You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজধানী রাজনীতি বাংলাদেশের ব্যাপারে দিল্লী এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়

— রণজিৎ রায়

বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত সরকারের উপর আর যে কেউ আস্থা রাখতে পারছে না সে কথাটা এতদিনে সরকারের উপলব্ধি করা উচিত ছিল। বাংলাদেশের সংগ্রাম শুরুর প্রথম দিকে ভারত সরকারের ঘােষণা যে উৎসাহ সঞ্চার করেছিল তা আজ অন্তর্হিত; তার স্থান নিচ্ছে হতাশা, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি ক্রমশই বেশি করে হতাশ হয়ে উঠেছে। | মাস দুই আগে যখন সব কয়েক লাখ মাত্র শরণার্থী ইয়হিয়ার অত্যাচার এড়াতে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তখন আমরা ঘােষণা করতে শুরু করেছিলাম—এভাবে জনগম বন্ধ করা এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা না হলে তার ফল বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। তখন মােটামুটি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে ভারত চরম ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হতে পারে।

আমাদের নেতারা তারপরও অনেকবার ও ধরনের হুমকি দিয়েছেন। আমাদের দূতগণ বিদেশে গিয়েও একই কাজ করছেন। ওদিকে অবিচলিত ইয়াহিয়া তার কাজ যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে ৬০ লাখ শরণার্থী এসে হাজির হয়েছেন। আর আমরা যে মন্ত্র দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই মন্ত্রই এখনাে আউড়ে চলেছি।  ওয়াকিবহাল মহলের দৃঢ় বিশ্বাস ঃ বাংলাদেশ থেকে ৫০ লাখ বর্ণ হিন্দু এবং পায় ২০ লাখ নিম্ন জাতীয় হিন্দুদের সকলেই ভারতে চলে আসতে বাধ্য হবেন। ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ মুসলমানও এ দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, আরাে আসবে সব মিলে শরণার্থীর সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ লাখে দাঁড়াতে পারে।  আশংকার কথা হল ? এই বিপুল সংখ্যক শরণাথী ভারতের বুকে, বিশেষ করে অস্থিসার দমবন্ধ পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় স্থায়ী বােঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভাগ্য যাই দাঁড়াক, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা যে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। ব্রিটিশ রাজ্যের সঙ্গে আপােস দ্বারা লব্ধ স্বাধীনতার পূর্ণ মূল্য বাঙালীরা বােধ হয় এখনাে ধরে দিতে পারেনি। দেশ বিভাগের কিছু কাল পরেই শ্রী নেহেরু বলেছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই আমাদের পক্ষে উদ্বেগের বিষয়; তার যদি নিরাপত্তা না পায় তাহলে তাদের নিরাপত্তা দেবার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’ এধরনের নানা বিবৃতি স্বাধীনতার সময় থেকেই বাঙ্গালীদের ব্যঙ্গ করে আসছে। আমরা চরম ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে পারি বলে নিজেদের তথ্য বলে নিজেদের তথ্য অন্যদের শােনাচ্ছি। কিন্তু কোন দেশ কী এই ঘােষণাকে গুরুত্ব দিয়েছে? অন্যে পরে দূর কথা, খোদ ইসলামবাদই কি আমাদের কথায় গুরুত্ব দিচ্ছে? পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে সৈন্য চলাচলের পরিমাণ বিচারে বলা যায় যে ইসলামাবাদ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হবে এমন ভয়ে ভীত নয়। বস্তুতপক্ষে অন্য কোন কোন দেশও সম্ভবত এ ব্যাপারে ইসলামাবাদকে আশ্বাস দিয়েছে।

আমাদের গােয়েন্দা বিভাগ আর একবার ব্যর্থতার পরিচয় দিল বলে মনে হচ্ছে। এপরিলের মাঝামাঝি। আমরা ভেবেছিলাম যে পাকিস্তান বাংলাদেশে সৈন্য শক্তি বৃদ্ধি করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তি হ্রাস করতে সাহস পাবে না। দেখা যাচ্ছে- সে হিসেবে খাটেনি। ২৫ মারচের পর ইয়াহিয়া অস্ত্রাদি সমেত বাংলাদেশে মােট আড়াই ডিভিশন সৈন্য পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশে এখন পাকিস্তানী সৈন্য রয়েছে পাঁচ ডিভিশন। তখন আরাে অনুমান করা হয়েছিল যে, ইয়াহিয়া যদি বাংলাদেশে বেশী করে সৈন্য পাঠাবার ঝুঁকি নেন, তাহলে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ বুদ্ধি করে তাকে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হব। কিন্তু আমরা সে রকম কিছু করেছি বলে মনে হচ্ছে না। এখন যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে তা হল- আমরা ওরকম কিছু করেও ইয়াহিয়াকে নিবৃত্ত করতে পারতাম না।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টার মূল কথা হল বিভিন্ন পাশ্চাত্ত্য দেশ এবং সােভিয়েত ইউনিয়নকে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিজড়িত করা এবং ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারীদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা।  ইসলামাবাদও অলসভাবে বসে নেই। পাকিস্তান বিভিন্ন দেশ থেকে আর্থিক সাহায্য এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য ত্রাণ সামগ্রী পাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেটুকু সাহায্যই দেওয়া হােক না কেন, সাহায্যদাতা দেশগুলি তদের “সাহায্য সামগ্রী” এবং “অফিসারদের যে এই সঙ্গে বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্ত রাজ্যএই দুই জায়গাতেই পাঠাবে তাতে সন্দেহ নেই। বিপুল সংখ্যক বিদেশীদের উপস্থিতির ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ আরাে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বিদেশের সাহায্য নিয়ে আমরা শরণার্থীদের আবার স্বগৃহে ফেরৎ পাঠাতে পারবাে এমন কথাকি বিশ্বাসযােগ্য? ভারতের চিরাচরিত বন্ধু রাষ্ট্র ইউ, এ, আর বাংলাদেশের ব্যাপারে শুধু ভারতের প্রতি নয়, তাদের স্বধর্মীদের প্রতি পর্যন্ত সহানুভুতি দেখায়নি। কোন বৃহৎ শক্তিই এ পর্যন্ত এমন কোন ইঙ্গিত দেয়নি। যে, তারা পাকিস্তান টুকরাে হয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। তারা বড়জোর ইয়াহিয়া এবং মুজিবরের মধ্যে একটা। বােঝাপড়া চায় ।

একেই তারা বলছে রাজনীতিক সমাধান। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনী উপস্থিত থাকা পর্যন্ত। অল্প কিছু মুসলমান ছাড়া অন্য শরণার্থীরা যে বাংলাদেশে ফিরবে না-নয়াদিল্লি মনে হচ্ছে সে কথাটা জানে। কিন্তু কী করণীয় সে সম্পর্কে নয়াদিল্লি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। পরিস্থিতির রাজনীতিক অ্যাসেসমেনট এবং সামরিক সমস্যার মধ্যে বিরােধ রয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এবং মুজিবর ক্ষমতায় এলেও যাতে শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে অসুবিধা দেখা দেয় আপাতদৃষ্টিতে ভারত সরকার অন্তত সে ব্যবস্থা করতে চায়। যথেষ্ট বিঘ্ন সত্ত্বেও শেখ মুজিবর বরাবর সাম্প্রদায়িকতার বিরােধিতা করে এসেছেন; আশা করা যায়- ভবিষ্যতেও করবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শ্রীতাজুদ্দিন আহম্মদ এবং অন্যান্য নেতারা বার বার আশ্বাস দিয়েছেন যে, শরণার্থীদের পূর্ণ নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে এবং তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হবে।  কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিতাড়ন করা সম্ভব হলেও শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি বাংলাদেশের। নেতাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। জমির উপর জনসংখ্যার চাপ প্রচণ্ড। গ্রাম এবং শহর-উভয় অঞ্চলেই রয়েছে ব্যাপক বেকার সমস্যা ও ছদ্মবেকারত্ব। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তািড়ন করে ইয়াহিয়া যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছেন এবং করছেন তা অচিরেই পূর্ণ হয়ে যাবে। বস্তুতপক্ষে, সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিকল্পিত উপায়ে তা ইতিমধ্যেই করা হচ্ছে বলে মনে হয়। শরণার্থীদের ফেলে-আসা জমি, দোকান ও অন্যান্য জিনিসপত্র যারা রয়ে গিয়েছে তাদের মধ্যে বিলি করে। দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং শরণার্থীদের তাদের পুরােনাে আবাসে ফেরৎ পাঠাতে হলে আবার একটি নতুন শূন্যতা। সৃষ্টি করতে হবে। যে কোন সরকারের পক্ষেই সে এক দুঃসাধ্য দায়িত্ব।

 ১৭ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!