You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের কথা নিয়ে দুনিয়ার দরবারে ভারত -শংকর ঘােষ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের কথা নিয়ে দুনিয়ার দরবারে ভারত

–শংকর ঘােষ

বাংলাদেশের প্রকৃত সমস্যাটি বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে পেশ করার জন্য ভারতের পক্ষ থেকে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ পুরােদমে শুরু হয়েছে। সর্বোদয়নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ মধ্যপ্রাচ্য ও য়ুরােপ সফর। শেষ করে এখন আমেরিকায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী স্বর্ণ সিং বর্তমানে সােভিয়েত ইউনিয়নে; শিক্ষামন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় বেরিয়েছেন দূরপ্রাচ্যের দেশগুলির উদ্দেশে-অবশ্যই চীন তার সফর তালিকার বাইরে। শ্রীনারায়ণ সফর শুরু করেন গত মাসে। তার সফরের ফল এ পর্যন্ত খুব আশাপ্রদ নয় বিশিষ্ট আরব। নেতাদের অনেকের সঙ্গেই তিনি দেখা করতে পারেননি। তার দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি হয়নি, কিন্তু পাকিস্তান। ক্ষুব্ধ হবে এই ভয়ে আরব নেতারা তার সঙ্গে আলােচনায় সম্মত হননি। ধরে নেওয়া যেতে পারে, বাংলাদেশ। সম্পর্কে আরব দেশগুলির মন স্থির হয়ে গেছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ণ সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কোন কারণেই তারা সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে রাজী নয়। এর কারণ ধর্মীয় না রাজনৈতিক তার তাত্ত্বিক বিচার। বর্তমানে নিষ্প্রয়ােজন।  শ্রীনারায়ণের যুৱােপ সফর ষােল আনা ব্যর্থ হয়নি। সেখানকার রাষ্ট্র নেতারা অন্তত তার বক্তব্য শােনবার। সৌজন্যটুকু দেখিয়েছেন; যদিও একমাত্র প্রেসিডেন্ট টিটো ও মহামান্য পােপ ছাড়া আর কেউই তার সঙ্গে একমত হননি। য়ুরােপীয় রাষ্ট্র নেতাদের কেউ কেউ খােলাখুলি জানিয়েছেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে যে অত্যাচার করুক না কেন তাদের পক্ষে সে অত্যাচার বন্ধের জন্য কোনও চাপ সৃষ্টি সম্ভব নয় কারণ তার। ফলে চীন-পাকিস্তান মৈত্রী দৃঢ়তর হতে পারে এবং পাকিস্তানে চীনা প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থাৎ এই উপমহাদেশে যে শক্তিসাম্য সৃষ্টি হয়েছে তা ব্যাহত করতে পারে এমন কোন নীতি গ্রহণ তাদের পক্ষে। সম্ভব নয়।  শ্রীস্বর্ণ সিং এখন সােভিয়েত নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করছেন। তাঁর আলােচনার ফলাফল এখনও। জানা যায়নি। অবশ্য খবর বেরিয়েছে, আলােচ্য বিষয়গুলি সম্পর্কে সােভিয়েত নেতারা তাঁর সঙ্গে একমত। কূটনৈতিক পরিভাষা অনুসারে এ খবর অর্থহীন। সৌজন্যের মােড়কে সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য হিসাবে। পরিবেশণ কূটনীতির অপরিহার্য অঙ্গ এবং এ বিষয়ে যার যত বেশি দক্ষতা তিনি তত বড় কূটনীতিক।

বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি সােভিয়েত নেতারা প্রথমে সহানুভূতি জানিয়েছিলেন, কিন্তু তারপর। কোন অজ্ঞাত কারণে তারা নির্বাক। সম্ভবত তাদের কোন কাজের ফলে পাকিস্তানে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তা পশ্চিমী রাষ্ট্র নেতাদের মত সােভিয়েত নেতারাও চান না। শ্রী স্বর্ণ সিং-এর সােভিয়েত সফর থেকে প্রমাণ। হয়, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মতভেদ আছে; না হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর। সােভিয়েট সফরের প্রয়ােজন হত না। তার সফর সফল হবে যদি বাংলাদেশে গণহত্যা অবসানের জন্য। পাকিস্তানী নেতারা কোন সক্রিয় ব্যবস্থা অবলম্বনে রাজী হন। শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সবে ভারত ছেড়েছেন। তিনি যেসব দেশে যাবেন তার কোনটাই বৃহৎ শক্তি নয়। 

এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা নগণ্য। তবে রাষ্ট্রপুঞ্জ “এক জাতি এক ভােট” নীতিতে বিশ্বাসী হওয়ায় সেখানে সব দেশের অভিমতেরই সমান দাম, অবশ্য সে অভিমত যদি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে গৃহীত ও ব্যক্ত হয়। আমেরিকাই একমাত্র বৃহৎ শক্তি যার কাছে ভারতীয় কোন নেতা বাংলাদেশ সম্পর্কে এদেশের বক্তব্য এখনও সরাসরি পেশ করেননি। কিন্তু নয়াদিল্লির একটি খবরে প্রকাশ যে পাকিস্তান সরকারকে স্পষ্ট জানানাে হয়েছে, বাংলাদেশ সঙ্কটের নিম্নসন না করলে আমেরিকার পক্ষে আর পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়। কীভাবে বাংলাদেশ সমস্যার সম্ভব তাও আমেরিকা সরকার জানিয়েছে। প্রথমত, আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবির ভিত্তিতে শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারকে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সাহায্য বিতরণের তদরকী আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর ছেড়ে দিতে হবে। এবং তৃতীয়ত, বাংলাদেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে ভারতে আগত সমস্ত শরণার্থীর পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়।

খবরটি সত্য হলে ভারতের পক্ষে নিশ্চয় সুখবর। গত কয়েক সপ্তাহে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দুটি বিষয় স্পষ্ট জানিয়েছেন ভারত বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান চায় এবং ছত্রভঙ্গ পাকিস্তান ভারতের কাম্য নয়। রাজনৈতিক সমাধান যুদ্ধের মাধ্যমে সম্ভব নয়, যদিও অনেক সময় যুদ্ধ রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দ্বি বা বহুপাক্ষিক আলােচনার প্রয়ােজন, সুতরাং শ্ৰীমতী গান্ধীর প্রথম বক্তব্যের মূল কথা এই যে তিনি চান পাকিস্তান সরকার এবং বাংলাদেশের জননায়কদের মধ্যে আলােচনা শুরু হােক। সেই আলােচনা কীসের ভিত্তিতে হতে পারে তার ইঙ্গিত শ্রীমতী গান্ধীর দ্বিতীয় বক্তব্যে পাওয়া যায়। তার মতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এই মীমাংসার ভিত্তি হােক তা তিনি চান না। স্বাধীনতার বিকল্প স্বায়ত্তশাসন। অবশ্য সেই শাসন ব্যাবস্থা যে আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবির ভিত্তিতে হবে তা তিনি স্পষ্ট বলেননি। হয়ত এই ছয়দফা দাবির রদবদলও যে সম্ভব তার আভাষ দিতে চেয়েছেন। | এই রাজনৈতিক মীমাংসা যে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গেই করতে হবে তাও প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট বলেন নি। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ দাবির পরােক্ষ বিরােধিতা করে তিনি জানিয়েছেন যে এই আলােচনা কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গেই সম্ভব। কারণ বাংলাদেশের জন্য যে কয়টি রাজনৈতিক দল সেখানকার আন্দোলনে বর্তমান লিপ্ত তাদের সকলেরই দাবি স্বাধীন বাংলাদেশ।

অবশ্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারও এখন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলেছেন। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা ছিল ততদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবর রহমান কেউই পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেননি। ছয়দফা দাবির ভিত্তিতে কোন মীমাংসার সূত্র উদ্ভাবিত হলে তা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করবে এবং সে মীমাংসায় আওয়ামী লীগের সম্মতি আছে তা বাংলাদেশের জনসাধারণও মেনে নেবে এই স্থির বিশ্বাস না থাকলে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলতেন  এবং এই সমাধানে ভারত সরকার যাতে যথােচিত ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে তার জন্যই হয়ত অনেক বিরূপ সমালােচনা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকার করেন নি। আমেরিকার মনােভাব সম্পর্কে যে খবর বেরিয়েছে তা সত্য হলে ভারতের কূটনৈতিক জয় হয়েছে স্বীকার করতেই হবে। সম্ভবত কূটনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের এই প্রথম জয়। এবং সে-জয় সরাসরি দরবারের ফলে নয়, গত দু’মাসের “কোয়ায়েট ডিপ্লোমাসীর জন্য। বস্তুত, শ্রী স্বর্ণ সিং এর প্রস্তাবিত আমেরিকা সফর বা শ্ৰী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের দূরপ্রাচ্য সফর এখন বাহুল্য মনে হয়। অবশ্য আমেরিকার মনােভাব পাকিস্তানের গােচর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার মুজিবের সঙ্গে আলােচনায় রাজী হবে তা নয়। কিন্তু আশা করা অসঙ্গত হবে না যে, পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্যকারী দেশগুলিরও এবার মনােভাবের পরিবর্তন হবে এবং সকলে একযােগে বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ দেবে। ভারত সরকারও তাই চেয়েছেন। যদি  তাই হয় তাহলে শ্রীমতী গান্ধী যে আশা প্রকাশ করেছেন, ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি | হবে যাতে সব শরণার্থীর পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে সে আশা আকাশকুসুম নাও হতে পারে।

৯ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা