স্বর্ণ সিং দৌত্য সফল হবার আশা কম
— জে, কে, ব্যানারজি
বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বর অত্যাচারের ফলে ভারতে যে বিপুল শরণার্থী সমস্যা দেখা দিয়াছে তার প্রকৃতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিদেশী রাষ্ট্র কর্ণধারদের বােঝানােও একটা বড় সমস্যা। ভারত সরকার চেয়েছিলেন তারা যে দৃষ্টিতে সমস্যাটি দেখছেন অন্যান্য রাষ্ট্র ও সে দৃষ্টিতে দেখুন। কিন্তু তারা বিদেশী সরকারগুলিকে প্রভাবান্বিত করতে পারেননি। এই ব্যর্থতার পরই নয়াদিল্লি বিশ্বের নানা রাজধানীতে সরকারী ও বেসরকারী দূত পাঠিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী স্বর্ণ সিং গিয়েছেন পশ্চিমে। একই উদ্দেশ্যে বেসরকারীভাবে হলেও পূর্ণ সরকারী সমর্থনে সফর করছেন শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ। ভাতের উচ্চ পর্যায়ের কুটনৈতিক তৎপরতা সফল হবে কি বিফল হবে তা বুঝতে হলে বর্তমান সঙ্কট সম্পর্কে ভারতের নিজস্ব চিন্তাধারা কী তা জানা দরকার। ভারত বাংলাদেশে কী ধরনের অবস্থা দেখতে চায়? ভারতের সমস্যা কী শুধুই মানবিক ও অর্থনৈতিক? এখন পর্যন্ত যখন প্রতিদিন হাজারে হাজারে শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসছে, তখন কোন্ বাস্তব ভিত্তিতে বলা হচ্ছে যে শরণার্থীরা নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে যাবো।
অথবা সমস্যাটি কী একান্তই রাজনৈতিক? যে অবস্থা সৃষ্টি হলে শরণার্থীরা স্বেচ্ছায় নিজেদের দেশে ফিরে। যেতে চাইবে সেই অবস্থা সৃষ্ট না হলে কী শরণার্থীরা আবার সীমান্তের ওপারে যেতে পারবে, যেতে চাইবে? এখানেই আসল প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নের কোন স্পষ্ট জবাব নয়াদিল্লি এখনও দেয়নি। বাংলাদেশে যে অনুকূল অবস্থায় শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারবে, সেই অনুকূল অবস্থাটা কী? সেই অবস্থাটা আনবে কে? দখলদার খানসেনাদের বন্দুক- ঘেরা শ্মশানের শান্তিই কী সে পরম কাম্য ‘অনুকূল অবস্থা?’ বাংলাদেশ সরকার বলে দিয়েছেন একমাত্র পূর্ণ স্বাধীনতাই স্বাভাবিক অবস্থা এবং একমাত্র এই অবস্থা সৃষ্ট হলেই শরনার্থীরা স্বদেশে ফিরে যেতে পারবেন। ভারত সরকার কি এ বিষয়ে একমত? নাকি তারা বাংলাদেশ প্রতিনিধিবর্গ ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে কোন একটা মীমাংসার কথা ভাবছেন? ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মীমাংসার কথাবার্তা বলার জন্য বাংলাদেশের কোন নেতা এগিয়ে না এলে নয়াদিল্লি কি ইসলামাবাদের সহযােগিতায় শরণার্থীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে অথবা জবরদস্তি ফেরত পাঠাবেন? এই সব প্রশ্নের মূলে গেলে এই অপ্রতিরােধ্য জিজ্ঞাসাটি আসে- নয়াদিল্লি কি স্বাধীন বাংলাদেশ চান? না, তাঁরা চান পাকিস্তান অখণ্ড থাকুক? নয়াদিল্লি অখণ্ড পাকিস্তান চান বলেই কি তাড়াতাড়ি শরণার্থীদের ফেরত পাঠাবার ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা তুলছেন? অথবা নয়াদিল্লি কি এই চান যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা নিজেদের দেশে ফিরে যাবার পর পূর্ববঙ্গবাসীরা স্বাধীনভাবে স্থির করবেন তারা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবেন কী না? সর্দার স্বর্ণসিং ইউরােপের রাজধানী গুলিতে এবং নিউ-ইয়রক ওয়াশিংটনে কী প্রস্তার রাখবেন তা এই প্রশ্নগুলির সল জবাবের উপরই নির্ভর করে আছে। তিনি কী এসব রাজধানীর নিকট ইসলামাবাদের উপর চাপ দেবার আরজি পেশ করবেন? তিনি যদি চাপ দেওয়াতে চান, তবে কী উদ্দেশ্য? মুজিবরের সঙ্গে মিটমাট করবার জন্য? অথবা মুজিবরের স্বাধীনতার দাবি স্বীকার করিয়ে নেবার জন্য? সর্দার স্বর্ণ সিং এর এটাই যদি। অভিপ্রায় হয়, তবে তার সাফল্যের আশা কম। অথবা তিনি কী ইয়াহিয়া খানকে সমস্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেবার দাবি জানাবেন? তাই যদি হয় কী উদ্দেশ্যে? তিনি কী বিদেশী রাষ্ট্রগুলিকে তার উদ্দেশ্যের এই যৌক্তিকতা বুঝাতে পারবেন | যে ইসলামাবাদের অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করবার, অন্ততপক্ষে তার যুদ্ধের ক্ষমতা সীমিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি
এই নিষেধাজ্ঞা চাচ্ছেন? এই দাবি কোন বৃহৎ রাষ্ট্র, এমন কি বন কিংবা অটোয়াও মঞ্জুর করবে না। কারণ, পূর্ববঙ্গবাসীদের বর্তমানে যে উগ্রতম স্বাধীনতা সংগ্রাম, তাতে সর্দার স্বর্ণ সিং-এর এই দাবি মানতে হলে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় তারা সহায়তা করবে না। সর্দার স্বর্ণ সিং বড়জোর এই যুক্তি দেখাতে পারেন যে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের চাপ দিলে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ইসলামাবাদ সম্ভবত মীমাংসায় আসতে বাধ্য হবে, তার ফলে শরণার্থীরাও দেশে ফিরে যেতে পারবে আর পাকিস্তানও অখণ্ড থাকবে। সর্দার স্বর্ণ সিং এর এটাই যদি সাহায্য বন্ধের দাবির উদ্দেশ্য হয় তবে হয়তাে পাশ্চাত্ত্য রাজধানীগুলিতে তা সহানুভুতির সঙ্গে বিবেচিত হতে পারে। অন্যথায়, নয় । এই অবস্থায় ভারতের কথাবার্তা চালানাের একটি মাত্র খাতই খােলা আছে। বাংলাদেশ সাবেক অবস্থায় ফিরে যাক- ভারত যদি এটা না চায় তবে মসকো- ওয়াশিংটন-লনড়ন-বন-কারাে কাছে কিছু যা না করে প্রত্যেককে আগাম কৃতকর্ম সংশােধন না করে তবে নিজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্রধারণসহ উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ভারতের গত্যন্তর থাকবে না। এই এটি মাত্র বক্তব্য বা প্রত্যাখ্যাত হবার ভয় নেই, যা ব্যর্থতার গ্লানি বহন করবে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যদি সাড়া আনতে হয় তবে এই একটি মাত্র উপায়। তবে ভারতের সঙ্কল্পে দৃঢ়তা থাকা চাই এবং তা বিশ্বসনীয় হতে হবে। প্রথম সুফল। মসকোতে সর্দার স্বর্ণ সিং এর আলােচনার একটি সুফল দেখা যাচ্ছে সােভিয়েত প্রধান মন্ত্রী শ্রী কোসিগিণ ৯ জুন মসকোতে তার একভাষণে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন। ভারত পাকিস্তান সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার ফলে বিশ্ব জনমত উদ্বেগ বােধ করছে- একথাও তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন।
মসকোতে সুফল পাবার ধারণার মূলে দুটি তথ্য বিবেচ্য। এপরিল মাসের গােড়ার দিকে ইসলামাবাদের গণহত্যার নিন্দা করে সােভিয়েট রাষ্ট্রপতি পদগরনি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতভাজন হলেও ইয়াহিয়া খানকে চটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামাবাদের সঙ্গে গাঁটছাড়া একেবারে যাতে খুলে না যায় সেই ভয়ে মসকো। ইসলামাবাদকে বেশী ঘাটাতে উৎসুক নয় । শ্রীকোসিগিনের বক্তৃতা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই জন্য যে, তিনি বােঝাতে চেয়েছেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে তার জন্য দায়ী হবে ইসলামাবাদই। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, শ্রী কোসিগিন বলছেন, বাংলাদেশে সামরিক তাণ্ডবই ভারতের উদ্বাস্তু-প্লাবনের একমাত্র কারণ। ইয়াহিয়ার যেসব দোস্তরা পাকিস্তানের ঐক্য। রক্ষার জন্য পূর্ববঙ্গে সামরিক বিভীষিকার সমর্থক, তাঁরাও স্বীকার করেন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের অমানুষিক অত্যাচারের ফলেই পূর্ববঙ্গের নাগরিকরা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করা হচ্ছে বলে নয় (নয়াদিল্লি সরাকরীভাবে বিষয়টিকে পাকিস্তানের “ঘরােয়া ব্যাপার” বলেই মনে করে), ভারতে ক্রমাগত শরণার্থী-স্রোত আসাই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার কারণ, এই তথ্যটি স্বীকার করে শ্রীকোসিগিন ভারতের মতামতকেই সমর্থন করছেন। তবে শরণার্থীরা যাতে দেশে ফিরে যেতে পারে সেজন্য কি করা উচিত শ্রী কোসিগিন জেনারেল ইয়াহিয়া। খানকে তা বলেননি। পূর্ববঙ্গে কি শেখ মুজিবরের হাতে শাসনভার ছেড়ে দিতে এবং তিনি যাতে ক্ষমতা লাভ করতে পারেন সেজন্য ইয়াহিয়া খানকে তার পানজাবী সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিতে বলা হবে? বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে যেমন মসকো, তেমনি নয়াদিল্লিও অস্পষ্ট।
১৪ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা