রাজধানী রাজনীতি বাংলাদেশের ব্যাপারে শুধু বিশ্ববিবেক নয় দেশের বিবেকও জাগাতে হবে
–রণজিৎ রায়
গত সােমবার কল্যাণসুন্দরম লােকসভায় মন্তব্য করেন ভারত সরকার পাকিস্তানকে তুষ্ট করে চলেছে। এ কথায় শ্রীমতী গান্ধী খুবই মর্মাহত হয়েছেন। একজন সিপিআই নেতা চেমবারলিনের কুখ্যাত মিউনিখ নীতির সঙ্গে ভারত সরকারের পাকিস্তান নীতির তুলনা টানবেন- এমন কথা প্রধানমন্ত্রী বােধ হয় কল্পনাও করেননি। তিনি খুব জোরের সঙ্গে এই মারাত্মক অভিযােগ অস্বীকার করেছেন। তবে, “আমরা বাংলাদেশের ঘটনাবলী। সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে তৎপর রয়েছি”- এর চেয়ে বড় কোন আশ্বাসও প্রধানমন্ত্রী সেদিন দিতে পারেননি। মে মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করেছিলেন- নীতি সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারত অন্যান্য দেশের মনােভাবের উপর নির্ভরশীল নয়; সে নিজেই নিজের নীতি স্থির করে থাকে। কিন্তু তবু বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার বর্বর অত্যাচার শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের সরকার যে কূটনীতির স্তরে খুবই তৎপর হয়ে ওঠেনি- এমন কথাও কেউ বলতে পারবে না। বিভিন্ন দেশের রাজধানীর সঙ্গে নয়াদিললি নিয়ত সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। অন্যান্য দেশের সরকারের সঙ্গে নােট বিনিময় করাও হয়েছে। ইয়াহিয়া ভারতের উপর কী বিপুল সমস্যা চাপিয়ে দিয়েছেন, তার ফল কী দারুণ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা ঐসব দেশকে সে কথা বােঝাবার চেষ্টা করেছি।
আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে বিদেশে পাঠিয়েছি। তিন কয়েকটি দেশে গিয়ে বাংলাদেশের সমস্যা বুঝিয়ে বলবেন। শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রী শ্রী মইনুল হক চৌধুরী ইতিপূর্বেই ঐ কাজ কিছুটা সেরে এসেছেন। একই কাজে আত্মনিয়ােগ করেছেন শ্রম ও পুণর্বাসন মন্ত্রী শ্রীখাদিলকর। কূটনীতির কাজে তিনি এত ব্যস্ত যে শরণার্থীদের দেখােনার কাজটা তিনি তার অধস্তনদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের বিষয়ে নয়াদিললির বক্তব্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে বুঝিয়ে দিয়ে তাদের আমাদের পক্ষে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। বাংলাদেশ নিয়ে আমরা যে প্রবল কূটনীতিক অভিযান শুরু করেছি, তা আগে আর কখনাে দেখা যায়নি। যে-সব দেশে আমাদের প্রতিনিধিরা যাচ্ছেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই পাকিস্তানের কুটনীতিক সম্পর্ক আছে। তাদের নিজস্ব গােয়েন্দা বিভাগও আছে; এবং আছে, তাদের নিজস্ব স্বার্থ। আড়াই মাস ধরে ওদের লােকেরাও ইয়াহিয়ার রক্ত-ক্ষুধার তাণ্ডব স্বচক্ষে দেখেছেন। তবু আমাদের সরকার অতি আশায় বােধ হয় ভাবছেন ভারত গিয়ে ওদের ব্যাপারটা ঠিক মত বুঝিয়ে দিলেই ওদের বিবেক একেবারে পরিস্কার হয়ে যাবে এবং ওরা। ভারতের পক্ষে চলে আসবে।
ফল যাই দাড়াক বিশ্ব-বিবেক জাগ্রত করার এই প্রয়াসের জন্য ভারত সরকারের সাধুবাদ অবশ্য প্রাপ্য। কিন্তু ভারতেরই যে-সব রাজ্য সরাসরি শরণার্থী সমস্যার দ্বারা পীড়িত হচ্ছে না, তাদের বিবেক জাগানাের চেষ্টা যথেষ্ট রকম হয়েছে কি? শ্রীমতী গান্ধী তার সহযােগী মন্ত্রীদের কিংবা সর্বশক্তিমান রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বিবেক কি জাগাতে পেরেছেন? শরণার্থীদের ঠাই দেওয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ রাজ্যের যা মনােভাব তাতে মনে হয় বিদেশে দূত না। পাঠিয়ে ভারতেরই বিভিন্ন রাজ্যের বিবেক জাগ্রত করা এবং পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর সমাবেশ ভারতের পক্ষে কী সংকট ডেকে এনেছে তা বুঝিয়ে বলার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে দূত পাঠালেই ভালাে হত। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নয়াদিললি যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে শরণার্থীদের সীমান্তের কাছাকাছিই রেখে দেওয়া হবে, তখন তা ছাড়া অন্য তেমন কিছু করারও ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের যত্ন-আত্তি করার জন্য গড়ে তােলা কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দফতর পূর্বাঞ্চলের উদ্বাস্তু সমস্যার প্রকৃত অবস্থা পরিমাপ করে তদনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করবে- এমন আশীও দুরাশী। সীমান্তের দূরবর্তী কোন রাজ্যকে একজন শরণার্থীকে ঠাই। দেওয়ার জন্যও রাজী করানাে যায়নি। শরণার্থীদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে কলকাতায় বসে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিধাগ্রস্ত ঘােষণা থেকেই বােঝা যায় যে, তিনি অন্যান্য রাজ্যের মনােভাব পাল্টাতে সক্ষম হননি।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাণান্তকর সমস্যা সম্পর্কে ভারত সরকার কী করতে চান- গত সপ্তাহে রাজনীতি বিষয়ক কমিটির একজন সদস্যকে এ প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বললেন- কিসের সমস্যা? ভারত সরকার তাে উদ্বাস্তুদের সব ব্যয় বহণ করছে; সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের কোন অভিযােগ থাকার কথা নয়। মােট শরণার্থীর মাত্র একতৃতীয়াংশ সরকারী সাহায্য নিচ্ছে, অন্যেরা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের গলগ্রহ হতে বাধ্য হয়েছে- এ কথা তিনি মানতে নারাজ। উনি বললেন- পশ্চিমবঙ্গ যদি মনে করে যে বােঝা খুব ভারি হয়ে পড়ছে, তাহলে সীমান্ত পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কি তা মেনে নেবে? ওঁর কথায় মনে হয়সমস্যা যে পশ্চিমবঙ্গেরই! ওঁর বক্তব্যের সঙ্গে ভারত সরকার যে স্ট্যানড’ নিয়েছেন তার সঙ্গতি আছে কিনা। সেটা তিনি তলিয়ে দেখেননি। রাজনীতি বিষয়ক কমিটিতে এ বিষয়ে শুধু ওঁর একারই এই মনােভাব নয়। এই উপমহাদেশে রাজনীতিক মন্থনের ফলে অমৃত এবং বিষ-দুইই উঠছে ঃ পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে শুধু বিষটাই জুটছে। সামাজিক ও আর্থিক বিপর্যয়েও রাজ্য ক্ষয়ের মুখে হাড় পঞ্জিরা যে কখানা আছে তা বােধ হয় মহামারীর জন্যেই রেখে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ একেবারে নিঃশ্বেস হয়ে গিয়ে বিদেশে চা-পাট পাঠানাে বন্ধ করে দেশের জন্য বিদেশী মুদ্রা নিয়ে আসা বন্ধ না করা পর্যন্ত বােধ হয় কেন্দ্র বা সচ্ছল রাজ্যগুলির হুশ হবে না।
শরণার্থী সমস্যা নিয়ে যে সব রাজ্যের গায়ে আঁচড় লাগছে না তাদের বড় চিন্তা পশ্চিমবঙ্গের ভরাডুবি নয়; তাদের চিন্তা-শরণার্থীদের জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হলে চতুর্থ যােজনার কাজ বানচাল হবে এবং তার ফলে তাদের উন্নতি শ্লথ হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক সমস্যাদির ব্যাপারে প্রত্যেক রাষ্ট্রই নিজস্ব স্বার্থের দিকটি বজায় রেখে অগ্রসর হয় তেমনি বাংলাদেশের সমস্যার মত অবস্থার ভারতের রাজ্যগুলিও নিজেদের স্বার্থের কথাটাই আগে ভাবছে। শ্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি। তিনি বােধহয় বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে না গিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজধানীতে একবার ঘুরে এলে ভালাে করতেন। তিনি মন্ত্রীসভায় তার সহকর্মীদের আলােচনায়ও তার সময়টা কাজে লাগাতে পারতেন । স্বদেশে অনেকের মত পাল্টাবার প্রয়ােজন আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিক সমস্যার ব্যাপরেও আমরা বােধ হয় উলটাপুরাণ গাইছি। শ্রীমতী গান্ধী। কলকাতায় বলেছেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাক ভারত তা চায় না। ২৫ মারচের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল ভারতের মনােভাব। কারণ বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হলে ভারতের ছদ্মসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার গভীর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে ভারত ভীত ছিল। যাই হােক, ইয়াহিয়া আক্রমণ শুরু করার পর ভারতের মনােভাবে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের সংগ্রামের যথার্থতা অন্যদের বুঝিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে যাদের উপর আমরা নির্ভর করে চলি আমরা কি তাদেরই চিন্তাভঙ্গি গ্রহণ করে বসে আছি?
ভারত সরকারের বিশ্বাস আর মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্তান আপনা থেকে ধসে পড়বে। একদিকে যুদ্ধের বিপুল ব্যয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের পাট-চা বিক্রি করে বিদেশী মুদ্রা ঘরে আনা বন্ধ- এই দুইয়ে মিলেই পাকিস্তানের ধ্বংস অনিবার্য করে তুলবে বলে বলা হচ্ছে। তা যদি হয়, তাহলে ভারতকে শুধু দেখতে হবে যে পাকিস্তান যেন বিদেশী সাহায্যের দ্বারা আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারে। ভারতের দূতদের বিদেশ পরিক্রমার সেটাও অন্যতম লক্ষ্য। নিরাপদে শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবার ব্যাপারে ভারত কী করতে পারবে তা বােঝা যাচ্ছে । বাংলাদেশের মুখপাত্রদের বক্তব্য ঃ আগামী মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে হটিয়ে দিতে না পারলে ওদের বােধ হয় আর কখনােই হটানাে যাবে না। তার অর্থ শরণার্থীদের ঘরে ফেরা হবে না। এটা হয়ত মুক্তিফৌজের অনেকের সাময়িক আশাভঙ্গজনিত বক্তব্য; কিন্তু তবু এ বক্তব্যের দিকে। ভারতকে কান দিতেই হবে। তাছাড়া, নয়াদিললিকে হয়ত পশ্চিম বঙ্গের ধ্বংসও দেখাতে হবে। তা যদি হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে তার ধাক্কা পড়বে প্রচণ্ড ভাবেই শ্রী অজয় মুখােপাধ্যায় ওয়ারনিং দিয়েছেন যে, তিনি হয়ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। তিনি যাতে তাড়াহুড়াে করে কিছু না করে বসেন সে ব্যাপারে শ্রীমতী গান্ধী হয়ত শ্রীমুখােপাধ্যায়কে সাময়িকভাবে রাজি করাতে পেরেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত সরকার কী করেন বা না করেন, তার উপরেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেষ পর্যন্ত কী করবেন বা না করবেন তা নির্ভর করবে।
১০ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা