বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান কতদূর সম্ভব
.– অরুণ চক্রবর্তী
বিশ্বের নানা রাজধানীতে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে ভারতের দৈত্যৈর প্রাথমিক ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট যে, অনেক রাষ্ট্রই বাংলদেশে একটা রাজনৈতিক সমাধান চান। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে রক্ষা করে কিংবা বাংলাদেশের স্বাতন্ত্রকে রক্ষা করে কোন জাতীয় রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব সে কথা অবশ্য কেউই স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেননি। পৃথিবীতে গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে যে কোন যুদ্ধের সমাধানেই একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ তৃতীয় পক্ষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। এই পথ খুব একটা ফলপ্রসূ হয়েছে এমন কথা বলা যায় না। তবু এ চেষ্টার বিরাম নেই। কেন না, বন্ধু রাষ্ট্রের দাবিকে সমর্থন জানাবার কিংবা শত্রু রাষ্ট্রের বিরােধিতা করবার দায়িত্ব বর্তমান শতকে একটি রাষ্ট্রকে এতখানি জড়িয়ে ফেলে বা অচিরেই তার সাধ্যাতীত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশকে নৈতিক সমর্থন জানালেও, সরাসরি সমর্থন জানতে এই কারণেই অন্য দেশ আগ্রহ প্রকাশ করতে পারছে না। তাই, রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব তুলে একটি গা-বাঁচানাে নীতিকে সবাই গ্রহণ করতে ব্যস্ত।
রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব তুলবার দ্বিতীয় কারণ হল, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই যুক্তরাষ্ট্রীয় বা আধাযুক্তরাষ্ট্রীয়। বাংলাদেশের বর্তমান লড়াই একটি স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মতে এবং অপর জনপ্রিয় নেতা মৌলানা ভাসানির মতে, এ লড়াই স্বাধীন বাংলা অর্জনের লড়াই। | পৃথিবীর কোন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারই নিজের অভ্যন্তরীণ সমসার কারণে এই ধরনের সংগ্রামকে সরাসরি সমর্থন জানাতে দ্বিধাগ্রস্ত । এ কথা ভুললে চলবে না, মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা এবং হাওয়াই রাজ্য মারকিন মুলুক থেকে কয়েক হাজার মাইল দুরে অবস্থিত। বৃটেনে স্কটল্যান্ড ও আলসটারের আন্দোলন এখনাে নিভে যায়নি। আফরিকায় এখনাে কলােনি টিকে আছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাবটি কতখানি আন্তরিকতাপূর্ণ এবং এই প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অন্যান্য রাষ্ট্র কতখানি আশাবাদী, তা কিছুটা ধারণ করা যেতে পারে। একজন পাকিস্তানী সংবাদদাতার হিসাবেই বাংলাদেশে পকি-ফৌজের দমননীতির বলি হয়েছে আড়ই লক্ষ মানুষ। গৃহ সম্পত্তি খুইয়েছেন এমন লােকের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা আজ নতুন করে বলবার নয়। ইয়াহিয়া সরকারের নাদিরশাহী শােষণের এবং নির্যাতনের এখনাে সমাপ্তি ঘটেনি। এই অবস্থায় স্বাধীন বাংলাকে গঠন করার বদলে আর কোন সমাধান আছে বলে বাংলাদেশ সরকার মনে করেন না। ইতিমধ্যেই তারা একথা ঘােষণা করেছেন। গত এক মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত বামপন্থী দলগুলির বৈঠকে যে সমস্ত প্রস্তাব গৃহীত। হয়েছে তাতে স্বাধীন বাংলা অর্জনের সংগ্রামে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার প্রস্তাবই প্রাধান্য পেয়েছে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক সমাধানের পথ ? বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দান করে, পাকফৌজকে হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করা। রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাসে এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার নজির এখনাে স্থাপিত হয়নি। তাছাড়া, পাকসরকার যে এই সমাধানে রাজী কখনােই হবে না, এটা স্পষ্ট।
সমাধানের দ্বিতীয় পথটি সম্ভবত ইয়াহিয়ার অপসারণ এবং নতুন একজন সামরিক নেতার আবির্ভাব ও বাংলাদেশবাসীকে আশ্বাসদানের মধ্য দিয়ে শান্ত করা। সম্ভবত পশ্চিমী শক্তিবর্গ এই ধরনের কোন সমাধানের কথা ভাবছেন। বাংলাদেশে ঠিক এই পথ অনুসরণ করে ইয়হিয়া এসেছিলেন ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চে। তিনি এক সময় গণতন্ত্রের উদ্ধারকর্তারূপেও চিহ্নিত হয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে যে আন্দোলনের শুরু তা পরবর্তী চার মাসের মধ্যে এত ব্যাপকতা পেয়েছিল যে, আয়ুব খান বাধ্য হয়ে সরে দাঁড়িয়েছিলেন এবং ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেব’ এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইয়াহিয়া এসেছিলেন। ইয়াহিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা বাংলাদেশের জনগণকে চিরতরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। নতুন করে সেই পথ অনুসরণ করলে স্বাধীন বাংলার সংগ্রাম বন্ধ হয়ে যাবে এমন আশা করার কোন কারণ থাকতে পারে না। সমাধানের তৃতীয় পথ, বাংলাদেশে গোঁড়া ঐসলামিক দলগুলি নিয়ে একটি পুতুল সরকার গঠন এবং তাদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের একটি চুক্তিবদ্ধ সমাধান। বাংলাদেশের জনগণের সচেতনতা কোন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আর মেনে নেবে না, এটা খুবই স্পষ্ট।
যে কোন পথই অবলম্বন করা হােক না কেন এ কথা ভুললে চলবে না, বাংলাদেশের জাতীয়তাবােধ এখন চরম উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থের সামান্যতম বিরােধীরাও এই সাড়ে সাত কোটি সচেতন মানুষের ঘৃণার উদ্রেক করবে। কেননা বাংলাদেশের প্রতি প্রত্যেক বাংলাদেশবাসীর অনুরাগ এখন। আর আবেগ প্রধান নয়; তা’ কর্তব্য, দায়িত্ব আর অধিকারের অনুরাগ। এই কারণেই ধর্মান্ধতা বাংলাদেশের মন থেকে মুছে গেছে। একারণেই বাংলাদেশ পাক স্বার্থান্বেষীদের ঐসলামিক ভ্রাতৃত্বের নীতি লুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে একটি জাতি মানেই একটি রাষ্ট্র নয় কিংবা একটি রাজনৈতিক গােষ্ঠী নয়। এমন কি, জাতি বলতে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের অধিবাসীকেই বােঝায় না। আধুনিক পৃথিবীতে জাতি বলতে আর্য, অনার্য।ইত্যাদি বংশধারাকেও বােঝায় না। পৃথিবীর সবচেয়ে রক্ষণশীল ইহুদীরাও বর্তমানে বংশধারাকে জাতির মূল। বন্ধন বলে মনে করে না। ঠিক তেমনি বর্তমানে কেবলমাত্র ভাষা বা ধর্মের ভিত্তিতেও কোন জাতি গড়ে ওঠে। । একথা ভুললে চলবে না রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় আমরা যাকে জাতি বলে জানি, বর্তমান বিশ্বে সেই জাতি। অবলুপ্ত। বর্তমানে জাতির সংজ্ঞা নিরূপণ করাও সম্ভব নয়। তবে মােটামটি বলা যেতে পারে, বংশধারা, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং নিজ দেশের প্রতি একজনের অকপট ভালােবাসা, এই সব মিলিয়েই গড়ে ওঠে একটি জাতির বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে যে বেশিষ্ট্য বর্তমানে প্রাধান্য পাচ্ছে তা ভাষা। প্রধানত ভাষার বিচারেই বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের একটি জাতি বলে গণ্য করছেন।
২১ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা