আমেরিকা ভাসানীকে কী বলেছিল বড় বড় সব দেশই এক
— বরুণ সেনগুপ্ত
বাংলাদেশের ব্যাপারে “বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি যে ভূমিকা নিয়েছেন তার পরে আর কোনও ভারতবাসীর বা বাংলাদেশবাসীর তাহাদের স্বরূপ চিনতে তেমন অসুবিধা হওয়া উচিত নয়। যাঁরা কারু অন্ধ ভক্ত, যারা “গুরু। শুড়িবাড়ি” গেলেও বলেন, “তথাপি আমার গুরু নিত্যনন্দ রায় তাদের কথা অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু যাদের তেমন কোনও বাধুনি নেই তাদের কাছে নিশ্চয়ই পরিস্থিতিটা এখন অনেকটা পরিষ্কার। পরিস্থিতিটা অবশ্য আরও পরিষ্কার হত যদি সব বড় রাষ্ট্রের বাংলাদেশ ঘটিত লীলাখেলা জনসাধারণ। খােলাখুলিভাবে দেখতে পেতেন। তা দেখতে পাচ্ছেন না বলেই কিছুটা অপরিষ্কার থেকে যাচ্ছে। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির অধিকাংশই আসলে যা করছেন প্রকাশ্যে তার খুব কমই জানতে দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে কিছুটা । কিছুটা ধরা পড়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ছে। এবং তার ফলে আমরা কিছুটা কিছুটা করে। ওদের চিনতে পারছি। | মারকিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন প্রভৃতি বৃহৎ শক্তি বাংলাদেশ সম্পর্কে যা যা করছেন এবং করেছেন তা যদি চীনের ভূমিকার মত স্পষ্ট হত তা হলে অবশ্য কথাই ছিল না। কিন্তু ওঁদের ভূমিকা চীনের মত স্পষ্ট নয়। কারণ, ওঁরা বাহ্যত দু’নৌকায়ই পা রেখে চলতে চাইছেন। তাই ওঁরা আসলে যা করছেন বাইরে তা । সবাইকে জানতে দিচ্ছেন না। | চীন ১৯৬২ সনের পর থেকেই খােলাখুলিভাবে পাক শাসকদের সমর্থক। এখনও তারা সেই নীতি। অবলম্বন করে চলেছেন। তারা খােলাখুলি ভাবে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করেছেন এবং করছেন। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের আর যারা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন চীনের মতে তারা সবাই “মারকিন ও ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের দালাল” । চীন পরিষ্কার বলেছেন, যারা বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে চাইছেন তারা পাকিস্তানের জনগণের শত্রু।” | মৌলানা ভাসানী এপারে এসেছিলেন। তিনি বলে গিয়েছেন, দুবার তিনি পিকিং গিয়েছিলেন। দুবারই মাও সে তুং-এর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। দুবারই মাও তাঁকে বলেছিলেন, আপনি পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করুন, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করা উচিত হবে না।
মৌলানা আরও বলেছেন, এবার এই মারচ মাসের ২২ তারিখও, অর্থাৎ ইয়াহিয়া খাঁ নিরস্ত্র মানুষের উপর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার তিন দিন আগে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করেছিলেন। তাকে অনুরােধ জানিয়েছিলেন, আপনি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়াকে সমর্থন করুন। ইয়াহিয়া যথা সময়ে আপনাকে যথাযােগ্য মর্যাদা দেবেন। এ খবর শুনে নিশ্চয়ই কেউই আশ্চর্য হবেন না। কারণ সবাই জানেন, চীন খােলাখুলিভাবে পাক শাসক। গােষ্ঠীর সমর্থক- বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে। কিন্তু মারকিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েট রাশিয়া বা ব্রিটেন কী, তা কি আমরা সবাই জানি? বাংলাদেশের। ব্যাপারে তারা আসলে কোন পক্ষে তা কী খুব পরিষ্কার বােঝা যায়? মারকিন সরকার এতদিন বলে এসেছেন, পাক সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় নিরস্ত্র মানুষের উপর যে। অত্যাচার করছেন মানবিক বিচারে তা নিন্দনীয়। তারা প্রচার করে এসেছেন, মারকিন যুক্তরাষ্ট্র “এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চান।” হাবভাবে ভারত ও বাংলাদেশবাসীকে বােঝাবার চেষ্টা করেছেন, পাক শাসকদের। হাত শক্ত হয় এমন কিছু তারা এখন করবেন না।
এবার কিন্তু তাদের মুখােস খুলে গিয়েছে। এখন ধরা পড়ে গিয়েছে যে তারা আসলে পাক শাসকচক্রকে অস্ত্র দিচ্ছেন- পাক সামরিক বাহিনীকে অস্ত্রে আরও বলীয়ান করে তুলতে চাইছেন। তারা এটা খুব ভালােভাবেই জানেন, পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ ওই অস্ত্র কিনে সাজিয়ে রাখবে না, ওই অস্ত্র দিয়ে তারা পূর্ব । বাংলার নিরস্ত্র মানুফকেই মারবে। অথচ পূর্ব বাংলার যে-কোনও বড় দরের নেতার সঙ্গে কথা বললেই জানা যায় যে এই মারচ মাসের। সংঘর্ষ আরম্ভ হওয়ার আগে পর্যন্ত নানা পর্যায়ের মরকিন প্রতিনিধিরা কিভাবে আওয়ামী লীগকে উৎসাহিত করেছেন। শেখ মুজিবর রহমান বেরিয়ে এসে কোনও দিন এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বিবৃতি দিলে বিশ্ববাসী চমকিত হবেন। ভাসানী সাহেব এ সম্পর্কে যা বলেছেন তাই বিস্মিত হওয়ার মত। তিনি বলেছেনঃ মাস পাঁচেক আগে ঢাকায় এক মারকিন রাষ্ট্রদূত আমাকে এসে বলেন, আপনারা যদি পূর্বদেশ গড়ার আহ্বান দেন, আপনারা যদি পশ্চিমবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, আসাম নাগা পাহাড় ইত্যাদিকে নিয়ে পূর্বদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন, আমরা কথা দিতে পারি তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর ২২-২৩ টি রাষ্ট্র আপনাদের স্বীকৃতি দেবে।
ভাসানী আরও বলেছেন ঃ সাহেব আমাকে বলেন যে, তিনি এ বিষয়ে মুজিবের সঙ্গেও কথা বলবেন। আমি তাই সঙ্গে সঙ্গে মুজিবকে সতর্ক করে দেই। আমি বলি, এটা আসলে বাংলাদেশের অর্থাৎ পূর্ব বাংলার । স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপথে চালিত করারই ষড়যন্ত্র । কিন্তু এর চেয়েও আশ্চর্য কথা বলেছেন ভাসানী সাহেব। তিনি বলেছেনঃ যেদিন চীনারা আমাকে এসে। বলল ইয়াহিয়াকে সমর্থন করুন তার পাঁচদিন আগেই মারকিন রাষ্ট্রদূত এস একই কথা বলেছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, মৌলানা ভাসানী আপনি এই পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়ার পাশে দাঁড়ান, তাহলে। পাকিস্তান রক্ষা পাবে না হলে ভেঙ্গে যাবে। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, মারকিন মতিগতির পরিবর্তন দেখে। এখন অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ দেখে মনে হয়, মৌলানা ভাসানীকে শেষ মারকিন প্রতিনিধি যা বলেছিলেন। সেইটাই হল বাংলাদেশ সম্পর্কে মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের আসল সরকারী মনােভাব। লড়াই-এর প্রথম দিকে বাংলাদেশের নেতারা রাশিয়া সম্পর্কে অত্যন্ত উৎসহী ছিলেন। তাঁরা। ভেবেছিলেন, রাশিয়া তাদের স্বীকৃতি দেবেন। বাংলাদেশের প্রথম ঘােষণা পত্রে প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন প্রকাশ্যে দুটি দেশের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন—একটি ভারত, আর এটি রাশিয়া।
সেই রাশিয়া এখন বলছেন, যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান তারা। সাম্রাজ্যবাদের দালাল। এই কথা ঘােষণা করা হয়েছে রাশিয়ার সরকারী পাক্ষিক পত্রিকা নিউ টাইমসে। পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য রাশিয়া এবার যে সাহায্য দিয়েছেন তার পরিমাণও বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। মাত্র ১২ লক্ষ টাকার জিনিসপত্র পাঠিয়েছেন রাশিয়া। রাশিয়া এ ব্যাপারে আরও যা করেছে সেটা বিচিত্রতর! রাশিয়ান কুটনীতিবিদরা দিল্লিতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদদের জানিয়েছেন ও ভারত যদি পূর্ব বাংলা নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াইয়ে নামে এবং তারপর। যদি চীন পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে নামে তাহলে আমরা কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেব। না। এটা কি প্রকারান্তরে পাকিস্তানকে আগাম গ্যারান্টি দেওয়া নয়? ভারত ও পাকিস্তানের বাপারে মারকিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, পশ্চিম জার্মানী প্রভৃতি রাষ্ট্রের যা ভূমিকা, রাশিয়াও বেশ কিছুদিন যাবৎই এক ব্যাপারে সেই ভূমিকা অবলম্বন করেছেন। রাশিয়াও ওই সব পশ্চিমা রাষ্ট্রের মতই দুই দেশে অস্ত্র বিক্রেতা। ওরা ভারতকেও অস্ত্র বিক্রি করেন, পাকিস্তানকেও করেন। রাশিয়াও তাই করেন। বাংলাদেশেল ব্যাপারে এখনও রাশিয়া অন্তত প্রকাশ্যে পশ্চিমা শক্তিদের চেয়ে আলাদা কোনও ভূমিকা নিতে পারেন নি।
৩০ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা