You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশ ও নানা পন্থা-(২) -পান্নালাল দাশগুপ্ত - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ ও নানা পন্থা-(২)

–পান্নালাল দাশগুপ্ত

প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক গােষ্ঠী ভারতের সঙ্গে একটা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েই, এরকম বিপজ্জনক পথে অগ্রসর হচ্ছে, তা ধরে নেওয়াই উচিত। পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনতার হাতে পরাজিত হয়, তবে তাদের মুখ রক্ষা করা কঠিন, কারণ সেক্ষেত্রে নিজেদের প্রজার কাছেই তারা পরাজিত । এর চেয়ে যুদ্ধে ভারতের কাছে পরাজয় তারা শ্রেয় মনে করবে। কারণ তখন তারা পশ্চিম পাকিস্তানী জনতা ও পৃথিবীর মুসলমান দেশ গুলির কাছে ইসলামের বীর, শহীদ হিসেবে নিজেদের প্রদর্শিত এবং প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। তারা এটাই দেখবে যে, ভারতের হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের বিপুল শক্তির কাছে একটি নিরীহ দুর্বল ঐসলামিক রাষ্ট্র পরাজিত হলাে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা জানে যে, যুদ্ধে হারলেও ভূখণ্ডের দিক থেকে কিছুই তারা হারাবে না অর্থাৎ ভারত জমি কেড়ে নেবে না। আজকের পৃথিবীতে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের জমি দখল করে থাকা বা অনিচ্ছুক জনতার উপর বসে থাকাকে নিরাপদ ভাবে না। সুতরাং জমি জায়গার দিক থেকে কিছুই না হারিয়েও পাকিস্তানী আদর্শ (ভারত বিদ্বেষ) তারা এত জোরদার করতে পারবে যে, ভবিষ্যতে ভারতের উপর প্রতিরােধ নেবার শক্তি তাদের থাকবে। যুদ্ধ সব সময় জেতার জন্যই করা হয় সমগ্রভাবে ভারতের হাতে পরাজিত হবার যে ক্ষতি তা বাংলাদেশে বিপ্লবের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক গােষ্ঠীর প্রতিনিয়ত ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে অনেক কম। এটা ধরেই নিতে হবে যে, পাকিস্তান যে কোনাে ছুতােয় এখনই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত, কারণ এছাড়া তাদের মুখ রক্ষা করা কঠিন।

কাজে কাজেই আমরা ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে যদি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে আজ সাহায্য করি, তা এই আশাতেই করবাে যে, হয়তাে তাতে আমাদের পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে না, আমরা বেঁচে | গেলাম। কিন্তু পাকিস্তান ইতিমধ্যেই সব দোষ ও দায়িত্ব ভারতের ঘাড়ে দিচ্ছে যে, ভারতই মুক্তিফৌজকে সাহায্য করছে, ভারতীয় ফৌজই উৎপাত করছে অর্থাৎ যতটা প্ররােচনা দেওয়া সম্ভব তা তারা দিচ্ছে। দেড় কোটি লােকের সমস্যা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে ওদের “অভ্যন্তরীণ সমস্যা’কে আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় পরিণত করছে। | এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যে আমরা যদি কোনাে সার্থক পদক্ষেপ নিতে চাই, তবে শেষ পর্য পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক যুদ্ধ করতে হবে। আমাদের যুদ্ধ ঘােষণা করতে হবে না। যুদ্ধ ওরাই ঘােষণা করবে। এর দায়িত্বটা ওদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব। | যদি আমরা আজ বলিষ্ঠভাবে সেই চ্যালেঞ্জ স্বীকার করি, তবে পশ্চিম পকিস্তানী সামরিক গােষ্ঠী ও | অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদাতাি সহ যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার মােকাবিলা করার যােগ্যতা আমাদের থাকবে এবং | শেষ পর্যন্ত সেই আত্মরক্ষার যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারবাে। তার ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেও গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানাে সম্ভব হবে। কারণ আজ বাংলাদেশকে পাক রাহুমুক্ত করতে ভারতীয় বাহিনীর কয়েকদিনের বেশী লাগার কথা নয়। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের পক্ষে আপাতত একাজ অসম্ভব হলেও বাংলাদেশে অবস্থিত বর্তমান সামরিক শক্তি আজ ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে আরাে বেশী vulnerable, আরাে বেশী বিপন্ন। কারণ যে তিন ডিভিশন পাক-বাহিনী ওখানে আছে, তারা আর সুরক্ষিত ক্যানটনমেন্টগুলির মধ্যে ঘনবন্ধ অবস্থায় নেই, তারা সারা বাংলাফেশের  সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, আজো পর্যন্ত যেহেতু সেখানে বেসামরিক সরকার নেই, সেইহেতু থানা পুলিশ ইত্যাদির কাজও সামরিক বাহিনীকেই করতে হচ্ছে। কোনাে তাবেদার বেসরকারি নেতৃত্বে সরকার গঠন করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, Supply line হাজার হাজার মাইল বেড়ে গেছে, কাজেই আজ যদি কোনাে ঝটিতি আক্রমণ।  অতর্কিতে ওদের উপর এসে পড়ে, তবে ওদের পক্ষে আত্মরক্ষা করা আরাে বেশী কষ্টসাধ্য। দ্বিতীয়ত এক্ষুনি চীন থেকে ওরা কী সাহায্য পাবে এবং কোনাে সত্যিকারের সাহায্য পাবে কিনা এটাও বেশ সন্দেহজনক। ৬২ সালে চীন যখন নেফা দিয়ে ঢুকেছিল তখন ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এতৎসত্ত্বেও তিব্বতের থালা থেকে Foot hill-এ আসতে চীন সৈন্যদের পুরাে একটি মাস লেগেছিল। আর আজ ভারতের উত্তর সীমান্তে চীনকে রুখবার জন্য কমপক্ষে নয় ডিভিসন সৈন্য আছে। সে সৈন্যবাহিনী পার্বত্য যুদ্ধের জন্য অতি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং শীতপ্রধান ঐ পার্বত্য এলাকায় লড়াইয়ের জন্য বিশেষ শারীরিক অভ্যাসও তাদের রপ্ত করানাে হয়েছে (acclarnatisation)। এ অবস্থায় বৃহ্য ভেদ করা শক্ত। কোনােদিক দিয়ে ঢুকতেও পারে, সমতলে আসতে ওদের যতক্ষণ সময় লাগবে, ততক্ষণে বাংলাদেশে একটাও পাকিস্তানী সৈন্যও থাকার কথা নয়। যদি আমরা আজ বলিষ্ঠভাবে যুদ্ধ করতে পারি।

বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণ মুক্ত। অবশ্য একথা কোনাে সমরশাস্ত্রসম্মত নয় যে, চীনাবাহিনীর পক্ষে তিব্বত এবং হিমালয় পেরিয়ে ভারতের গাঙ্গেয় তটভূমে এসে লড়াই করা সম্ভব। এই দুর্গম পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে তাদের পক্ষে রসদ ও সমরসম্ভারের জন্য কোনাে supply line চালু রাখার প্রশ্ন ওঠে না। আর সে ধরনের একটা সার্বিক সামরিক অভিযান চালাতে গেলে তাকে এখন একটা আন্তর্জতিক মহাযুদ্ধের কথা ভাবতে হবে, পূর্ব ভারতের খাতিরে এখন তারা একটা বিশ্বযুদ্ধের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত এটা কষ্টকল্পনা। তাছাড়া ৬২ সালে যুদ্ধের সময় চীনের সঙ্গে রাশিয়ার | বিরােধ প্রকট হয়ে ওঠেনি, আজ ৭১ সালে চীন রাশিয়ার সম্পর্কটাকে প্রায় অহিনকুল সম্পর্কই বলা চলে। চীনকে আজ তার সামরিক শক্তির বৃহৎ অংশকে চীন-সসাভিয়েত সীমান্তে মােতায়েন রাখতে হয়েছে। এই সীমান্ত পৃথিবীর অন্যান্য যে কোন সীমান্তের চেয়ে অনেক বড়, তিন থেকে চার হাজার মাইল সিংকিয়াং থেকে মাঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। চীনকে তার সামুদ্রিক উপকূলও রক্ষা করতে হবে এবং আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনার । এই অবস্থায় তিব্বত ও হিমালয় অতিক্রম করে প্রত্যক্ষ সামরিক শক্তি নিয়ে চীন পূর্ব পাকিস্তানে আসবে, এ আশঙ্কা অমূলক। যা তার পক্ষে সম্ভব সে সম্পর্কে আগেই আলােচনা করা হয়েছে, অতি বামশক্তিগুলিকে পরিপুষ্ট করতে সে সহায়তা করবে। সেটা যাতে সফল না হয়, বিষবাষ্পে যাতে বাংলাদেশসহ গােটা পূর্ব ভারত রক্তাক্ত ছিন্নভিন্নতার বিপর্যস্ত না হয়, সে জন্যেই ভারতকে আজ বলিষ্ঠ হতে। হবে, সংগ্রামী হতে হবে।  শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হবে। এটা সমস্ত আধুনিক সমরশাস্ত্রবিদেরাই মনে করবেন যে পাক-ভারত যুদ্ধ বা এ ধরনের কোনাে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ‘৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ চলেছিল বাইশ দিন, আর আরব ইজরায়েল যুদ্ধ ছয়দিন। যদি আজ আবার পশ্চিম সীমান্তে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়, তবে ঐ সীমান্তে কোনো বড় শক্তির প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া তা এক বা দেড় মাসের বেশী টিকবে না। অতএব শেষ পর্যন্ত আমরা এখন এক দেড় মাস লড়তে পারি কিনা সেটাই আজ বিবেচ্য। | যদি বাংলাদেশের সংগ্রাম আমরা চার-পাঁচদিন বা এক সপ্তাহেও শেষ করতে পারি, তবে সেখানকার ভরতীয় সৈন্যদের অবিলম্বে আবার পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে সরিয়ে নেওয়া যাবে, উত্তর সীমান্তের একটি সৈন্যকেও সরাতে হবে না। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে সরানাে সৈন্য পশ্চিম সীমান্তে নিয়ােগ করতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলার ক্ষমতা বাড়বে। উত্তর সীমান্ত কিছুমাত্র দুর্বল করার প্রয়োজন হবে না এবং এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানকে পরাজিত করা সম্ভব হবে। 

এখানে রাশিয়া ও আমেরিকার কোনাে হস্তক্ষেপ আমদের কার্যকলাপে বিঘ্ন ঘটাতে পারে কিনা তা বিবেচ্য। এটা ঠিক যে যুদ্ধের ব্যাপারে আজ আমরা যতটা রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল, ততটা আমেরিকার উপর নয়। রাশিয়া যদি আমাদের এ যুদ্ধ পছন্দ নাও করে, তবু শেষ পর্যন্ত সে ভারতকে পরিত্যাগ করতে পারবে না, কারণ তাহলে তার নিজের আত্মরক্ষার ব্যবস্থাও পরিত্যাগ করতে হয়। তার আন্তর্জাতিক আত্মরক্ষা  ব্যবস্থায় ভারত একটি অপরিহার্য দেশ । কাজেই ভারত তার নিজের আত্মরক্ষা ব্যবস্থায় যা করবে রাশিয়া তা। মেনে নেবে। Security Council-এ আমেরিকা যদি কোনো বিরুদ্ধবাদী প্রস্তাব আনে, তবে রাশিয়া যে ভেটো। দেবে এতে কোনাে সন্দেহ নেই। খাস আমেরিকাতেও আজ বাংলাদেশের পক্ষে জনমত যথেষ্ট সােচ্চার। আমেরিকার পক্ষেও নিজ রাজ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে ভিয়েৎনামকে নিয়েও বেকায়দায় থেকে পশ্চিম। পাকিস্তানকে সমর্থন করা সম্ভব হচ্ছে না। শেষ অবধি বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত যদি আজ একটা প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ভুমিকা নিতে এগিয়ে আসে, তবে ভারতের সেই ভূমিকাকে আমেরিকা গিলে নিতে বাধ্য হবে। গােয়া স্বাধীন করার সংগ্রামের সময় কি এরা আমাদের সমর্থন করেছিল? তবু মেনে নিতে বাধ্য হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এটাই রীতনীতি। কেউ যাতে কিছু না করে তার জন্য চাপ থাকে, কিন্তু করে ফেললে। মেনে নিতে হয়। কিন্তু রঞ্জুকে সর্পভ্রম করলে অচিরেই সেই রঙ্কুতেই ভারতকে আত্মহত্যা করতে হবে।

৭ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা