিজেদের আদর্শ জলাঞ্জলী দিয়েছে অথবা তারা স্ব-স্ব জাতীয় স্বার্থে এমন পথ নিয়েছে, নচেৎ ইউটোপিয়ার পশ্চাতে কেন তারা তৎপর? স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনই জন্মসূত্রে-ব্যাধিগ্রস্ত পাকিস্তানের নিরাময়ের একমাত্র আশু কার্যকর উপায়।
৫ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা