দুটি জাহাজের দিকে আমাদের দৃষ্টি
–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
যুদ্ধ সরঞ্জাম ভর্তি দুটো জাহাজ আসছে পাকিস্তানের দিকে। এই সব মারকিন অস্ত্র দিয়ে বাঙালী নিধন যজ্ঞে নতুন করে ইন্ধন দেওয়া হবে। এর আগেও মারকিন চীনা অস্ত্রে নিহত হয়েছে বাংলাদেশের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ যারা কেউ কোনদিন স্বপ্নেও আমেরিকা বা চীনের সঙ্গে শত্রুতা করেনি। | নীল সমুদ্রের ঢেউ ঠেলে এগিয়ে আসছে দুটো জাহাজ- সকাল থেকে বার বার এই ছবিটা চোখে ভাসছে। মন চঞ্চল হয়ে ওঠে অনবরত। ঐ জাহাজ দুটিকে থামাতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই মনে পড়ে যায় কয়েক বছর আগেকার কিউবা সঙ্কটের কথা। প্রধানমন্ত্রী ক্রশ্চভ সামরিক জাহাজ বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। কিউবার দিকে, প্রেসিডেন্ট কেনেডি চূড়ান্ত হুশিয়ারি দিয়েছিলেন- জাহাজগুলি মুখ না ফিরলে তিনি অবরােধ সৃষ্টি করবেন। যে-কোনাে মুহুর্তে রুশ মারকিন যুদ্ধের আগুনে জ্বলে উঠতে পারে, প্রায় ৪৮ ঘন্টা ধরে সারা। পৃথিবী উদ্বিগ্ন ছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায়। শেষ পর্যন্ত সারা পৃথিবীকে বাঁচাবার জন্য খানিকটা অপমান সহ্য করেও নিকিতা ক্রশ্চভ সংবরণ করেছিলেন সমর তরণী । পৃথিবীর মানুষ হাঁফ ছেড়েছিল।
এবার আমরা মারকিন দেশকে বলেছি ঐ জাহাজ দুটির মুখ ফেরাতে। এবারও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধবার আশঙ্কা না থাক ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ লাগার ঘেরতর সম্ভাবনা। পাটোয়ারি বুদ্ধিসম্পন্ন দেশগুলি পাকিস্তানে মানােয়ারি জাহাজ পাঠাবে-ধ্বংসলীলা চলবে বাংলাদেশে আর লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হয়ে আশ্রয় নেবে ভারতে- এবং ভারত তার সমস্ত উন্নয়ন পরিকল্পনা বন্ধ রেখে শুধু এদের খাওয়াবে পরাবে? এবং বিশ্বের কাছে হাত পেতে থাকবে ভিক্ষের খুদ কুড়াের জন্য? মারকিন দেশ ঐ অস্ত্র বােঝাই জাহাজ দুটির মুখ না ফেরালে ভারতই ওদের গতি রুদ্ধ করবে- এরকম স্পষ্ট জোরালাে কথা বলতে অবশ্য আমাদের সরকার শেখেনি। কিন্তু সংসদ সদস্যরা এই দাবি তুলেছেনএদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাসীন নব কংগ্রেস দলের সদস্যরা। এই দাবি উপেক্ষা করা যাবে? ভারত সরকারের অনুরােধ আমেরিকা অগ্রাহ্য করলে ভারত সরকার কী সেই অনুরােধ বার্তা এঁটো থুতুর মতন গিলে ফেলবেন? শুধু সমুদ্রে ভাসমান ঐ দুটি জাহাজই নয়, আরাে একটি জাহাজ গেলাবারুদ বােঝাই হচ্ছে আমেরিকার বন্দরে। আমেরিকা কি সাফাই গাইবে, তা অনুমান করা শক্ত নয়। অতি নিকৃষ্ট ব্যবসায়ীর মতন আমেরিকা এ প্রসঙ্গে এত মিথ্যা কথা বলেছে যে, মার্কিন সরকারের মর্যাদা তার দেশবাসীর কাছে ধুলােয় লুষ্ঠিত। ভিয়োম যুদ্ধ থেকে বাংলাদেশের যুদ্ধ পর্যন্ত মারকিন সরকারের মিথ্যের ফুলঝুরি আজ সারা পৃথিবীর উপহাসের যােগ্য। (ধন্যবাদ ও দেশের স্বাধীন সংবাদ পত্রকে যার থেকে আমরা বুঝতে পারছি ও দেশের সাধারণ মানুষের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধেও কাজ করে দেশের সরকার।)
পাকিস্তানকে আর কোনাে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হবে না, এবং “পাইপ লাইনেও কোনাে অস্ত্র সম্ভার নেই। একথা ঘােষণা করার পরেই যখন জাহাজ দুটির খবর বেরুলাে, তখন সাত তাড়াতাড়ি বলা হলাে, ওসব পঁচিশে মার্চের আগেকার চুক্তি। তারপর আবার ফাস হয়ে গেল যে, মে মাসের শেষের দিকেও অস্ত্র পাঠানাে হয়েছে এবং এখনও জাহাজ বােঝাই হচ্ছে। যে কোনাে মানুষ এরকম মিথ্যা ধরা পড়ার পর লজ্জিত হয়, কিন্তু সরকারের হৃদয় থাকে না, লজ্জাও থাকে না। গণতন্ত্রের এত বড় চ্যামপিয়ান আমেরিকার মুখােশ আজ খুলে গেছে। রুশ কিংবা চীন গণতন্ত্রকে গ্রাহ্য করে না, সুতরাং অন্যদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় তারা যদি এগিয়ে না আসে, তা হলে বিশেষ করে বলার কিছু নেই। শুধু এইটাই একটা ধাধা, শােষিত ও নিপীড়িত জনগণের বন্ধু হিসেবে ঘােষিত ঐ সব দেশ কি করে নীরব থাকে- যখন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শােষিত নিপীড়িত মানুষকে হত্যা করা হয় নির্মম ভাবে, ঘর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় আরও কয়েক নিযুত মানুষকে? গরীব মানুষরা কমুনিষ্ট হবার আগে মরে গেলেও ক্ষতি নেই। তাদের বাঁচিয়ে রেখে কম্যুনিস্ট করার চেষ্টা করা যায় না? এটা কমুনিজম না কুসংস্কার?
যাই হােক, এবার বােঝা গেল, গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী আমেরিকাও অন্যদেশের গণতান্ত্রিক সরকার পচ্ছন্দ করে না। আমেরিকার যত বন্ধুত্ব নানাদেশের স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদের সঙ্গে। গণতন্ত্র মানেই সেই সব দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাধান্য। জাতীয়তাবাদের আবহাওয়া। আর সামরিক শাসক মানেই সাহেবী খানাপিনা, ইংরেজী বাক্যালাপ, একরকম ঠাট্টায় হাসাহাসি। এই সব খুব চেনা, এই জন্যই শেখ মুজিবর রহমানের মতন মানুষের চেয়ে ইয়াহিয়া খানরা আমেরিকার অনেক কাছের মানুষ। | ঐ দুটি জাহাজকে আমেরিকা ফেরাতে পারবে না বা ফেরাতে চাইবে না। আইনের কচকচি শুরু করবে। এসব অস্ত্র তাে বুমেরাং নয়, মারণ-শস্ত্র, একবার হাত ছাড়া করলে আর ফেরানাে যায় না। তাছাড়া জাহাজ দুটি আমেরিকার নয়, পাকিস্তানের সম্পত্তি- ‘পদ্মা’ আর ‘সুন্দরবন’- ওরা আসছে পদ্মা পার ও সুন্দরবনের মানুষদের ধ্বংস করতে আমেরিকা বিবেকের ঘরে চুরি করলেও আমরা চুপ করে থাকবাে? বাংলাদেশ একদিন না একদিন সম্পূর্ণ স্বাধীন হবেই। এ সম্পর্কে যার কোনাে সন্দেহ আছে সে সুস্থ মানুষ। নয়। কিন্তু তার আগে, যে যতটা পারে জল ঘােলা করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যদি তাড়াতাড়ি আসতাে, তাহলে শুধু যে আরও হাজার হাজার লােকের প্রাণহানি বন্ধ হতে পারতাে তা-ই নয়। উভয় বাংলায় কতক গুলি সৎ মুল্যবােধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারতাে। পঁচিশে মার্চের কাছাকাছি সময়ে দুই বাংলাতেই একটা বিশাল উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, সাম্প্রদায়িক বিভেদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, পশ্চিম বাংলার খুনােখুনি থমকে গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। বিধান সভায় অন্তত একবার সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাশ হতে
পেরেছিল। যত দিন যাচ্ছে, অবস্থা আবার বদলে যাচ্ছে। পাকিস্তানী মিলিটারির উস্কানিতে পূর্ব বাংলার এক শ্রেণীর মুসলমান হিন্দুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ঠেলে দিচ্ছে সীমানার এপারে হিন্দু উদ্বাস্তুদের মনের মধ্যে থেকে যাচ্ছে সেই দাগ। পশ্চিম বাংলাতেও সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেবার জন্য স্বার্থসম্পন্ন লােকের অভাব। নেই। এত উদ্বাস্তু আগমনের ফলে পশ্চিম বাংলার একশ্রেণীর মানুষ তটস্থ। আগে বাংলাদেশের জন্য যত সহানুভূতি বা একাত্মবােধ ছিল, এখন এই উদ্বাস্তুর বােঝায় সেটা দ্রুত কমে যাচ্ছে। সারা ভারতবর্ষেও যে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল, এখন সেটা স্তিমিত হয়ে দেখা দিচ্ছে শুধু বাঙালীদের সমস্যা হিসাবে। বিশ্বের বৃহৎশক্তি নামে পরিচিত নচ্ছার দেশগুলি এসব গ্রাহ্য করে না। শুধু উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারেই চাচামেচি হচ্ছে, কিন্তু এই সব মূল্যবােধ কে ফেরাবে? জগজীবন রাম বলেছেন সিংহ কখনাে শেয়ালকে আক্রমণ করে না। ফাকা আস্ফালনের ব্যাপারে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের জুড়ি নেই। জগজীবন রাম যে সিংহের কথা বলছেন, সে যে আসলে সিংহ চর্মাবৃত গর্দভ নয় সেটার একটা প্রমাণ পাওয়া দরকার । ভারত ঐ অস্ত্রবাহী জাহাজ দুটির পথ রােধ করুক।
২৬ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা